Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Friday, 31 May 2024 01:00
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়

ড: মিহির কুমার রায়: আমি প্রথমে কুমিল্লা একাডেমী যা বর্তমানে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) নামে বহুল পরিচিত সেখানে যাই উনিশ শত চোয়াত্তোর (১৯৭৪) সালে একাডেমিক শিক্ষা সফরের অংশ হিসাবে যখন আমি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপনী বর্ষে কৃষি অর্থনীতি অনুষদের ছাত্র। ময়মনসিংহ রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে রাত্রি তিনটার বাহদুরাবাদ - চট্রগ্রাম লাইনের মেইল ট্রেন ধরে পরের দিন দুপুর দেড়টায় কুমিল্লা রেলওয়ে ষ্টেশনে পৌছালাম। তার  পর রিক্সায় উঠার পালা এবং দেখলাম প্রতিটি রিক্সার পিছনে লেখা সমবায় সমিতির নাম যেমন শুকতারা  কৃষক সমবায় সমিতি লি:, দিশাবন্ধ কৃষক সমবায় সমিতি লি: ইত্যাদি। মনে হলো যেন সমবায় এর দেশে এসে  পৌছালাম এবং প্রতিটি রিক্সার মালিকানা রয়েছে সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধনকৃত কৃষক সমবায় সমিতির। 

একটি রিক্সা চড়ে বসলাম যা ছিল চাঙ্গীনি কৃষক সমবায় সমিতি লিঃ এর লাইসেন্সধারী একটি রিক্সা। কুমিল্লা রেলওয়ে ষ্টেশন  থেকে বেড়িয়ে ষ্টেশন রোড ধরে ঝাউতলা হয়ে বাদুর তলা পেড়িয়ে কান্দির পাড় পৌছালাম। যেখান থেকে কোটবাড়িতে অবস্থিত বার্ড যা প্রশাসনিকভাবে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের অবস্থিত ছিল সেখানে যাব। কুমিল্লা  রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে কান্দিরপার পর্যন্ত যা অবলোকন করলাম তা সে সময়কার একটি মফস্বল  শহরেরই প্রতিচ্ছবি যদিও ঐতিহাসিকভাবে কুমিল্লাকে বলা হয় ব্যাংক ও টাকার শহর এিপুরা রাজাদের স্থাপনার শহর যেখানে রয়েছে রানী কুঠীর, ধর্ম্ম সাগড় ও ময়নামতির পাহাড়। যদিও ত্রিপুরা মহারাজাদের সংস্কৃতিক চর্চার বলয় তৈরি হয়েছিল তদানীন্তন ত্রিপুরা জেলার  ছোট শহর কুমিল্লাকে ঘিরে যা উনিশশত সাতচল্লিশের দেশ বিভক্তির পর উনিশশত তেপান্ন সালে পূর্ন্যাঙ্গ জেলার স্বীকৃতি পায়। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সদস্য শচীন দেব বর্ম্মন উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ঠ সংগীতগ্য যার শৈশব কেটেছে কুমিল্লা শহরের  দক্ষিন চর্তায় তার নিজ বাড়ীতে যা বর্তমানে সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগের আওতায় সংরক্ষিত আছে। কান্দির পার পৌছার আগমূহূর্তে দেখলাম দীপিকা সিনেমা হল, কুমিল্লা খাদির ঘর, তৃপ্তি হিন্দু হোটেল, টাউন হলের মাঠ ইত্যাদি। আমার গন্তব্যস্থল বার্ড যা কান্দির পার থেকে প্রায় তিন কিলোমিটারের পথ আর বাহক হলো তিন চাকার স্কুটার মাত্র আট আনা ভাড়ায় কোটবাড়ি বাসষ্টান্ড পৌছাবে। কান্দির পাড় থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর হাতের বাম দিকে দেখলাম ঈশ্বর পাঠশালা যা নিজের স্বকীয়তা নিয়ে দাড়িয়ে আছে বিশাল জমির উপর যা তখনকার সময়ের নৈতিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিল। সামনে এগুতেই বাকে থমসম ব্রিজ ডানে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাস তারপর দৌলতপুর পেড়িয়ে সেই গ্রাম বলরামপুর কাশীনাথ পুর যেখানে দিদার সমবায় সমিতি লি: এর কার্য্যালয় যা ছিল তখনকার সময়ের এই অঞ্চলের সবচেয়ে স্বনামধন্য সমবায় সমিতি যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মোঃ ইয়াছিন (বর্তমানে প্রয়াত)। চলার পথে রাস্তাটি ছিল আকাবাকা কিছু দুর গেলেই তালগাছ তার পর হাতের ডান দিকে হালিমা টেক্সটাইল মিলের বিশাল স্থাপনা, সামনে চাঙ্গীনি গ্রামের বাকে হাতের ডান দিকে নিচু বিলের