Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Saturday, 19 Nov 2022 06:00
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়

ড: মিহির কুমার রায়: এখন চলছে হেমন্ত কাল (কার্তিক-অগ্রহায়ন) যদিও অবশ্য  আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ফসলের ঋতু হেমন্ত। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রকৃতিতে এখন হেমন্ত যখন দুপুরে রোদের তেজ কমে ধীর পায়ে বিকালের পথ ধরে সন্ধ্য নামে। আমাদের শৈশবে গ্রাম বাংলায় আমরা দেখেছি উত্তর থেকে ঝিরিঝিরি বাতাসের বয়া শুরু করে এ সময়, কাক ভোরে এবং বিকালের পর বাতাসে হিমহিম ভাব, সন্ধ্যার পরেই একটা নির্জীব ছায়ার মতো রঙ ঘিরে ফেলে, পাতায় জমা ধুলোর মতো চার পাশটা মলিন ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়, ভেজা একটা কুয়াশা-চাদর, প্রকৃতি ও মনকে জড়িয়ে ধরে নিবিড়ভাবে।  প্রকৃতিতে বিষন্ন সুন্দরের একটি রূপ দৃশ্যমান হয় হেমন্তের শুরুতে যেন কিছুটা নিবিড় অরণ্যের  ভেতর অন্ধকার হয়ে আসা ভালো লাগার একটি পরিবেশ। হেমন্তের প্রথম মাস অর্থাৎ কার্তিকের প্রথম দিন নতুন ঋতুকে স্বাগত জানানো  হয় যদিও এক সময় মরা কার্তিকে এসে কৃষকের গোলা শূন্য হয়ে যেত সবাই তখন তাকিয়ে থাকত অগ্রহায়ণের দিকে, তবে যতদিন গেছে  ততই বদলে গেছে হিসাব-নিকাশ, কার্তিক আর আগের মতো নেই। এ মাসেও পাওয়া যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধান। বস্তুত  শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে এখন মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন কৃষক আর বিভিন্ন ফসল ফলান তারা, আয় রোজগারও ভালো। কার্তিক মাসে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ, পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের  বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব যাকে এক কথায় বলা হয় নবান্ন উৎসব হলো  বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব। একেবারে অনাদি কাল ধরে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে একই রীতি মেনে দেশ জুড়ে গ্রামের মতো নগরে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে। এবার ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নাগরিক নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে এবং দিনব্যাপী আয়োজনে লোকায়ত জীবন ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জয়গান করা হয়েছে যার সাথে আহ্বান জানানো হয় উৎপাদন বাড়ানোর। মঞ্চ সজ্জায় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে লোক চেতনাকে সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রামীণ নানা অনুষঙ্গ, উৎসব মঞ্চ থেকে নাচ গান কবিতা ও কথায় নবান্ন উৎসবের ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। ফসলকেন্দ্রিক অর্থনীতির চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, জয়গান করা হয়েছে কৃষকের। আয়োজন সম্পর্কে কর্মকর্তারা বলেন বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ অথচ  ভয়ংকরভাবে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে, ফসলের জমি নষ্ট করে অট্টালিকা হচ্ছে, দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কমছে উৎপাদন। বর্তমান পরিস্থিতিতে উৎসব মঞ্চ থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। আজকের প্রজন্ম আমাদের মৌলিক সংস্কৃতি ও ফসলকেন্দ্রিক উৎসবগুলো সম্পর্কে জানে না। জানানোর দায় থেকেও এবারও নবান্ন উৎসবের আয়োজন তাৎপর্যপূর্ণ।

বর্তমানে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট চলছে এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই এবং উৎপাদন বাড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়ে এবার উৎযাপিত হচ্ছে নবান্ন উৎসব ১৪২৯। অগ্রহায়ণ মানেই আমন ধান কাটার মাস, ফলন ও উৎপাদনে আমন বোরোর চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও প্রতি বছর এর উৎপাদন বাড়ছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, ২০২০ সালে আমনের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ টন, যা মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ। এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে বিধায় নবান্ন উৎসব তাই যথারীতি আনন্দঘন  হচ্ছে যা ফলন বাড়িয়ে আনন্দকে আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা হবে বলেও প্রত্যাশা।

নবান্ন মানে নতুন অন্ন অর্থ্যাৎ নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন  ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার হাজার বছর আগে কৃষিপ্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয়, তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উৎযাপন হয়ে আসছে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো, ফসল কাটার আগে কৃষকরা বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখতেন, বাকি ধান থেকে চাল করে সে চালে পায়েস করা হতো। এছাড়াও নবান্ন উৎসবের দিন গৃহস্থ বাড়িতে নানা পদ রান্না হতো যেমন শাক, ভর্তা, ভাজিসহ কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি রান্না করা হতো কোনো কোনো বাড়িতে। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ হয়। হিন্দুরা নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করেন, পার্বণ বিধি অনুযায়ী হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। শাস্ত্র মতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়, কে চায় অমন পাপ করতে! অমুসলিম রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে। আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন, নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। অন্য একটি আচার অনুযায়ী, বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়, তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়, এর পর গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়, সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে বাঁধা হয় ধানের ছড়া। নবান্ন উৎসবে কাক বলী, লক্ষ্মী পূজা, পিতৃ শ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন বিধায় এর আগে কেউ কিছু মুখে নেন না। রাজধানী শহর ঢাকায় ২০ বছরের  বেশি সময় ধরে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। বেশ ঘটা করে বর্ণিল এ উৎসবের আয়োজন করা হয়, শহুরে  শেকড় সন্ধানী সংস্কৃতি কর্মীরা লোক আঙ্গিকের গান নাচ ইত্যাদি পরিবেশনের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন, চলে খৈ মুড়ি পিঠা পুলির আয়োজনও।

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ নানাভাবে নবান্নের মাস হেমন্তকে কবিতার ফ্রেমে প্রতিবিম্বিত করেছেন এক অনন্য রূপকল্প আর স্বপ্ন ও বাস্তব জগতের বিচিত্র বর্ণের রূপে। কবিতার মাধ্যমে জীবনানন্দ যে ছবি এঁকেছেন সে ছবি বাঙালি হৃদয়ে নব রূপে আবেগ, অনুভূতি এবং আবেদন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। একটি বিষয় ভেবে অবাক হই, গণ মানুষের কবি, মানুষে মানুষে বৈষম্য দেখে যিনি কাতর হতেন সেই কিশোর কবি সুকান্তও হেমন্তের মোহে আবিষ্ট হয়েছিলেন। তার ‘এই নবান্নে’ পড়ে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। আমরা যদি সত্যিকারভাবে দেশপ্রেমিক হই তাহলে আমাদের প্রকৃতি প্রেমিকও হতে হবে যা বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর তার নবন্নের মাস হেমন্তের গানে, কবিতায়, উপন্যাসে বর্ণানা করে গেছেন অনেক দিন আগে যা এখনও আমাদের পথ প্রদর্শক হয়ে রয়েছে।
 
আসুন আমরা সকলে মিলে বাংলার আবহমান সংস্কৃতিকে রক্ষা করে একটি অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ে তুলি যা হবে বঙ্গবন্ধুর  আসল সোনার বাংলা এবং নবান্নের উৎসবে সেটাই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।

লেখক: গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।