ড. মিহির কুমার রায়ঃ বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে খাদ্যশস্য ও ধান উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রতি বছর দেশে দশমিক ৪৩ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমলেও স্বাধীনতা - পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চাল উৎপাদন বাড়লেও এর প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন না বাড়ায় চাল আমদানিও বাড়াতে হচ্ছে। একরপ্রতি উৎপাদনও সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় টেকসই উন্নয়নের জন্য গতিশীল কৃষির প্রয়োজন। জমির স্বল্পতার কারণে প্রান্তিক ক্ষুদ্র শ্রেণীর কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। তারাই এখন দেশের খাদ্যনিরাপত্তার একমাত্র ভরসাস্থল, যারা একখণ্ড জমিকে আঁকড়ে ধরে আছে। তাদের জমিতে যথাযথ প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটালে টেকসই কৃষি উৎপাদন সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভর্তুকিতে কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্যে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। ২০২৫ সালের মধ্যে এর সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার প্রায় সব উপজেলায় কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। এক বছর শেষ না হতেই অর্থ ছাড়সহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার খবর মিলছে অর্থ ছাড় না হওয়ায় গত অর্থবছরেই শতভাগ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এ কথা সত্য, ভর্তুকি সুবিধাসহ আধুনিক যন্ত্রনির্ভর কৃষি প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছানো ও টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আক্ষরিক অর্থেই কঠিন একটি কাজ এবং এটি নিশ্চিতের জন্য আরো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন ও তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কৃষি সরঞ্জাম, হস্ত ও শক্তিচালিত যন্ত্রপাতির কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি শ্রমিকের কর্মদক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রচলিত শ্রমিকের মাধ্যমে পরিচালিত অনেক কৃষিকাজ শক্তিচালিত কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তবে এর গতি আরো বাড়তে হবে। কৃষিকাজের আধুনিকীকরণ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে, যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ চারা রোপণ, পরিচর্যা, ফসল সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও মূল্য সংযোজনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত সব প্রত্যক্ষ - পরোক্ষ কার্যকারিতা ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ভূমিকা অপরিসীম। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বলতে কেবল কৃষি যন্ত্রপাতি বিকাশের অগ্রগতিকেই বোঝায় না; বরং এটি কৃষির পরিবেশ, কৃষির মান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মতো অনেক বিষয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। এটি গতিশীল, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি যন্ত্রপাতির বিকাশ, উদ্ভাবন ও ব্যবহারের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে প্রধানত ট্রাক্টর ও মেশিনারি সম্পৃক্ত থাকলেও অন্যান্য ইনপুট যেমন উৎপাদন, নির্বাচন, বিতরণ, ব্যবহার, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও কৃষি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তাদের পরিচালনায় বীজ, সার, পানি, কৃষি শ্রমিক এমনকি কৃষি মৌসুম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের চিত্র হলো জমি চাষে ৯৫ ভাগ, সেচ ব্যবস্থায় ৯৫, ফসল তোলা বা হারভেস্টে ১.৫, ধান মাড়াইয়ে ৯৫, রোপণে দশমিক ৫ ভাগেরও কম। মূল সংকটের জায়গাটি এখানেই। ফসল উৎপাদন-পূর্ববর্তী যান্ত্রিকীকরণে যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, উৎপাদন ও তার পরবর্তী প্রক্রিয়াকরণে পিছিয়ে থাকায় আমাদের বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। জমি চাষ, মাড়াই ও সেচের ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ হলেও সিডার, হারভেস্ট ও সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ ততটা হয়নি। এর মূল কারণ হলো - চাষ, মাড়াই ও সেচের জন্য যে ধরনের যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, সেগুলো টেকনোলজি বেজড। আর সিডার, হারভেস্ট ও কীটনাশক বা সার প্রয়োগের জন্য যে যন্ত্রগুলো রয়েছে তা টেকনোলজির পাশাপাশি নলেজ বেজড। ফলে যন্ত্র ব্যবহারে যন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষটিরও কিছুটা দক্ষতা অর্জনের বিষয় আছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষককে দক্ষ করে তুলতে পারলে ওই যন্ত্রগুলোও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, ব্যবহার বাড়বে।