জমি যেখানে প্রকৃতিকভাবেই জল, জলজ উদ্ভিদ, প্রানী, পাখির বিচরনের ক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত। তার থেকে কিছু দুর আগাতে চোখে পড়ে গন্দমতী গ্রাম, সরকারী ল্যাবরেটরী হাই স্কুল, শিক্ষক প্রশিক্ষন কলেজ, পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট তার পরপরই বার্ড ক্যাম্পাস যেখানে আমার স্থায়ী গন্তব্যস্থল। বার্ডে প্রবেশ করেই মনে হলো সেটি একটি ভিন্ন বাংলাদেশ যেমন তার স্থাপত্ত্ব শৈলী তেমনই হোস্টেল, ক্যাফেটারিয়া ব্যাপস্থাপনা, গাছগাছালি, ছোট ছোট টিলা। পরিবেশ প্রাকৃতিক নিরব নিস্তদ্ধ ফলজ গাছের বাগান ও ফুলের সমারোহ। প্রবেশ করেই হোস্টেল আাশ্রয় নিলাম এবং আমাদের গাইড সকলকে জানিয়ে দিল প্রতিষ্ঠানের নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে। রাতের খাওয়া ক্যাফেটারিয়াতে লাইনে দাড়িয়ে টোকেন পদ্ধতিতে নারী পুরুষের ভিন্ন লাইন, খাওয়ার ম্যেনুতে নিরামিশ আমিশে মিশে এবং মান তথা পুষ্টির এক সমন্বয় যা এর আগে চোখে পড়েনি। খাওয়া শেষে কিছু হাটাহাটি তারপর নিদ্রা গমন। পরের দিন সকালে লাইনে দাড়িয়ে ক্যাফেটারিয়াতে আবার প্রাতরাশ যা নিয়ম শৃঙ্খলার এক অপূর্ব নিদর্শন বলে মনে হয়েছিল। 

আমাদের গাইড জানিয়ে দিয়েছিলেন কর্মসুচির কথা এবং সেই অনুসারে অডিটরিয়ামে শুরু হয় স্ব স্ব পরিচিতি ও বার্ড পরিচিতির পর্ব যা থেকে উঠে আসে এই প্রতিষ্ঠানটির অতীত ইতিহাস। এক আইসি এস কর্মকর্তার হাত ধরে এই  প্রতিষ্ঠানটির কাজ শুরু হয় কুমিল্লা শহরের অদুর অভয় আশ্রম এলাকায় উনিশশত আটান্নো (১৯৫৮) সালে। সেই কর্মকর্তার নাম আখতার হামিদ খান যিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজ বিজ্ঞানী কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন পদ্ধতির প্রবর্তক ও বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক যার জীবনকাল ১৯১৪-১৯৯৯ইং পর্যন্ত। জনাব খানের জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রা জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে, ১৯৩৪ সালে আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ, একই বছরে ব্রিটিশ ভারতের সর্বোচ্চ চাকুরী ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) অফিসার হিসাবে যোগদান, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা হিসাবে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্থান (বর্তমান বাংলাদেশ) এর কুমিল্লা, পটুয়াখালি, নওগাঁ ও নেত্রকোনায় ম্যাজিস্ট্রেট ও এস ডি ও হিসাবে চাকুরীরত ছিলেন। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের বিষয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে বিরোধের কারনে চাকুরী থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫০ সালে তদানীন্তন জেলা মেজিস্ট্রেটের আমন্ত্রনে তার পূর্বের কর্মস্থল কুমিল্লায় এসে ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন। সেই সাথে তিনি ধর্ম নিরপেক্ষতা, গনতন্ত্র, সমাজমুখী সাহিত্য চিন্তা ও শিল্পের অনুসারি ছিলেন। একি সাথে ১৯৫৩-৫৪ সালে তৎকালিন সরকার কর্তৃক পরিচালিত (V-AID) কর্মসুচির দায়িত্বও পালন করেন তিনি। তারপর পাকিস্থান সরকার পাকিস্থান একাডেমি ফর ভিলেজ ডেবলপমেন্ট (PARD) প্রতিষ্ঠার সিদান্ত গ্রহন করে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সহায়তার এবং মিশিগান ষ্টেট ইউনিভাসিটির একডেমিক সাপোর্টে। এটির একডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫৯ সালের ২৭শে মে কুমিল্লার অভয় আশ্রমে এবং সে সময়ে অনুষদ সদস্য হিসাবে যারা যোগদান করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আবদুল কাদের, সিরাজুল ইসলাম, এম নরুল হক, আনোয়ারুজ্জামান খান, সৈয়দ আতাউল রহিম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। প্রথম কাজটি শুরু হয় সি এস পি প্রবেশনারদের বুনিয়াদী প্রশিক্ষন কোর্সের মধ্য দিয়ে যার মূল ভিত্তি ছিল বার্ড কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রায়োগিক গবেষনার ফলাফলগুলো প্রশিক্ষনের মাধ্যমে বিচ্ছুরন ঘটানো।  

