Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Saturday, 06 Nov 2021 06:00
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়

ড: মিহির কুমার রায়: ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার নিয়ে বছরের প্রথম থেকেই আলাপ-আলোচনা, টকশো ও তর্কবিতর্ক যখন তুঙ্গে তখনই ১ জুলাই ২০১৮ তারিখ থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক ডিজিটে অর্থাৎ সর্বোচ্চ নয় শতাংশ নামিয়ে আনার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিল ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। এখানে উল্লেখ্য, বেসরকারি ব্যাংকগুলো আগে থেকেই সরকারি আমানতের নিশ্চয়তা চাচ্ছিল, যা নিশ্চিত হয়েছে ৬ শতাংশে যা অনেকটাই স্বস্তিদায়ক কারণ এর আগের  বছরগুলোতেও ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তখন বছরের মাঝামাঝিতে তারল্য সংকটের মুখে বছরের শেষে সুদের হার ১২ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করতে থাকে যার কারণে বিপাকে পড়েছিল দেশের শিল্প খাত। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে তারল্য সংকট নিরসনে বেসরকারি ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বিএবির চাহিদা অনুযায়ী সরকারের কাছ থেকে যে সব সুবিধা তারা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে তার মধ্যে এক. সরকারি আমানতের শতকরা ৫০ ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা; দ্বিতীয়ত, সিআরআরের ১ শতাংশ কমানো; তৃতীয়ত, ঋণ আমানতের হার এডিআর সমন্বয় সীমার সময় বাড়ানো; চতুর্থত, কর্পোরেট ৬.৭৫ থেকে ৬ শতাংশ নামিয়ে আনা; পঞ্চমত, ব্যাংক মালিকদের বেশি মুনাফা দেয়ার জন্য ব্যাংকিং খাতের মুনাফার ওপর কর্পোরেট কর ২.৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত এবং সর্বশেষ স্বল্প সুদে সরকারি আমানতের নিশ্চয়তাও পেল বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের অন্যতম শর্ত হচ্ছে ঋণের সুদের হার হ্রাস এবং এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হলে দেশে ব্যবসাবাণিজ্য ও শিল্পবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হবে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে গতিশীলতা আসবে। আমাদের প্রতিবেশী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার আমাদের তুলনায় অনেক কম, যেমন- চীনে ৪.৩ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৫.৩ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৬.২৫ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় ৮.৪ শতাংশ। বাংলাদেশে সুদের হার এক ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্তটা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় কমে আসবে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অনেকাংশে সম্ভব হবে বলে প্রতীয়মান। কিন্তু তাত্ত্বিক দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে ঋণের ওপর ৯ এবং আমানতের ওপর ৬ শতাংশ সুদের যে ঘোষণা এসেছে তা নিয়েও যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে। কারণ বাজার অর্থনীতির যুগে সুদের হার নির্ধারিত হয় ঋণের চাহিদা ও সরবরাহ জোগানের ওপর অর্থাৎ ঋণের জোগান ব্যবস্থা যদি চাহিদার তুলনায় বেশি হয় কিংবা ঋণের চাহিদায় তুলনায় সরবরাহ যদি কম হয় তাহলে সুদের হার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কম বেশি কিংবা ওঠানামা করবে। বাস্তবতা হলো ঋণের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ সব সময় অপ্রতুল থাকে বিধায় সুদের হার উচ্চতে থাকাই স্বাভাবিক। ফলে বেসরকারি সংস্থার এনজিও ঋণের সুদের হার সরকারি/বেসরকারি ব্যাংকের বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদের হারের তুলনায় অনেক বেশি- যা অনেক ক্ষেত্রে ডবল কিংবা ট্রিপল ডিজিটে চলে আসে যাকে বলা হয় মার্কেট রেইট।

