‘যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক ঐতিহাসিক, যা অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান। গত কয়েক বছরে এ সম্পর্ক আরও সূদৃঢ হয়েছে। দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য-বিনিয়োগ আরও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দু’দেশের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা চলছে। কিভাবে এ সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় তা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ চলছে। এছাড়া বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ বাড়াতে গত কিছুদিন আগে দেশটির বড় বড় শহরগুলোতে রোডশো অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘দ্যা রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার্স’ শীর্ষক এই রোডশোগুলো বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশন, ব্রিটিশ বাংলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিবিসিসিআই) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) যৌথ আয়োজনে সম্পন্ন হয়েছে। এসব রোডশোতে শত শত ব্রিটিশ বিনিয়োগকারী ও বিদেশে বসবাসরত নন রেসিডেন্সিয়াল বাংলাদেশি (এনআরবি) শতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়াও বাংলাদেশে বিদেশিদের বিনিয়োগ আকর্ষণে যুক্তরাষ্ট্র, দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন নামী-দামি শহরে রোডশো করা হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে এসব রোডশোগুলোর কোনো ফলোআপ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে যে উদ্দেশ্যে এসব রোডশো আয়োজন করা হচ্ছে তা ব্যাহত হচ্ছে। তাই সরকারি কিংবা বেসরকারি যেভাবেই হোক না কেন- এসব রোডশোর ফলোআপ রাখা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’
বিনিয়োগবার্তা’র সঙ্গে একান্ত আলোচনায় এসব কথা বলেন এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্সের চেয়ারম্যান ইফতি ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিনিয়োগবার্তা’র সম্পাদক শামীম আল মাসুদ। সহযোগিতায় ছিলেন বিনিয়োগবার্তা’র যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি গাজী হুমায়ুন কবির। আর ইংরেজীতে নেওয়া এ সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ করেছেন দেওয়ান ফজলে এলাহী।
নিম্নে এ সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো:
যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে ইফতি ইসলাম বলেন, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমান প্রায় ১.৮ বিলিয়ন পাউন্ডস। এর মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি হল গার্মেন্টসনির্ভর। তবে আমি মনে করি, আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ও ইউকের ব্যবসা-বাণিজ্য তিন গুন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ জন্য শুধু গার্মেন্টস এর উপর নির্ভর করলে চলবে না। বরং বিজনেসকে ডাইভারসিফিকেশন করতে হবে। এখন আমাদের দরকার ইউকে এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটা ‘ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট’ পথ তৈরি করা। এক্ষেত্রে আরও বেশ কিছু খাতকে বেছে নিতে হবে। তাই গার্মেন্টসের পাশাপাশি অনান্য সম্ভাবনাময় খাতকে আমাদের বেছে নিতে হবে। এজন্য উভয় দেশের সরকারকে বিভিন্ন খাতে উইন-উইন অংশিদারিত্বের পথ খুঁজে নিতে হবে।
ইফতি ইসলাম বলেন, আমি মনে করি কৃষি, আইটিসহ অনেক সম্ভাবনাময় খাত আছে-যেসব খাত থেকে দু’দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আরও প্রসারিত করা যেতে পারে। এমনকি আরএমজি খাতে বাংলাদেশি কোম্পানিদের এখানে তাদের কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের নিজস্ব ব্রান্ড প্রতিষ্ঠা করারও সুযোগ রয়েছে। যুক্তরাজ্যের মার্কস এন্ড স্পেন্সার, প্রাইমার্ক, এইচএন্ডএম এবং অন্যান্য বড় খুচরা বিক্রেতারা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের পণ্য বিক্রি করছে। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো ব্রান্ড নাই। তাই গার্মেন্টস কোম্পানিগুলোর এখানে তাদের নিজস্ব ব্রান্ড প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভাবতে হবে।