গবেষনার ফলাফলগুলো ছিল সমাজবিজ্ঞানমূলক যার ফসল কুমিল্লা মডেল যার মুল বিষয় ছিল স্বল্প সময়ে কার্য্যকর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অর্জন ও জনগনকে উন্নয়নের অংশীদারে পরিণত করন, একটি বিকেন্দ্রীকৃত ও সমন্বিত গ্রামীন প্রশাসন সৃষ্টি, রাস্তা- সেচ- পানি নিষ্কাসনের জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা, আধুনিক কৃষির নতুন ধারনা তৈরি, যৌথ উদ্যোগে সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়া ইত্যাদি। কুমিল্লা মডেল চারটি মূল উপাদানের গড়া যেমন (১) দ্বি-স্তর বিশিষ্ট সমবায় যার প্রাথমিক স্তর থাকবে গ্রাম পর্যায়ে এবং তাদেরই সমন্বয়ে গঠিত একটি ফেডারেশন থাকবে থানা পর্যায়ে; (২) পল্লীপূর্ত কর্মসূচী যার মধ্যে আছে অবকাঠামো তৈরি, কর্মসংস্থান; (৩) প্রশিক্ষনের মাধ্যমে মানব সম্পদ উন্নয়ন; (৪) সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন। এই চারটি উপাদানই পরবর্তিতে সরকারের কাছে চারটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে রুপান্তরিত হয় যেমন- সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসুচি (আইআরডিপি), স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তর (এলডিইডি) থানা প্রশিক্ষন ও উন্নয়ন কেন্দ্র (টিটিডিসি) ও থানা সেচ কর্মসুচি (টি.আপি) এই প্রত্যেকটি উপাদানই তদানিন্তন পাকিস্থান সরকার বাস্তবায়ন করেছিল পল্লীর সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যার সার্বিক স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৬৩ সালে এই কর্মসুচিকে রেমন্ড ম্যাগসেস পুরস্কার ভূষিত করা হয়। এই কুমিল্লা মডেলের ব্যাপ্তি তথনকার সময়ের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে গ্রামীন মানুষের উন্নয়নে একটি শক্তিশালী কাঠামো হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। এই বিশ্ববিখ্যাত মডেলটি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তদানীন্তন পাকিস্থান সরকারের কাছ থেকে পার্ড কুমিল্লা কোতায়ালী থানার তিনশটি গ্রামসহ একশত বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ছিল সামাজিক পরীক্ষাগার হিসাবে। 

সেই সময়কার ইনষ্ট্রাকটরদের গবেষনার এপ্রোচ ছিল গ্রামে গ্রামে ঘোরে গ্রামবাসীদের সমস্যা সনাক্তকরন, তথ্য সংগ্রহকরন, আলোচনা এবং বিশ্লেষন। এই সকল বিশ্লেষনের ভিত্তিতে তৈরী করা হতো কর্মসুচি যা ষাটের দশকের প্রথম দিকে কোটবাড়ীস্থ  বার্ডের নিজস্ব ক্যাম্পাসে যা একশত ছাপান্ন (১৫৬) একর জমির উপর অবস্থিত ছিল এক পাহাড় ঘেরা পরিবেশে।  বলা হয়েছিল ক্যাম্পাসের স্থাপনাগুলোর স্থপতিকে ছয় মাস গ্রামে রাখা হয়েছিল শুধু বুঝার জন্য যে গ্রামীণ মানুষের প্রশিক্ষন ও গবেষনায় কোন ধরনের স্থাপনার উপযোগী হবে। তাই এখনও মনে হয় সেই ক্যাম্পাসের দালানগুলো কত আধুনিক কত  প্রাণবন্ত। 

