ডেস্ক রিপোর্ট: কর স্বর্গ ও গোপন (শেল) কোম্পানি খোলার অন্যতম কেন্দ্র বলে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে বাংলাদেশের বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস. আলমের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের সন্ধান মিলেছে। এই গ্রুপের অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তকারীদের মতে, ২০১১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে – ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে – মূলত অর্থপাচারের উদ্দেশ্যে ১৮টি গোপন কোম্পানি খুলেছেন এস আলমের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মাসুদ। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমতিও নেননি তিনি।
২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্টে আওয়ামী সরকারের পতন হয়। এরপর পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা এস আলমসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত দুর্নীতি ও আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যা আরও জোরদার করার মধ্যে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। গত ১৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের সাথে জড়িত সন্দেহে ১৫০ ব্যক্তির একটি তালিকা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৯ জনের বিষয়ে এরমধ্যেই তদন্ত করা হচ্ছে।
এর কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হওয়া সম্পদ ফেরানোর প্রাথমিক কাজ এর মধ্যে শুরু হয়েছে। ‘তবে জাল ফেলা হয়েছে, এখন গোটানো বাকি।’
এই প্রচেষ্টার সাথে জড়িত টাস্কফোর্সের একজন সদস্য জানান, পাচার হওয়া সম্পদ শনাক্ত ও উদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকার দৃঢ়সংকল্প, যে কারণে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে এস আলমের বিনিয়োগের খোঁজ পাওয়া গেছে।
এর আগে গত অক্টোবর মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকখাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এরমধ্যে কেবল এস আলম-ই অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন।
সম্পদ উদ্ধারে দরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা:
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকখাতকে ধবংস করার জন্য দায়ী দুজন ব্যবসায়ী – এস আলম ও সালমান এফ রহমান। বিগত সরকারও যেখানে মূল ভূমিকা রেখেছে।
“গভর্নর বলেছেন, কেবল এস আলমই ১০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে। এসব অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকারকে সব ধরনের চেষ্টা করতে হবে। সিঙ্গাপুর-সহ যেসব দেশে অর্থপাচার হয়েছে, ফিরিয়ে আনতে সহায়তা চেয়ে— সেসব দেশের সরকারের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে” – বলেন তিনি।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাস ও ইউরোপে এস আলম গ্রুপের বিপুল বিনিয়োগের কথা জানা যাচ্ছে।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন যে, “এই প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ, এবং তাতে অনেক বছর লাগতে পারে। এরমধ্যে আগামী নির্বাচনে হওয়া যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনও বিষয়টিকে জটিল করে তুলতে পারে। বিশেষত অর্থপাচারের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো নির্বাচিত সরকারের সাথে আঁতাত করে তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টাও হয়তো করবে।”
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ পুনরুদ্ধারে গত ১৯ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স। বৈঠকে এস আলম-সহ অন্যান্য শিল্পগোষ্ঠীর বৈদেশিক সম্পদের বিবরণ তুলে ধরা হয়। টাস্কফোর্সের সঙ্গে কাজ করা দেশি-বিদেশি কর্মকর্তাদের সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
ভার্জিন আইল্যান্ডসে এস আলমের যেসব কোম্পানি
টাস্কফোর্সের সূত্রমতে, ২০১১ সালে প্রথম এস আলমের নামে ক্যানালি লজিস্টিকস পিটিই লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি গঠন করা হয় ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে। এরপর এস আলমের মালিকানায় ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আরও ১০টি কোম্পানি খোলা হয়। এগুলো হলো – হানিওয়েল ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, গোল্ডেন ট্রেইলস ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, হ্যামিলটন ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, হ্যাজেল ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, লিভোনিয়া পিটিই লিমিটেড, লু শুই ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, পিটসডেল ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, স্পিংফিল্ড ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, চিং শুই ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড এবং ট্রিভোলি ট্রেডিং পিটিই লিমিটেড।
এছাড়া, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত আরও ছয়টি কোম্পানি গঠন করা হয়। এগুলো হলো – আদাইর ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, গ্রিনিচ ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, লিনিয়ার ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, ম্যারিকো ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড, ওয়েভপ্যাক ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড এবং জেনিতা ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড।