ইংরেজিতে দেওয়া বক্তব্যে ইফতি ইসলাম বলেন, যুক্তরাজ্য হলো বিশ্বের ৪র্থ বড় অর্থনীতির দেশ। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ইউকের বাজারে অতি সামান্য প্রবেশ করেছে। এখানে বাংলাদেশিদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের একটা বড় সম্ভাবনা আছে। ইউকেতে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। বেক্সিটের কারণে হাজার হাজার শ্রমিক ইউরোপিয় ইউনিয়নে (ইইউ) চলে গেছে। এছাড়া কোভিডের সমস্যার কারণেও এখানে কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। তাই বিভিন্ন খাতে শ্রমিক সরবরাহে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশি বংশদ্ধুপ্ত এই ব্রিটিশ উদ্যোক্তা বলেন, আইসিটি খাতে ইউকেতে বাংলাদেশের জন্য বিলিয়ন ডলারের সুযোগ রয়েছে। তাই আমাদেরকে সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে বাংলাদেশি আইসিটি কোম্পানি ইউকেতে কার্যক্রম শুরু করতে পারে। এক্ষত্রে তারা খুজতে পারে ইউকের টেক কোম্পানিগুলোর সাথে সঠিক অংশীদারিত্ব কিংবা যৌথ মালিকানা। বাংলাদেশ সরকার বা আইসিটি মন্ত্রণালয়ও একটা পরিকল্পনা করতে পারে যাতে আমরা বুঝতে পারি আইসিটি খাতে এখানে কাজ করতে বাংলাদেশি কর্মীদের কি ধরনের দক্ষতা দরকার। এরপর সঠিক অংশীদারকে কিভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। এসব খাতে সম্পৃক্ত ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে জিটুজি বা বিটুবি’র উপর প্রাধান্য দিতে হবে। আমি মনে করি এক্ষেত্রে মূল জিনিস হলো যৌথ মালিকানা (জয়েন্ট ভেঞ্চার)। এখানে বেশি বাংলাদেশি কো্ম্পানি নেই যাদের ইউকে প্রযুক্তি কোম্পানির সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার আছে। একইভাবে ইউকেতে বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশি কর্মীদের আরেকটি বড় সুযোগ রয়েছে। এখানে অভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স কিংবা সোস্যাল কেয়ার ওয়ার্কারের অনেক ঘাটতি আছে। তাই বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য এ খাতেও কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশি শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যে না যেয়ে তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষন দিয়ে ইউকের এই খালি জায়গাটা পূরন করা যায়। এছাড়া ইউকেতে লরি চালকের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। এখানকার ইউকের লরি চালকেরা বছরে প্রায় ৪০/৫০ হাজার পাউন্ড আয় করছে। এছাড়া ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বারস, প্রতিটি খাতেই দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি প্রকট। কারণ, রোমানিয়ান লোকেরা এসব কাজ করতো। বেক্সিটের পর এখন তারা নিজ দেশে ফেরত চলে যাচ্ছে। এই জন্যই বাংলাদেশি শ্রমিকদের এসব জায়গা পূরণের বড় সুযোগ রয়েছে। আরেকটি খাত হলো রেস্টুরেন্ট খাত। এ খাতে বাংলাদেশের প্রচুর পরিমানে শ্রমিক এখানে কাজ করছে। এখন বাংলাদেশের যা করা দরকার তাহলো- দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিল সৃষ্টি করা। এজন্য সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা বা সংগঠনগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদেরকে আগে বুঝতে হবে যুক্তরাজ্যে কোন ধরনের শ্রমিকের চাহিদা আছে। সুনির্দিষ্ট খাতে, সুনির্দিষ্ট চাকরিতে চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশে শ্রমিকদের টেকনিক্যালি প্রশিক্ষিত করতে হবে। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা সৃষ্টি করে এবং ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা দিয়ে তাদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। তখন আমি মনে করি যে, ইউকেতে স্কিল গ্যাপ পূরণ করা যাবে, যা বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ।
