নিজস্ব প্রতিবেদক, বিনিয়োগবার্তা: আগামী এক বছরের মধ্যে দেশে একটি স্থিতিশীল,উন্নত ও সমৃদ্ধ পুঁজিবাজার দেখা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে বাজারে যেসব আইনগত ও কাঠামোগত সংস্কার হয়েছে তার সুফল ইতিমধ্যে পাওয়া শুরু হয়েছে; যা আগামীতে আরো দৃশ্যমান হবে। তবে এই অমিত সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে আর্থিক প্রতিবদন ও কোম্পানির তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি। তিনি বলেন, কোম্পানি যত ভালই হোক না কেন,তার প্রকাশিত তথ্য এবং আর্থিক প্রতিবেদনে যদি আস্থা রাখা না যায়,তাহলে ওই কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী,বিশেষ করে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না। মঙ্গলবার বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)আয়োজিত ‘পুঁজিবাজারের উন্নয়নে আর্থিক প্রতিবেদনের গুরুত্ব’ শিরোনামের এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড.মসিউর রহমান।বিএসইসি চেয়ারম্যান ড.এম খায়রুল হোসেন এবং ফাইনাসিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) চেয়ারম্যান মুস্তাক আহমেদ সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন।
বিএমবিএর প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমবিএর নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর মাহফুজুর রহমান।বীমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ)সদস্য ড.এম মোশাররফ হোসেন সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।এছাড়াও বক্তব্য রাখেন অর্থমন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাকসুদা নুর। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে আস্থাহীনতার বিষয়টি সম্পর্কে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, শোনা যায় কোম্পানিগুলো একাধিক আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে।একটি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য, একটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য এবং অপরটি ব্যাংকের জন্য।আর প্রতিটিতেই থাকে তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিন্নতা।অন্যদিকে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তা ও ম্যানেজমেন্ট উসৎ উদ্দেশ্যে মুনাফা বা শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) বাড়িয়ে কমিয়ে দেখায়।এ জন্য অনেক কোম্পানির দুই প্রান্তিকের ইপিএসের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়।
ড. এম খায়রুল হোসেন বলেন, বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা কোন দেশে বিনিয়োগ করার আগে যাচাই করে দেখে ওই দেশে কোম্পানিগুলোর ডিসক্লোজার কতটা নির্ভরযোগ্য,নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন কতটা স্বচ্ছ।কারণ আর্থিক প্রতিবেদন নির্ভরযোগ্য না হলে বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে কাঙ্খিত রিটার্ন পাওয়া যায় না;বরং অনেক সময় লোকসানে পড়তে হয়। তিনি বলেন, শুধু নিরীক্ষকদের পক্ষে স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য আর্থিক প্রতিবেদন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ এই প্রতিবেদনটি মূলত তৈরি করে কোম্পানির ম্যানজেমেন্ট। এখানে কোম্পানির সিএফও এবং কোম্পানি সচিবদের আরও দায়িত্ব নিতে হবে।মালিকপক্ষ বললেই তাদের মতো করে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে দেওয়া উচিত নয়। তাদের উচিত নিজেদের প্রজ্ঞা এবং নৈতিক মানের প্রয়োগ ঘটানো।
এফআরসি চেয়ারম্যান সি কিউ কে মুস্তাক আহমেদ বলেন, শুধু পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ নয়, আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার সঙ্গে রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়েরও সম্পর্ক রয়েছে।তাই সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই নির্ভরযোগ্য আর্থিক প্রতিবেদন অনেক জরুরি।
তিনি বলেন, তারা কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি বড় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএসইসি ও আইসিএবিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রয়োজনে এফআরসি নিজেও দোষী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
এফআরসি চেয়ারম্যান মুস্তাক আহমেদ বলেন,অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ডিসক্লোজার বা প্রকাশিত তথ্য এবং নথিপত্রের মধ্যেই সমস্যা থাকে। কোম্পানির ম্যানেজমেন্টই আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে। তারা এমন জালজালিয়াতিভাবে হিসাব বিকৃত করে, গুছিয়ে মিথ্যা ডিসক্লোজার দেয় যা একজন নিরীক্ষকের পক্ষে যাচাই করা সহজ নয়।
তিনি কোম্পানির ম্যানেজমেন্টকে কীভাবে আরও বেশি জবাবদিহীতার আওতায় নিয়ে আসা যায় তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আহ্বান জানান। আর এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে যথেষ্ট কঠোর হওয়ারও তাগিদ দেন তিনি।
তিনি বলেন, কেউ চুরি করলে তাকে চোর বলাই উচিত। কিন্তু বর্তমানে এক ধরণের ফ্যাশন হয়েছে; চোরকে চোর না বলে বলা হয় তার মধ্যে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কিন্তু বিষয়টির সিরিয়াসনেস কমে যায়, অপরাধ গুরুত্ব হালকা হয়ে পড়ে।
বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা বাড়াতে সব নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন, যেখানে বিএসইসি, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রবেশাধিকার থাকবে। আর এমনটি হলে আর বিভিন্ন পক্ষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি এবং বিনিয়োগকারী ও সরকারকে ঠকানোর এত অবাধ সুযোগ থাকবে না।
এসময় আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা আনতে কেন্দ্রিয় ডাটাব্যাংক স্থাপনে গুরুত্বারোপ করেন।
(শাহরিয়ার/শামীম/ ০৪ মার্চ, ২০২০)