এছাড়া, ২০১৯ সালের ২২ মে তারিখে এস আলমের মালিকানায় পিকক প্রোপার্টি হোল্ডিংস লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি গঠিত হয়।
হ্যাজেল ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেডে ৭০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাইফুল আলমের নামে, বাকি ৩০ শতাংশের মালিক তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন।
বিদেশে বিনিয়োগ করতে হলে, যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তি বা সংস্থাকে আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। এস আলম গ্রুপকে এধরনের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো।
২০১৭ সালে ফাঁস হওয়া প্যারাডাইস পেপারে বিশ্বের অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিদেশে সম্পদ পাচারের তথ্য উঠে আসে, যেখানে কর স্বর্গ হিসেবে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের দিকেও আলোকপাত করা হয়।
সিঙ্গাপুর থেকে ১৭ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই অঞ্চলটি সেখানে বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক কর সুবিধা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে কোনোপ্রকার আয়কর, বাণিজ্যিক কর, বা মূলধনী আয়ের ওপর কর না থাকা। এছাড়া, বিনিয়োগকারীর গোপনীয়তার অধিকারও দেয় সেখানকার কর্তৃপক্ষ, যার ফলে প্রকাশ্যে তাদের শেয়ারহোল্ডার বা পরিচালকদের নাম আনুষ্ঠানিক নথিতে প্রকাশ না করেও সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে বিভিন্ন কোম্পানি।
কর স্বর্গের ব্যবহার হয় কেন:
অর্থপাচার ও নানান ধরনের দুর্নীতির জন্য খোলা হয় শেল বা গোপন কোম্পানি। করফাঁকি এবং আয়ের উৎস গোপন করতে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তারা কর স্বর্গ বা ট্যাক্স হ্যাভেন বলে পরিচিত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এসব প্রতিষ্ঠান খুলে থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ন্যূনতম কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সম্পদ ধারণ বা তা লেনদেনের মাধ্যমে অন্যত্র স্থানান্তর করতে শেল কোম্পানি খোলা হয়, যাদের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে কর স্বর্গগুলো। কারণ সেখানে কর যেমন স্বল্প, তেমনি আইন ও বিধিমালাও শিথিল। পায় গোপনীয়তা রক্ষার সুবিধাও। কর সুবিধা লাভ এবং গোপন কার্যক্রম পরিচালনায় আগ্রহী ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জনপ্রিয় কয়েকটি কর স্বর্গের মধ্যে নাম করা যায় – কেম্যান আইল্যান্ডস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, বারমুডা ও চ্যানেল আইনল্যান্ডস এর।
ইন্টারন্যাশল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) এর এক অনুসন্ধানে এসব কর স্বর্গের ব্যাপক সুবিধা গ্রহণের চিত্র উঠে এসেছে। বিভিন্ন শেল কোম্পানি ব্যবহার করে কীভাবে কর ফাঁকি দেওয়া, অর্থ পাচার ও প্রকৃত মালিকানা গোপন রাখা হচ্ছে তা-ও উঠে আসে এতে।
সম্পদ ফিরিয়ে আনা কঠিন, তবে সম্ভব:
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)- এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং তাঁদের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ– বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে নিশ্চয় প্রমাণ আছে যে অর্থপাচার হয়েছে, কারণ তারাও জড়িত ছিল। “পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা অসম্ভব না, তবে এটি জটিল ও দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া।”
তিনি বলেন, প্রথমে এটা আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে এস আলমের কোম্পানিগুলোর অর্থায়ন করা হয়েছে। “এটাকে পাচার হওয়া টাকা বললেও– আইনিভাবে প্রমাণ না করতে পারলে, কোনো দেশই তা ফেরত দেবে না। তবে একবার আইনিভাবে প্রমাণ করা গেলে– সম্পদ ফিরিয়ে আনতে তখন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা যাবে।”
এই লক্ষ্য অর্জনে বিএফআইইউ, দুদক, সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় – গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচটি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিদেশে এস আলমের যেসব সম্পদ:
২০০৯ সাল থেকে গত এক দশকে এস আলম নিজের এবং তার স্ত্রীর নামে বিভিন্ন কোম্পানি স্থাপন করে সিঙ্গাপুরে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে শুরু করেন।
সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, এস আলম একটি শপিং মলে ৩টি হোটেল ও রিটেইল স্পেস কেনার জন্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার (বর্তমান ডলারমূল্যে ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সমান) বিনিয়োগ করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন গোপনীয় নথি অনুযায়ী দেখা যায়, ভুয়া কাগুজে প্রতিষ্ঠান খুলে নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে দেশের প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা লুট করেছেন এই এস. আলম।
এসব ঋণের অর্থ শত শত আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মোড়কে এলসির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//