ইফতি ইসলাম বলেন, আমরা ব্রিটিশ বাংলা চেম্বার এবং বিবিসির সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছি। গত কিছুদিন আগে কৃষিমন্ত্রী ড: রাজ্জাক ইউকেতে এসেছিলেন। তখন একটা সেমিনারে আমি বলেছিলাম যে, ইউকেতে সাপ্লাই ক্রাইসিস/সাপ্লাই চেইন ক্রাইসিস আছে, অনেক ফল এবং সবজির ঘাটতি আছে, শ্রমিকের ঘাটতি আছে। যেখানে বাংলাদেশ পারে এসব ঘাটতি মেটাতে। বাংলাদেশিরা যদি এখানে আন্তর্জাতিক মানের খাবার দিতে পারে, রপ্তানিযোগ্য খাবার দিতে পারে, তবে পরবর্তিতে আমাদের জন্য সঠিক জায়গা হবে যুক্তরাজ্য।
ইফতি ইসলাম বলেন, মজার ব্যাপার হলো ১৫০০০ ব্রিটিশ বাংলাদেশি ইউকেতে রেস্টুরেন্টের মালিক আছে। অথচ, তাদের ব্যবহৃত ৯৯ শতাংশ কাঁচামাল আনা হয় ভারত থেকে। আমি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট মালিক এবং পাইকারি বিক্রেতাদের সাথে কথা বলেছি। তারা বাংলাদেশি কৃষিপণ্য পছন্দ করে কিন্তু তারা মনে করে বাংলাদেশি কৃষি পণ্যগুলো মানসম্মত নয়। এক্ষেত্রে হয়তো তাদের খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। তাই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা বাংলাদেশ থেকে মানসম্মত রপ্তানিযোগ্য পন্য তাদেরকে দিচ্ছি। বাংলাদেশি খাদ্যদ্রব্য নিয়ে এই বিরূপ ধারনা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাদের সঠিক রপ্তানি মান/সঠিক রপ্তানি মোড়ক তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, আপনারা জেনে থাকবেন যে, বাংলাদেশের অনেক বড় কোম্পানি যেমন- স্কয়ার, প্রান, পারটেক্স গ্রুপ এবং অনান্য বেশ কিছু কোম্পানি এখানে কৃষি বা খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি করে। কিন্তু তারা প্রয়োজনীয় ব্র্যান্ডিংয়ের উপর প্রাধান্য দেয় না। তাই বাংলাদেশিদের এখানে ভারতের পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতার জন্য নতুন মোড়ক এবং ব্র্যান্ডিং শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে ডিজিটাল মার্কেটিং বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন- ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব বা ইন্সটাগ্রামকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া অনলাইন মিডিয়াগুলোও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ প্রসঙ্গে এটিসিপির এই চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও ব্রিটিশ ফান্ডগুলোর বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়া এখানকার এনআরবিরাও (নন রেসিন্ডেশিয়াল বাংলাদেশি) দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু সেজন্য পুঁজিবাজারকে ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগযোগ্য ফান্ডের তুলনায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সাইজ খুবই ছোট। তাই পুঁজিবাজারে ভাল ভাল কোম্পানিকে তালিকাভূক্ত করতে হবে। যেসব কোম্পানির পণ্যগুলো সম্পর্কে বিদেশিরা চিনেন বা জানেন সেসব কোম্পানিকে তালিকাভূক্ত করতে হবে।
তিনি বলেন, গত নভেম্বর মাসের ৫ তারিখে লন্ডনে ‘দ্যা রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার্স’ শীর্ষক রোডশোতে একটা প্রেজেন্টেশনে আমি মূলবক্তব্য দিয়েছিলাম। এছাড়া একই ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশেও এফবিসিসিআই’র এক অনুষ্ঠানে দিয়েছিলাম। তখন আমি এ বিষয়গুলোকে আরও সুন্দর ও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু প্রেজেন্টেশনে তুলে ধরা সুপারিশগুলো তেমনভাবে কেউ ফলোআপ দিচ্ছে না। এছাড়া এসব রোডশোগুলোর প্রয়োজনীয় ফলোআপ থাকার দরকার ছিল। কিন্তু দু:খজনক হলো- এসব রোডশোগুলো ব্যাপক আয়োজন করে করা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারিভাবে এগুলোর কোনো ফলোআপ নাই। অথচ, দেশে বিদেশি বা এনআরবিদের বিনিয়োগ টানতে রোডশোগুলোর সঠিক ফলোআপের কোনো বিকল্প নাই।
