নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পূর্তিতে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে বড় বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল।
পোশাক কারখানা তৈরির পাশাপাশি স্মার্টফোনসহ মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরি করতে যাচ্ছে তারা। তেল, আটা, ময়দা, লবণের মতো ভোগ্যপণ্যও আসবে প্রাণের মোড়কে।
নতুন খাতে ১৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে কোম্পানিটি। এতে ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলৌ জানিয়েছে কোম্পানিটি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা দেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল।
চার দশক আগে টিউবঅয়েল ও কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করে ব্যবসায় নামা প্রাণ-আরএফএল এখন খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স থেকে বহু ধরনের পণ্য উৎপাদন করছে।
সংবাদ সম্মেলনে কামরুজ্জামান বলেন, “নতুন বছরে নতুন শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং নতুন নতুন পণ্য বাজারে আনার কাজে হাত দিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ প্রাণ। এতে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে যার ফলে ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।”
অনুষ্ঠানে জানান হয়, এরই মধ্যে সয়াবিন বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও তেল পরিশোধন, আটা, লবণ, ডাল, স্টার্চ, ফিডমিলসহ কয়েকটি পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে গাজীপুরের মুক্তারপুরে কালীগঞ্জ এগো প্রোসেসিং লিমিটেড (কেএপিএল) নামে নতুন একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরির কাজ শুরু করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।
১৮০ বিঘা আয়তনের এ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে এখন স্থাপনা নির্মাণ ও মেশিন বসানোর কাজ এগিয়ে চলছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বাজারে আসতে পারে বলে আশা প্রাণ কর্মকর্তাদের।
নরসিংদীতে প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে স্মার্ট ও ফিচার ফোনের পাশাপাশি হেড ফোন, ব্যাটারি, চার্জারসহ বিভিন্ন ধরনের মোবাইল এক্সেসরিজ উৎপাদন হবে।
আগামী মার্চেই প্রোটন ব্র্যান্ডের এসব ফোন ক্রেতাদের হাতে পৌঁছানোর আশা দেখিয়েছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কর্মকর্তারা।
দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়িতে এবার গার্মেন্টস কারখানা করছে প্রাণ গ্রুপ। আগামী ফেব্রুয়ারিতে এ কারখানার উদ্বোধন করা হতে পারে।
প্রাণ কর্মকর্তারা বলেন, এখানে বিভিন্ন ধরনের অন্তর্বাস ও পোলো শার্ট তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রাথমিকভাবে ২৫০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে যেখানে গ্রামীণ নারীরা কাজের সুযোগ পাবেন।
কামরুজ্জামান বলেন, “আমাদের গ্রুপের প্রধান লক্ষ্য ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন। আমরা এখন যতগুলো কারখানা করছি সবগুলোই ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। আমরা চেষ্টা করছি শ্রমঘন শিল্পগুলো ঢাকার বাইরে স্থাপন করতে।
“আমরা দেখেছি দেশের বেশিরভাগ গার্মেন্টস রাজধানী ও তার আশেপাশের শহরগুলোতে। কিন্তু এ গার্মেন্টস আমরা উত্তরাঞ্চলে স্থাপন শুরু করেছি। আমরা আশা করছি, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এ উদ্যোগ দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।”
কক্সবাজারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিভিন্ন চড়াই-উৎড়াইয়ের গল্প শোনান গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান। সেই সঙ্গে তুলে ধরেন আগামী দিনের ব্যবসায়ের বিভিন্ন দিক।
দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও কৃষিকাজে সেচের পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে টিউবঅয়েল ও কৃষি সহায়ক যন্ত্রপাতি তৈরির মাধ্যমে ১৯৮১ সালে রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল) এর মাধ্যমে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের যাত্রা শুরু।
পরে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকে মানোনিবেশ করে এবং ১৯৯৩ সালে নরসিংদীতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করার জন্য একটি কারখানা স্থাপন করা হয়।
এরপর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপকে আর ফিরে থাকাতে হয়নি। ড্রিংকস, সস, জেলি, চানাচুর, চিপস, মশলা, চকলেট, বেকারি, ফ্রোজেন ফুডস, ট্রয়লেট্রিজ, দুগ্ধজাত, হাউজওয়্যার, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকসসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করার মাধ্যমে প্রাণ-আরএফএল হয়ে উঠে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ।
কামরুজ্জামান বলেন, “শুরুটা ছিল বেশ কঠিন। রংপুর বিসিকে ছোট একটি কারখানা দিয়ে স্বল্প বিনিয়োগ নিয়ে আমাদের পথচলা শুরু। তবে সেসময় আমাদের টিউবওয়েল ও কৃষি সহায়ক যন্ত্রপাতি গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য বড় ভূমিকা রাখে।
“পরে নরসিংদীতে ক্ষুদ্র আকারে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা চালু হলো, যেখানে আনারস প্রসেসিং করা হতো। এরপর একে একে ম্যাংগো ড্রিংক ও অন্যান্য পণ্য আসা শুরু করে। সেই প্রাণের ঝুড়িতে এখন অসংখ্য পণ্য, যা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই প্রাণ এখন দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ‘প্রাণ’ হয়ে উঠেছে।”
আগামী দিনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি জানান, আপাতত চিনি ছাড়া সব ধরনের ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে প্রাণ গ্রুপ। কয়েক মাসের মধ্যে প্রোটন ব্র্যান্ডে মোবাইল উৎপাদন শুরু হবে। পাশাপাশি জুতো, গ্লাসওয়্যার ও পোল্ট্রি শিল্প খাতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে জানান হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এপর্যন্ত সারাদেশের ২৩টি স্থানে ৫২০ একর জমির ওপর কারখানা সম্প্রসারণ করেছে প্রাণ-আরএফএল। নিজস্ব চাহিদা পূরণের জন্য তারা ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছে।
২০১১ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পাউডার মিল্ক উৎপাদন শুরু হয় প্রাণের হাত ধরে। বর্তমানে বিশ্বের ১৪৫টি দেশে রয়েছে প্রাণের পণ্য রপ্তানি কার্যক্রম। এসব কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে বর্তমানে এক লাখ ২৯ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে প্রাণের কারখানাগুলোতে। এছাড়া প্রাণের সঙ্গে রয়েছে আরও এক লাখ চুক্তিভিত্তিক কৃষক।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তৌহিদুজ্জামান ও ব্যবস্থাপক মাকছুদ উল ইসলামসহ প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//