১৯৫৮ সালে পাকিস্থানের নতুন প্রেসিডেন্ট উন্নয়নের দশ বছর (১৯৫৮-১৯৬৮) এই শ্লোগানে অনেক নূতন কর্মসূচির গ্রহন তার মধ্যে একটি ছিল অধিক খাদ্য ফলাও অভিযান। এর  আওতায় ম্যানিলাভিত্তিক আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা ইনষ্টিটিউট (ইরি) উদ্ভাবিত ধান কৃষকদের মাধ্যমে  সম্প্রসারন করতে জাপানী পদ্ধতি ব্যবহার করা হলো জাপান ওভারসিজ কো-অপারেশন ভলেন্টিয়ার (জেও.সি.ভি) দের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে টিটিডিসি ও টিআইপি চারশত সতেরটি থানাতেই শুরু  হয় এবং টিসিসিএ ও আর.ডব্লু.পি ১৯৭০ সালের মধ্যে দুইশত পঞ্চাশটি থানায় সম্প্রসারিত হয়। ষাটের দশকের এই  পল্লী উন্নয়ন কর্মসুচিগুলো প্রশাসনিকভাবে দেখভাল করতো পূর্ব পাকিস্থান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (ইপিএডিসি) কিন্তু পরবর্তিতে  ব্যাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় দ্বি-স্তর বিশিষ্ট কুমিল্লা সমবায় কার্য্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৭০ সালে স্বমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসুচি (আই.আর.ডি.পি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়ে কুমিল্লা জেলার সকল থানায় টিসিসিএ (থানা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ এসোসিয়েশন লিঃ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর বাহিরেও তদানিন্তন রাজশাহী জেলার নাটোরে, ময়মনসিংহের  গৌরীপুরে এবং রংপুর জেলার গাইবান্ধায় ১৯৬৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে এই কার্য্যক্রম শুরু করা হয়। ষাটের  দশকটা ছিল কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য স্বর্ণযুগ বিশেষত: স্থানীয় ও আন্তর্জ্যাতিকভাবে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানা স্টেট  ইউনিভার্সিটির গবেষকগন একাডেমীতে কনসালটেন্ট হিসাবে কাজ শুরু করেছিল এবং তখনকার বার্ডের সাথে  সেই ইউনিভার্সিটির সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর (এমওইউ) এর মাধ্যমে অনুষদ সদস্যদের উচ্চতর প্রশিক্ষন (এমএস ও পিএইচডি) প্রদানের কার্য্যক্রম শুরু হয়েছিল মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে যার ফলে কুমিল্লা কর্মসুচির প্রতিটি কম্পোনেন্ট উপাদান এর  উপর বার্ষিক প্রতিবেদন, মূল্যায়ন গবেষনা, সেমিনার জাতীয়/আন্তর্জাতিক ক্রমাগতভাবে চলতে থাকে একটি উচ্চতর মান নিয়ে। 
এদিকে কুমিল্লা কতোয়ালী থানা সেন্ট্রাল কো- অপারেটিভ এসোসিয়েশন (কেটিসিসিএ) লিঃ এর মাধ্যমে কতোয়ালী থানার প্রতিটি গ্রামে কৃষক সমবায় সমিতি (কেএসএস) প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং এর অংগ সংগঠন হিসাবে সমবায় দুধ প্রক্রিয়াজাতকরন কারখানা, সমবায় কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিকরন কারখানা, সমবায় প্রেস, আবাসন সৃষ্টির জন্য হাউজিং সোসাইটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অর্থ্যাৎ কুমিল্লা কর্মসূচি গ্রামীন জীবনের এমন কোন দিক নেই যার উপর গবেষনা করেনি। এই সকল গবেষনাগুলো পুস্তিকা আকারে সমবায় প্রেস থেকে প্রকাশিত হতো যার মধ্যে ছিল পল্লী উন্নয়ন জার্নাল,  বার্ষিক প্রতিবেদন, কেইস হিস্ট্রি ইত্যাদি। 

এই সকল পুস্তিকাগুলোর মধ্যে ছিল ডঃ সৈয়দ আব্দুল কাদের প্রনীতঃ(Village Dhanishwar); আব্দুল আজিজ খান প্রনীত (Tubewell Irrigation in Comilla Kotwali Thana); এম নরুল হক প্রনীতি (Village Development in Bangladesh:A study of Monogram Village),Arthur Raper, ‘Rural Development in Action- A Comprehensive Experiment in Comilla,”|The Works of Akther Hameed Khan-Vol-1; Vol-II,Vol-III ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ছিল। সেই সময়ে বিদেশী ছাত্ররা আসত তাদের পিএইচডি গবেষনার কাজে তথ্য সংগ্রহের জন্য গ্রাম থেকে এবং বার্ডের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারকে তারা ব্যবহার করত গবেষনার কাজে। পাকিস্থান পরিকল্পনা কমিশনের পল্লী উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রনয়নে এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা ছিল অনবদ্য। একাডেমির তখনকার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল গ্রাম গবেষনার মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিতকরন এবং এর সমাধান কল্পে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন যার ফলশ্রুতিতে প্রতি সপ্তাহে ফেকাল্টিদেরকে নিয়ে একাডেমিক মিটিং তথা কাজের অনুসরন ছিল নিত্য দিনের সাথী। সার্বিক পরিবেশটি ছিল নলেজভিত্তিক প্রচেষ্ঠা যেখানে শ্রদ্ধাবোধ ও সরলতা একটি বড় দৃষ্টান্ত ছিল। তাই তখনকার একাডেমী একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠে প্রতিষ্টিত ছিল এবং প্রতিষ্টাতা পরিচালক গান্দীবাদ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন যার প্রতিফলন ঘটেছিল তার পোশাক পরিচ্ছদে ও খদ্দরের পায়জামা পান্জাবিতে। সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত জনাব খান একাডেমীর পরিচালক পদে আসিন ছিলেন। তিনি ওয়ার্ক প্রোগ্রাম ও দ্বি-স্তর বিশিষ্ঠ সমবায়ের প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্ন থেকেই মহাজন ও কন্ট্রাকটারদের রোসানলে ছিলেন যার বর্হিপ্রকাশ ঘটে প্রকাশ্যে যখন তিনি পরিচালকের পদ থেকে বিদায় নিলেন। কুমিল্লাভিত্তিক রাজনীতি ও ক্ষমতা কাঠমোও তার বিরুদ্ধে আচরন করতে থাকে এমন একটি সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশে স্বাধীনতার হাওয়া বইছে যার বহি:প্রকাশ ঘটে সত্তরের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে। এই ধরনের একটি পরিবেশে ১৯৭০ সালে খান সাহেব কুমিল্লাবাসীর উদ্দেশ্যে আমার কৈফিয়ত নামে একটি আলেখ্য দিয়েছিলেন যা ছিল রাগ আর অনুরাগে ভরপুর। তার পর স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন শুরু হয় তিনি তখন বার্ডেই অবস্থান করছিলেন এবং ১৯৭১ এর এপ্রিল মাসে তিনি করাচীতে চলে যান। তারপর তিনি সেখানে ১৯৭১-৭২ এ পশ্চিম পাকিস্থান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় লায়ালপুর, ১৯৭২-৭৩ এ করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে বিভাগের রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৩-৭৮ পর্যন্ত একটানা পাচবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানা স্ট্রেট ইউনিভাসিটি ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে কর্মরত ছিলেন। একইসংগে তিনি পাকিস্থান একডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (পার্ড) পেশওয়ারে (১৯৭৩-৭৫) এবং বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলমেন্ট (বার্ড) বগুড়া (১৯৭৮-৭৯) এর উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছিলেন। উনিশশত আশি সালে তিনি করাচীতেও রাংগী প্রকল্পের পরিচালক হিসাবে কাজ করেছিলেন। এই মহতি মানুষটির  স্বপ্ন ছিল নিজের পায়ে দাড়িয়ে স্বাবলম্বি (Self help and Self Relience) হওয়া। তদানিন্তন পূর্ব  পাকিস্থানে তার আগমন ও প্রস্থান এর সাথে সাথে একটি বর্নাট্য জীবনের অবসান হলেও কুমিল্লা গ্রামাঞ্চল এখনও তাকে স্মরন করে শ্রদ্ধাভরে একজন সমাজ সংস্কারক হিসাবে। তারপর শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম একটি নতুন রাষ্ট্রের চলার পথ যা ছিল খুবি বন্ধুর। বাস্তবতা পরিবতর্নশীল। আর সে পরিবর্তিত অবস্থার আলোকে নিতে হয় নুতন নতুন ব্যবস্থা। তবে যারা পথিকৃৎ তাদের গৌরববোধ চলে যায় না। একইভাবে সব কিছু চলে না কখনই। তাবলে যারা শুরু করেন, তাদের সে শুরুর মর্যাদা দিতে হবে। কিন্তু আখতার হামিদ খান সেটা পাননি।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা ও সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//