নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈশ্বিক কারণ, অর্থ ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন ও ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে চলতি বাজেটে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুরুতেই মন্ত্রণালয়গুলোকে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। এর প্রভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্ব ‘২৩) মোট বাজেটের মাত্র ২৬ শতাংশ ব্যয় হয়। টাকার অঙ্কে তা ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৪৫ কোটি। একই সময়ে অর্থ সংগ্রহ অর্থাৎ রাজস্ব আহরণও খুব বেশি হয়নি। আয় কম হওয়ায় বেশি ব্যয়ও সম্ভব হচ্ছে না।
অপরদিকে, বিদেশি ঋণও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পাওয়া গেছে মাত্র ১০ শতাংশ। ঋণ সংগ্রহে বেশি সাড়া মিলছে না। যে কারণে সরকারের আয় ও ব্যয়ে এক ধরনের ধীরগতি বিরাজ করছে। অর্থ বিভাগের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
কৃচ্ছ সাধনের কারণে চলতি বাজেটে মোট ব্যয়ের মধ্যে ১৫ শতাংশ কম হবে এমন আভাস আগেই দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ আভাস দিয়েছেন তিনি।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে। চলতি হিসাবের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এতে আমদানির প্রবৃদ্ধি বিগত অর্থবছরের তুলনায় কমেছে ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বর্তমান ডলার সংকটের কারণে বিলাসী দ্রব্য আমদানি পরিহার এবং মিতব্যয়ের কারণে এ খাতে খরচ হ্রাস পেয়েছে।
এদিকে গত তিন বাজেটের প্রথম ৬ মাসের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টাকা ব্যয়ের হার সবচেয়ে কম চলতি বাজেটে। একই সময়ে গত বাজেট (২০২২-২৩) বাস্তবায়ন হার ছিল ২৭ শতাংশ এবং রাজস্ব আহরণ ৩৮ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর (২০২১-২২) বাস্তবায়ন হার ২৮ শতাংশ এবং রাজস্ব আদায় ৪২ শতাংশ। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ৬ মাসে বাস্তবায়ন হার ২৭ শতাংশ এবং রাজস্ব আদায় ৩৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, এটি দীর্ঘদিনের পুরোনো সমস্যা। প্রথমদিকে টাকা ব্যয় কম হয়। শেষদিকে টাকা খরচের হিড়িক পড়ে। আর তখনই কাজের এবং অর্থ ব্যয়ের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠে। আমি মনে করে অর্থ ব্যয়ের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এর জন্য জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। না হলে একই সমস্যা প্রতিবছরই ঘটবে। কেন তারা প্রথম ৬ মাসে অর্থ ব্যয় করতে পারে না, শেষদিকে কেন ব্যয় বাড়িয়ে দেয় তার জবাব নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্রমতে, এ বছর রাজস্ব আহরণ নিয়ে খুব চাপের মধ্যে আছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। বিগত তিন অর্থবছরের তুলনায় মোট বাজেটের অনুপাতে আদায় হার কম। এনবিআর কর ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রথম ৬ মাসে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা আদায় হয়। এটি মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ৩৬ শতাংশ।
এনবিআরবহির্ভূত কর বাজেটে ২০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৬ মাসে ৩ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা মাত্র আদায় করতে পেরেছে এনবিআর। আদায় কম প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের পর্যালোচনায় বলা হয়, এমনিতে ডলার সংকটে এলসি খোলার জটিলতা পণ্য আমদানি খাতকে সংকুচিত করেছে।
অপরদিকে বিগত কয়েক মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলছে রপ্তানি কার্যক্রমের ওপর। অবরোধসহ নানা কর্মসূচির কারণে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় অনেকটা স্থবিরতা নেমে আসে। ফলে এসব খাত থেকে কমেছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আদায়। যে কারণে রাজস্ব আদায় ভালো থাকলেও দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কমে আসে।
এদিকে সরকার পরিচালনা খাতে অর্থবছরের ৬ মাসে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। এটি মোট ব্যয়ের ৩৩ শতাংশ। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা খাতে বেশি ব্যয় হয়েছে। অপরদিকে মূলধনী খাতে ব্যয় কম করা হয়। এছাড়া উন্নয়ন খাতে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা থাকলেও প্রথম ৬ মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪৩ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা।
বাজেটের টাকা কম ব্যয় হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। ভোট ঘিরে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতাও। যে কারণে মন্ত্রণালয়গুলো টাকা খরচ কম করেছে।
এছাড়া অর্থবছরের শুরুতেই কৃচ্ছ সাধনের কারণ হিসাবে জ্বালানি খরচ, বিদেশ ভ্রমণ, জমি অধিগ্রহণ, সরকারি ভবন নির্মাণ, গাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন ব্যয় খাতের ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। এসব কারণে বিগত ৩ অর্থবছরের তুলনায় এবার বাজেট বাস্তবায়নের হার কম।
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//