ইফতি ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের জন্য সামনে অনেক বড় সুযোগ আছে। কিন্তু প্রয়োজন গ্রেটেস্ট স্ট্রাটেজিক ফোকাস। আমাদের দরকার স্ট্রাটেজিক রোড ম্যাপ এন্ড প্লান। আমরা কিভাবে সরকার- প্রাইভেট সেক্টর এবং অভিজ্ঞদের সাথে একসাথে কাজ করতে পারি এবং উভয়ের স্বার্থে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারি-তা আমাদেরকেই নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেটের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ইফতি ইসলাম বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রনে রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত কমিশন বিএসইসি খুবই প্রো-একটিভ এবং খুবই ডায়নামিক।কমিশনের চেয়ারম্যান এবং কমিশনাররা প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়মিত আইন-কানুন ও বিধি-বিধান করছেন। একইসঙ্গে তা পরিপালনে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। একইসঙ্গে তারা মার্কেটের কারসাজি বন্ধে খুবই প্রো-একটিভ। কিন্তু যদি বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেটের ভবিষ্যত উন্নতির কথা বলা হয়, তবে আমি বলবো আমরা এখনও অনুন্নত ক্যাপিটাল মার্কেট। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ মাত্র ৩ শতাংশ। ভারতের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ৩০ শতাংশ, এমনকি পাকিস্তানে ১০ শতাংশ, শ্রীলংকায় ৪০ শতাংশ। তবে এ অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের একটি পরিস্কার স্ট্রাটেজি থাকতে হবে।
তিনি বলেন, কিভাবে ক্যাপিটাল মার্কেটে আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায়- তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এজন্য দরকার যথাযথ ব্রান্ডিং। আমাদের বাংলাদেশ মার্কেটে আন্তর্জাতিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের সাথে সংযুক্ত হতে হবে। আমাদের থাকতে হবে অনেক বিনিয়োগযোগ্য পণ্যের যোগান। আমাদেরকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। বাংলাদেশে কনফারেন্স আয়োজন করতে হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরকে দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগযোগ্য পণ্যের বিষয়ে অবগত করতে হবে। তবেই তারা বিনিয়োগ করবে। বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে পর্যাপ্ত যোগান নেই, তাই যোগানের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেটের আরেকটা উদ্যোগ নিতে হবে যোগান/সাপ্লাই বাড়ানোর জন্য, এজন্য আরও কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হবে, বছরে মাত্র ১২-১৪টি কোম্পানির তালিকাভুক্তি যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে অনেক কোম্পানি বলবে যে, তাদের অর্থের প্রয়োজন নাই। কিন্তু শুধু মূলধন সংগ্রহের জন্যই নয় বরং দেশের পুঁজিবাজারকে সমৃদ্ধ করার জন্য হলেও তাদেরকে বাজারে তালিকাভূক্ত করতেই হবে। আপনি দেখেন, রিলায়েন্স বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি। তারাও তালিকাভুক্ত হয়েছে। মুকেশ আম্বানী হলেন এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি তারপরও তার কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। যদি তালিকাভুক্ত না হওয়া সঠিক পদ্ধতি হতো তবে তিনি তা করতেন না। তেমিনভাবে এ্যাপল, গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, টেসলার মত সব বড় বড় কোম্পানিগুলো কিন্তু তালিকাভুক্ত কোম্পানি। এ্যাপল, গুগল এবং মাইক্রোসফটের বাংলাদেশের জিডিপির চেয়ে বেশি নগদ টাকা আছে। কিন্তু তারপরেও তারা তালিকাভুক্ত। কিন্তু আমাদের এখানে ঠিক তার উল্টো চিত্র। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদেরকে দেশের উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে।
