নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউজ বানকো সিকিউরিটিজের (ট্রেক- ৬৩) পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে নগদ ৬৬ কোটি ৬০ লাখ ও শেয়ার বিক্রি করে আরও ৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। নগদ টাকা ও শেয়ার বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা প্রায় ১২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অভিযোগটি ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক আদালতে দায়েরকৃত মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
তবে ব্রোকারেজ হাউজটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক দিক বিবেচনা করে বানকো সিকিউরিটিজের সাত জন পরিচালককে মোট সাত কোটি অর্থদণ্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা ও সিকিউরিটিজ বিধি-বিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগে সম্প্রতি কমিশন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
অর্থদণ্ডিত ব্যক্তিরা হলেন- বানকো সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামিউল ইসলাম, পরিচালক মো. শফিউল আজম, পরিচালক ওয়ালিউল হাসান চৌধুরী, পরিচালক নুরুল ঈশান সাদাত, পরিচালক এ. মুনিম চৌধুরী ও পরিচালক জামিল আহমেদ চৌধুরী। তাদের প্রত্যেককে এক কোটি টাকা করে মোট সাত কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করে হয়েছে।
বিএসইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জানা গেছে, সিকিউরিটিজ বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা করার দায়ে বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের প্রত্যেক পরিচালককে এক কোটি টাকা করে জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ অর্থদণ্ড পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানটির প্রত্যেক পরিচালককে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে আরও জরিমানা গুনতে হবে। এ ছাড়া, আদালতে চলমান উল্লিখিত মামলার অগ্রগতি জানতে দুদকে চিঠি পাঠানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
তবে ব্রোকারেজ হাউজটির সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে (সিসিএ) ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৯ কোটি ১৩৩ টাকা ঘাটতির বিষয়টি নিয়ে দুদক কর্তৃক আদালতে দায়েরকৃত মামলা চলমান থাকায় বিষয়টি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
তথ্য মতে, বিপুল পরিমাণ অর্থ ও শেয়ার আত্মসাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানকো সিকিউরিটিজ ও এর ৭ পরিচালকের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৪ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর মতিঝিল থানায় অভিযোগ দায়ের করে ডিএসই। ডিএসই প্রতারণামূলক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ৪০৬ ও ৪০৯ ধারায় অভিযোগ এনেছে। পরেরদিন মঙ্গলবার (১৫ জুন) সকালে মতিঝিল থানা অভিযোগটি দুদকে প্রেরণ করে।
ডিএসইর পক্ষে দায়ের করা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালের ৬ মে ও ৬ জুন বানকো সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে শেয়ারের লেনদেন নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী গত ৭ জুন কোম্পানিটিতে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে ডিএসই। ওই সময় ব্রোকারেজ হাউজটির সম্মিলিত গ্রাহক অ্যাকাউন্টে গত ৬ জুনের হিসাবে ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৯ হাজার ১৩৩ টাকার ঘাটতি পায় ডিএসই। ফলে তাৎক্ষণিক ডিএসই কোম্পানির কাছ থেকে ওই সম্মিলিত গ্রাহক অ্যাকাউন্টের ঘাটতির ‘গ্রাহকের পরিশোধযোগ্য সমন্বয়সাধন বিবরণ’ গ্রহণ করে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, বানকো সিকিউরিটিজ ও তাদের মালিকপক্ষ বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ও শেয়ার আত্মসাৎ করেছে। আর এ অর্থ সমন্বয় না করেই তাদের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোম্পানিটির এমন কর্মকাণ্ড শেয়ারবাজারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীকে তাহাদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস ভঙ্গ করে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে বানকো সিকিউরিটিজের পরিচালক ও কর্মকর্তা/কর্মচারীরা অপরাধ করেছেন। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ও শেয়ারবাজারের শৃঙ্খলার রক্ষায় ডিএসই বানকো সিকিউরিটিজসহ কোম্পানিটির চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামিউল ইসলাম, পরিচালক মো. শফিউল আজম, পরিচালক ওয়ালিউল হাসান চৌধুরী, পরিচালক নুরুল ঈশান সাদাত, পরিচালক এ. মুনিম চৌধুরী ও পরিচালক জামিল আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪০৯ ধারায় প্রতারণামূলক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অপরাধ করার অভিযোগ আনে।
এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পলাতক বানকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল মুহিতকে ২৯ জুলাই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে। পরে ৩০ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আতিকুল আলম আসামিকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডিএসইর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ জুলাই বানকো সিকিউরিটিজের পরিচালকদের সংশ্লিষ্ট ১০ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে সেগুলো হলো- বানকো সিকিউরিটিজ, বানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, সুব্রা সিস্টেমস, সুব্রা ফ্যাশনস, বানকো পাওয়ার, বানকো এনার্জি জেনারেশন, বানকো স্মার্ট সল্যুশন, ক্লাসিক ফুড ল্যাব, অ্যামুলেট ফার্মাসিউটিক্যালস ও সামিট প্রপার্টিজ লিমিটেড।
অর্থ আত্মসাতের ঘটনার পর থেকে দুই বছর অতিবাহিত হলেও বানকো সিকিউরিটিজের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যে লিঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অন্য ব্রোকারেজ হাউজে শেয়ার স্থানান্তর করে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে যেসব বিনিয়োগকারীদের নগদ টাকা এবং শেয়ার বিক্রির টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে তারা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, বানকো সিকিউরিটিজে আমার বিও অ্যাকাউন্ট ছিল। অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় আমাকেও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ৬৬ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি পাওয়া গেছিল। ডিএসই যদি সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিতো, তাহলে বিনিয়োগকারীদের এমন দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
বিনিয়োগবার্তা/এমআর//