মাছ চাষ, দুগ্ধখামার কিংবা পোলট্রি শিল্পেও বিশ্বব্যাপী বহুবিধ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে বলেই এসব খাতে অনেক বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করা গেছে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষতিও কমানো সম্ভব হয়েছে। একসময় কৃষিযন্ত্রের কথা শুনলে আমাদের দেশের কৃষি শ্রমিকরা আঁতকে উঠতেন। তারা ভাবতেন যন্ত্র এসে তাদের কাজটুকু কেড়ে নেবে। এখন আর সেই দিন নেই। এখন একটি কৃষিযন্ত্র গ্রামের একজন তরুণের নিরাপদ কর্মসংস্থান। আধুনিক চাষ পদ্ধতির সঙ্গে টিকে থাকতে মান্ধাতা আমলের ধ্যানধারণা দিয়ে সম্ভব নয়। এটি সবাই বুঝে গেছে। সময়ের বিবর্তনে কাজেরও বহু ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এখন কৃষি শ্রমিকেরও তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণেও কৃষি হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল। এর সমাধান আসতে পারে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমেই। ধান, গম, আলু, ভুট্টাসহ নানা রকম সবজি ও ফলের পাশাপাশি মৎস, পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পেও আমাদের কৃষক ও খামারিরা বিপ্লব ঘটিয়েছেন। কৃষি খাতে সরকারের আন্তরিকতা, সমন্বিত উদ্যোগ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নেয়া প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ধরনের অগ্রগতি নিশ্চিত করবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন সময়েরই দাবি। প্রকল্পটি যাতে যথাসময়ে সম্পন্ন হয় এবং কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়। করোনাকাল কতদিন স্থায়ী হবে তা এখনো অনিশ্চিত। মনে রাখা দরকার, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যে কৃষিই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি এবং টিকে থাকার মূল শক্তি। সমন্বিত আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
জাপানের ৭০ শতাংশ কৃষকের বয়স ৬৫ - ঊর্ধ্ব। এমনিতেই জাপানে জন্মহার কম। শিল্পোন্নত হওয়ায় তরুণদের কৃষির প্রতি আগ্রহ কম। তাই সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রবীণ কৃষকদের কাজটা সহজ করে দিচ্ছে, অন্যদিকে সরকার ধারণা করছে যান্ত্রিক কৃষির প্রতি তরুণরা আগ্রহী হবে। জাপান একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছিল। প্রথমত তারা চাচ্ছিল তরুণ প্রজন্মকে কৃষির প্রতি আকৃষ্ট করতে। এ কারণে তারা তাদের বাজেটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের পাশাপাশি অর্গানিক কৃষি ও গ্যাপ সার্টিফায়েড কৃষির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। আমরা যদি বাংলাদেশের চিত্রটির দিকে তাকাই তাহলে দেখব ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের কৃষকের গড় বয়স ৪৮ বছর। অথচ ১৯৮৮ সালে দেশের কৃষিতে নিয়োজিত চাষীদের গড় বয়স ছিল ৩৫ বছর। তার মানে বাংলাদেশের কৃষিতেও তরুণদের অংশগ্রহণ কমছে। কিন্তু বয়স্ক মানুষের শারীরিক সক্ষমতা কমে গেলে তারা কৃষিতে সফলভাবে ভূমিকা রাখতে পারে না। তার মানে একদিকে তরুণদের কৃষিতে অংশগ্রহণ বাড়ানো যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি ব্যাপকভাবে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ।
করোনা পরিস্থিতি সব অর্থনৈতিক খাতকে বহুদিনের জন্য স্থবির করে দিয়েছে। এমন সময়ে মানুষের সামনে ঘুরেফিরে প্রাচীন পেশা কৃষিই যেন একমাত্র ভরসার আলো জ্বালছে। সবুজ বিপ্লবের সময়ের মতো এখনো সবার মনেই প্রশ্ন জাগছে, কৃষি উৎপাদন সর্বোচ্চ বৃদ্ধির জন্য কোন কোন দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। স্বভাবতই সবচেয়ে আগে আসছে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়ায় ফসল কাটা, মাড়াই ও প্রক্রিয়াকরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি জোরের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে। সরকারও তাতে সাড়া দিয়েছে যথাসময়ে, কিন্তু অর্থ সংকট বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে উদ্যোগটির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হলে তা দেশের কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক হবে না। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক লাভবান হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। একই সঙ্গে, ফসলের নিবিড়তা বাড়বে ও চাষ ত্বরান্বিত হবে। দেশের বিদ্যমান কৃষিব্যবস্থার আধুনিক তথা যান্ত্রিকীকরণের জন্য বাজেটে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। বলা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এটি আরো এক ধাপ অগ্রগতি। সেক্ষেত্রে শুধু নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করলেই চলবে না, বরং প্রচলিত ধারার আবহমান কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নও একান্তভাবে কাম্য ও কাঙ্ক্ষিত। বর্তমানে শহর-নগর-বন্দরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। রাজধানীসহ প্রায় সর্বত্র সুউচ্চ দালানকোঠা ও মার্কেট নির্মাণ করতে গিয়ে অত্যধিক চাপ পড়ছে কৃষিজমিতে। সরকার সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক সচেতন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, গ্রামকে শহরায়ন করা হবে, গ্রামের নিসর্গ-প্রকৃতি ও সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রেখেই। শহরের সব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হবে গ্রামেও। তাই বলে কেবল উন্নয়নের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, কৃষি অদ্যাবধি বাংলাদেশের জীবন - জীবিকা ও অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তবে বর্তমানে কৃষিকাজে উ্রৎসাহী তথা কৃষিশ্রমিক পাওয়া রীতিমতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে। গত দুই বছর ধরে হাওর অঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও একজন শ্রমিকের মজুরি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। অন্যদিকে বর্তমানে বাজারে এক মণ ধানের দাম বড়জোর ৪৫০-৫০০ টাকা। ইতিমধ্যে ধানের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। প্রচলিত কৃষিব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ শুরু হলে ধানবীজ, চারা রোপণসহ সার ও কীটনাশক ছিটানো, নিড়ানি, সর্বোপরি ধান কাটা, মাড়াইসহ শুকানো এমনকি সরাসরি সাইলোতে পাঠানো—সবই করা সহজে সম্ভব আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। কৃষিতে প্রতি বছর কমবেশি ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে ৬ - ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে বিবিধ প্রণোদনা খাতে। এখন থেকে বাকি ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কাজে। তবে উল্লেখ করা আবশ্যক, এই কাজটি শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। তবে এর সার্বিক সুফল পেতে হলে টুকরো টুকরো জমির একত্রীকরণ অত্যাবশ্যক। সমবায় প্রথা এক্ষেত্রে সুফলদায়ক হতে পারে। এর পাশাপাশি উৎপাদিত ফসলের আধুনিক বিপণন ব্যবস্থাও জরুরি। গত কয়েক বছরে দেশে বিপ্লব ঘটে গেছে কৃষিতে, ডিজিটাল কৃষিসহ হাইব্রিড পদ্ধতি চালুর ফলে একেবারে বীজতলা থেকে শুরু করে সার, সেচ, কীটনাশক, আবহাওয়া, জলবায়ু, ফসল উৎপাদন, বাজার পরিস্থিতিসহ নানাবিধ সমস্যা নিয়ে খোলামেলা মতবিনিময়, পরামর্শ ও প্রতিকারের সুযোগ পাওয়া যায় তাৎক্ষণিকভাবে। এর অনিবার্য ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি ব্যবস্থাপনায়, সুফল পাচ্ছে কৃষক, সর্বোপরি বাড়ছে ফসল উৎপাদন। তার মানে ডিজিটাল কৃষিব্যবস্থা দেশের কৃষিতে প্রায় বিপ্লব নিয়ে এসেছে। আবহমানকাল ধরে প্রচলিত গবাদি পশুচালিত লাঙল-জোয়ালের দিন শেষ হয়েছে আগেই। হাইব্রিড বীজ, জিএম বীজসহ আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ফসল, শাকসবজি, মৎস, পোলট্রি, ফলফলাদির উৎপাদন বাড়িয়েছে বহু গুণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি। প্রতি বছর উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক খাদ্যগুদামের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি কৃষির যান্ত্রিকীকরণসহ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। এখন প্রশ্ন হলো, কোভিডের কারণে বিদেশ থেকে যে শ্রমিকরা দেশে ফিরে এসেছেন এবং এখনো বিদেশে যেতে পারেননি, শহর থেকে কাজ হারিয়ে যারা গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের কর্মসংস্থান কিংবা তাদের শ্রম বিনিয়োগ কীভাবে ঘটবে? কোভিড - ১৯ মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে, যার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা ৪ শতাংশ সুদে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসএমই খাতে দিয়েছে। বর্তমান সরকার মনে করছে, কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ, কৃষি গবেষণায় দক্ষতা বৃদ্ধি, কৃষির বহুমুখীকরণ, রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ, পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদিতে জোর দিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে বর্তমান বছরের বাজেটে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) যে টার্গেট ধরা হয়েছে, তা অর্জনে কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় সেই খাতে প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ৪.৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে বলে কৃষি অথনীতিবিদগণ মনে করেন। কোভিড - ১৯ দেখিয়ে দিয়েছে রপ্তানিমুখী চিন্তা পরিহার করে গ্রামীণ অর্থনীতি ও খাদ্য উৎপাদন খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন বিষয়ে। প্রবৃদ্ধি যাই হোক না কেন, তা অর্জিত হয়েছে মূলত কৃষি, প্রবাসী আয় এবং পোশাক রপ্তানি খাত থেকে।
লেখক: অধ্যাপক, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।