নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারের নতুন বাজেটে আগের মতোই কর অবকাশ ও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো। তবে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর জন্য আর এ সুবিধা থাকছে না। খাতসংশ্লিষ্টরা অবশ্য সরকারের এ সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, কর অবকাশ প্রত্যাহার হলে বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি চলমান বিনিয়োগ নিয়ে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগকারীরা চাপে পড়বেন। ঝুঁকিতে ফেলবে নতুন-পুরনো বিনিয়োগকেও।
আয়কর আইন ২০২০ অনুযায়ী, সরকারি ও বেসরকারি সব অর্থনৈতিক অঞ্চলেই স্থাপিত শিল্প ইউনিট ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা পায়। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত শিল্পের ক্ষেত্রে সে সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভেতরে-বাইরে আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে একই প্রতিষ্ঠান একাধিক শিল্প ইউনিট পরিচালনার যে অনুমোদন ছিল, তাও প্রস্তাবিত বাজেটে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
শিল্প মালিকরা বলছেন, দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আইন মেনে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভেতরে-বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু নতুন আইন তাদের বিনিয়োগকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে।
বে ইকোনমিক জোন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জিয়াউর রহমান বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা কর অবকাশসহ অন্যান্য বিষয় দেখেই আমাদের এখানে এসেছেন। সরকারের এ সিদ্ধান্ত দেখে তারা খুবই হতাশ। এ ধরনের পরিবর্তন হলে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আর বিদেশীদের কোনো আস্থা থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বে ইকোনমিক জোনের সব এফডিআই (প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ), যেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এ মুহূর্তে দেশে এফডিআই সবচেয়ে বেশি দরকার। এখন কর অবকাশ তুলে নেয়া হলে বিনিয়োগে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে। জমি, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। এ জায়গায় মূল নীতিমালায় পরিবর্তন সরাসরি এফডিআইতে প্রভাব ফেলবে। আমাদের বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এটা দেখে এরই মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।’
ভারত, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে এখন প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে জানিয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এসব দেশে নীতি ও আর্থিক অবস্থা স্থিতিশীল। সেজন্যই তাদের থেকে আমাদের এফডিআই অনেক কম। একদিকে আমাদের বললেন বিনিয়োগ করো, আমরা বিনিয়োগ করলাম। এরপর নীতি পরিবর্তন করে ফেললেন। এখন তো নতুন বিনিয়োগ আসবে না, আমাদের বিনিয়োগই ঝুঁকির মুখে রয়েছে।’
প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর আইন ২০২৪-এর স্ট্যাচুয়ারি রেগুলেটরি অর্ডার (এসআরও) নম্বর ১৮৪ অনুযায়ী, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ওপরও কর ধার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত শিল্প ইউনিটের মূলধনি যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও নির্মাণ উপকরণ আমদানিতে দিতে হবে ১ শতাংশ শুল্ক; যা এতদিন অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। সরকারের এ সিদ্ধান্তেও বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না এবং পুরনো বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মালিকরা।
প্রাইভেট ইকোনমিক জোন অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এএসএম মাইনউদ্দিন মোনেম বলেন, ‘এনবিআর কোনো সেক্টরকে আর শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় রাখবে না। আবার কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহারের ঘোষণাও আছে। এগুলো ঠিক হচ্ছে না। কারণ এমনিতেই বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসছে না। এখন এ ধরনের নীতি গ্রহণে আরো ক্ষতি হবে।’
আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোন লিমিটেডের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো বলেন, ‘ধারণা করছি সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে। সরকার যদি এখন সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকারিতে সুবিধা থাকবে আর বেসরকারিতে থাকবে না, এমনটা হলে তা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হয়ে গেল।’
অর্থনৈতিক অঞ্চলভুক্ত শিল্প ইউনিটের জন্য এতদিন বেশকিছু শর্ত সাপেক্ষে সর্বোচ্চ দুই হাজার সিসির দুটি গাড়ি শুল্কমুক্তভাবে আমদানির সুযোগ ছিল। নতুন আইনের ১৮৬নং এসআরওর মাধ্যমে শুল্ক অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করে কেবল কাস্টমস ডিউটি মওকুফ করা হয়েছে। এসআরও নম্বর ১৮৫ অনুযায়ী, অর্থনৈতিক অঞ্চলে উন্নয়নকাজে ব্যবহার্য আমদানীকৃত পণ্যের ওপর থাকা আমদানি শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি সুবিধাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে আর নতুন কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে আগ্রহ দেখাবে না বলে মনে করছেন শিল্প মালিকরা। ফলে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিদেশী বিনিয়োগ ব্যাহত হবে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সাল থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের এসআরওতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো মাত্র তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগ আকর্ষণের সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। তা না করে উল্টো কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে।
আমরা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলছি, তাদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করছি। কিন্তু সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে বিনিয়োগকারীরা কেউ কেউ আমাদের প্রতারকও বলছেন।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজেআই) জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাকাউন্টস) সুমন চন্দ্র ভৌমিক বলেন, ‘আমাদের এখন নতুন নতুন প্রণোদনা প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য পরিশ্রম করছি, দেশে-বিদেশে যাচ্ছি। বিনিয়োগকারীদের আনতে চাচ্ছি। তবে অনেক বিনিয়োগকারী আমাদের সঙ্গে চুক্তি করছে না। আমরা বুঝিনি কেন করছে না। এত দ্রুত এসআরও পরিবর্তন, সুযোগ-সুবিধা অব্যাহতি দেয়ার কী প্রয়োজন? বেপজায় (বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) বিনিয়োগকারীদের দেয়া সুবিধা চলমান। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন ঘটনা ঘটছে। সরকারের উচিত এসব বিষয়ে আরো ছাড় দেয়া।’
সরকারি-বেসরকারি সব অর্থনৈতিক অঞ্চলই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০১০-এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষিত ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত। সেজন্য এ আইনের ৪ নম্বর ধারার উপধারা ‘গ’-তে উল্লিখিত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ওই ধারার অন্যান্য উপধারায় উল্লিখিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের ধরনের মধ্যে কোনো পার্থক্য করার সুযোগ নেই বলে জানান বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলসংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, নতুন আয়কর আইনে সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল কর অবকাশ সুবিধা পাবে এবং বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল তা পাবে না—এটা আইন পরিপন্থী। দেশের শিল্পায়ন তথা বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠিত হলেও এ কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহারের কারণে নতুন কোনো শিল্পায়ন হওয়ারও সম্ভাবনা থাকবে না। ফলে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বিনিয়োগ করেছে, এখনো বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে পারেনি, তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও সম্পূর্ণ হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়া তাদের গৃহীত ব্যাংক ঋণ নিম্নমানের হবে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে যার প্রভাব পড়বে নেতিবাচক। এসব বিবেচনায় নিয়ে শিল্প মালিকরা আগের এসআরও পুনর্বহালের দাবি জানান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘বাজেট যেটা হয়েছে, এটা তো খসড়া। সংসদে পাস হলে এটাকে আমরা পূর্ণ বাজেট হিসেবে বিবেচনা করব। বিষয়টি বেজার পক্ষ থেকে খেয়াল করেছি। আগে যেসব সুবিধা দেয়া হয়েছে সেগুলো যেন সবার জন্য একই রকম থাকে, সে বিষয়ে আমরা এনবিআরকে চিঠি দেব। সেটা সরকারি-বেসরকারি যাই হোক।’ - বণিক বার্তা।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//