তিনি বলেন. আমি মনে করি, বাংলাদেশের জন্য পরবর্তী বড় পদক্ষেপ হবে গ্লোবালাইজেশন অব কোম্পানি অব বাংলাদেশ, যা ভারতে হয়েছে ২০/৫০ বছর আগেই। বেশি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়াটাই হলো গ্লোবালাইজেশন অব কোম্পানি অব বাংলাদেশের সাথে লিংকড।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো ইউকেতে ফান্ড রেইজ করতে পারে। গত নভেম্বরের ১৫ তারিখে বিএসইসি ও ডিএসইর কর্মকর্তাদের নিয়ে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে একটা মিটিং হয়েছিল, তখন আমরা আলোচনা করেছিলাম যে, কিভাবে বাংলাদেশি কোম্পানি ইউকেতে কিংবা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে অর্থ্ উত্তোলন করতে পারে। তখন আমরা ঐকমত্যে পৌছেছিলাম যে, বাংলাদেশি কোম্পানিকে লন্ডন এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হতে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। এ বিষয়েও তেমন কোনো ফলো আপ চোখে পড়ছে না। আরেকটি বিষয় হল বাংলাদেশি ক্যাপিটাল মার্কেটকে আরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। যেমন- চীনে স্টক মার্কেটে ১৬০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী আছে, যা প্রায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার সমান। ১.৩৫ বিলিয়ন জনসংখ্যা চীনের। এর অর্থ্ আপনি যদি জনসংখ্যার অনুপাত হিসাব করেন তবে বাংলাদেশে ২০ মিলিয়ন বিও একাইন্ট থাকার কথা, ২ মিলিয়ন নয়। কিন্তু আমাদের এখানে তা নাই। কারন, আমরা প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার করছি না। সেখানেও আমাদের একটা বড় সুযোগ রয়েছে। চীনে সবাই ট্রেড করে মোবাইলে। তাই আমাদেরকে আরও দ্রুত গতিতে বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেটকে প্রযুক্তির আওতায়/ডিজিটালাইজেশনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ক্রমান্বয়ে কৃষকরা এবং রিক্সা চালকরা যেন সহজে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পারে। ইউকেতে বহু মানুষ প্রতি মাসে অন্তত ১০ পাউন্ড করে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করে। তাই আমাদেরকে ঐ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে যেন মানুষ বিকাশ, নগদ বা ব্যাংকের মাধ্যমে সহজেই পূঁজিবাজারে বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারে।
ইফতি ইসলাম বলেন, কোভিডের সময় আমাদের পুঁজিবাজার ২০২০ সালে ২ মাসের জন্য বন্ধ ছিল, অথচ উন্নত দেশে তা ছিল না। পৃথিবীতে আমাদের পুঁজিবাজারই একমাত্র ২ মাসের জন্য বন্ধ ছিল, কারন আমাদের প্রযুক্তির ঘাটতি আছে। অথচ, চীনে, আমেরিকায় এবং সারাবিশ্বে ওই সময় উল্লেখযোগ্য লেনদেন হয়েছে। এর অন্যতম কারন প্রযুক্তি। আমরা পুঁজিবাজারে প্রযুক্তির যথেষ্ট ব্যবহার করছি না। আমরা ধীর গতিতে এগুচ্ছি, আমাদের দ্রুত গতিতে এগুতে হবে। এজন্য প্রযুক্তিনির্ভর পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের ১০ মিলিয়ন এনআরবি আছে। অথচ, তারা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করে না। কেন নয়, আমাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের প্রক্রিয়াটা আরও সহজ করতে হবে। আমাদের একটা কান্ট্রি ফান্ড তৈরি করতে হবে ডলার বা পাউন্ডে; তা এনআরবিদের মধ্যে বাজারজাত করতে হবে, আমাদের পরিচিতিতেও ঘাটতি আছে, বিনিয়োগে সহজীকরনে ঘাটতি আছে। এনআরবিদের নিয়ে বেশি বেশি রোড শো করতে হবে, পাশাপাশি এগুলোর ফলো আপ করতে হবে। কিভাবে পুঁজিবাজারে আরও বেশি এনআরবি আনা যায়- তার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করতে হবে। অনেকেই মনে করে যে, স্টক মার্কেট হলো জুয়ার মত, কিন্তু আসলে তা নয়। পুঁজিবাজার হলো যাদের অতিরিক্ত আয় আছে এবং যাদের মূলধন দরকার তাদের মধ্যে একটা সেতু, এটা কোন গুজবের জায়গা নয়। আমাদেরকে এই মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে এবং বিনিয়োগকারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম/জিএইচকে/ডিএফই/ //