এই অবস্থায় ঋণের সুদের বোঝা যাতে সাধারণ গ্রহীতাদের ওপর কম চাপ সৃষ্টি করে বিনিয়োগের স্বার্থে সে জন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ঋণনীতির কিংবা মুদ্রানীতির আওতায় তফসিলি ব্যাংকগুলোর জন্য সুদের হার চালু অব্যাহত রেখেছে যার মধ্য থেকেই স্ব স্ব ব্যাংকগুলো সরকারি কিংবা বেসরকারি তাদের সুদের হার নির্ধারণ করে থাকে। আবার বিশেষ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নিলে তফসিলি ব্যাংকগুলোতে কমাতে উদ্বুদ্ধ হয় যা এবার ঘটেছে। আমরা জানি যে ব্যাংকের সুদ হচ্ছে নির্ধারিত ঋণের ওপর গৃহীতার প্রদেয় মূল্য যা নিয়ে বিতর্কের কোনো প্রকার অবকাশ নেই এবং এই মূল্যটি হচ্ছে ব্যাংকগুলোর আয়ের মূল উৎস অথচ বিশেষত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণ বিতরণ একটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সময়ে বিশেষত ঋণখেলাপি হওয়ার আতঙ্কের কারণে। তাহলে বিষয়টি কি? নির্দিষ্ট সময়ে শর্ত মোতাবেক যদি কোনো ঋণ গ্রহীতা তার ঋণ পরিশোধে অপারগ হয় তাহলে এ বিষয়টি হয় ব্যাংকের ভাষায় কুঋণ বা অনাদায়ী ঋণ। যেমন উচ্চ সুদের কারণে ঋণ গ্রহীতার ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা লোপ পায় কিংবা ব্যাংকগুলো অনুৎপাদন খাতে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধে অনীহা বিশেষত ঋণগ্রহণের সময় সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপনীয় লেনদেনে জড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঋণখেলাপির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত।

এগুলো বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং গত মার্চ মাস পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ যা দাঁড়িয়েছে যা মোট ঋণের শতকরা ১০ ভাগের কাছাকাছি। এর ফলে ঋণের সুদের হার বাড়ছে এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারল্য সংকটকে উৎসাহিত করছে। এ ধরনের একটা পরিস্থিতিতে দেশের আর্থিক সংকট দেখা দিলে কিংবা মুদ্রাস্ফীতির হার বেশি হলে ব্যাংকগুলো তাদের সুদের হার বাড়িয়ে এ ধরনের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। এ সব ঝামেলা ডিঙিয়ে স্থায়িত্বশীলতার প্রশ্নে ব্যাংকগুলোকে মুনাফা করতে হয়, জনকল্যাণে কাজ করতে হয়, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে হয় ও বাণিজ্যে, কৃষি শিল্পে ভূমিকা রাখতে হয়। ব্যাংকের সুদ যেহেতু ব্যাংক ব্যবসার আয়ের একটি মুখ্য উৎস এবং সেই সুদই যেহেতু অর্থনীতির গতি সঞ্চারে একটি অন্যতম নিয়ামক তাই তড়িঘড়ি নয়-ছয় করে সুদের হার বাড়ানো কিংবা কমানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেয়ে বাজার ব্যবস্থার ওপর বিষয়টিকে ছেড়ে দেয়াই সমীচীন হবে বলে মনে করা হয়। কারণ ব্যাংককে মুনাফা করেই চলতে হবে যার জন্য চিরাচরিত আমানতের ও ঋণের সুদের মধ্যে যে ন্যূনতম শতকরা ৫ ভাগ ব্যবধান রাখার পরও নানা কারণে ব্যাংকগুলোর মুনাফা প্রবৃদ্ধির সমভাবে ওঠানামা করে না। এখন সেটি ৩ ভাগে এসেছে অর্থাৎ ৯ শতাংশ হার সুদে যেখানে ৬ শতাংশ চলে যাবে ফান্ড কস্টে আর বাকি ৩ শতাংশ দিয়ে ব্যাংক তার প্রশাসনিক খরচ মিটিয়ে মুনাফা দেখবে তা খুবই দুস্কর হবে।

তারপরও সিদ্ধান্ত যখন হয়েছে তখন বিএবির নেতারা বলেছেন কোনো বেসরকারি ব্যাংক যদি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন না করে তা হলে সেই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (সিইও) বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা কিংবা চাকরিচ্যুতি ঘটানো হতে পারে। এখন এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রধান নির্বাহীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে যার প্রভাব ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমের প্রতিফলিত হবে। এখন প্রচলিত নিয়মানুসারে বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরিচ্যুতি ঘটানোর কোনো ক্ষমতা রাখে না বিধায় যে কোনো বোর্ডের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে বাস্তবায়িত হতে হবে। এ ধরনের নয়-ছয়ের বিষয়গুলো আর্থিক খাতের জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনবে না। এখন ব্যাংকের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে এক অঙ্কের সুদের হারকে বাস্তবায়িত করা। কিন্তু কিছু বেসরকারি ব্যাংক এখনো এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উভয় সংকটের মধ্যে রয়েছে যা বন্ধ হওয়া উচিত এবং অভিন্ন নীতি-কৌশল মেনে চলতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করার সময় এসেছে। কারণ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনের পথে রয়েছে। এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা পাশাপাশি প্রয়োজন সহজ শর্তে বিনিয়োগ। আমরা আশা করছি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় দেশে উদ্যোক্তা সমাজের সক্ষমতা রক্ষায় সুদের হার অবশ্যি যৌক্তিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি।