মোঃ সাইফুল ইসলাম (পিপন): পুঁজিবাজার একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মেরুদণ্ড। এটি কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং সাধারণ মানুষের সম্পদ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এই বাজারে স্বচ্ছতা ও ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা সবসময়ই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো ইনসাইডার ট্রেডিং। এটি এমন একটি অপকর্ম, যা পুঁজিবাজারের স্বচ্ছ পরিবেশ নষ্ট করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী গোপন তথ্য ব্যবহার করে নিজেদের লাভবান করলেও সামগ্রিকভাবে এটি বাজারের স্বাভাবিক গতিধারা ব্যাহত করে।
ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের প্রকৃতি এবং প্রভাবঃ ইনসাইডার ট্রেডিং বলতে বোঝায় কোনো কোম্পানির ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যা এখনো জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি, সেই তথ্য ব্যবহার করে শেয়ার কেনাবেচা করা। এটি কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ডিরেক্টর বা যারা এই তথ্যের সংস্পর্শে আসে, তাদের দ্বারা সংঘটিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মী জানতে পারেন যে, কোম্পানির মুনাফা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে, তবে তিনি সেই তথ্য ব্যবহার করে শেয়ার কিনে নেন এবং বাজারে দাম বৃদ্ধির পর সেগুলো বিক্রি করে লাভ করেন। এটি একদিকে যেমন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রতি অন্যায়, তেমনি বাজারের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্যও ক্ষতিকর।
ইনসাইডার ট্রেডিং পুঁজিবাজারে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রথমত, এটি বাজারের স্বচ্ছতা নষ্ট করে। একটি পুঁজিবাজার তখনই কার্যকর হয়, যখন প্রত্যেক বিনিয়োগকারী একই তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু ইনসাইডার ট্রেডিং এই নীতিকে ধ্বংস করে। দ্বিতীয়ত, এটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ইনসাইডাররা বাজারে অপ্রকাশিত তথ্যের মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করে যখন মুনাফা অর্জন করেন, তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সেই শেয়ারের প্রকৃত ঝুঁকি বুঝতে পারেন না।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের বর্তমান অবস্থাঃ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ইনসাইডার ট্রেডিং নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। যদিও বাংলাদেশের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) এই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করেছে, তবুও বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসের পর ইনসাইডার ট্রেডিং নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ উঠে আসে। অনেক কোম্পানির ডিরেক্টর বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা আগে থেকেই আসন্ন ক্ষতির তথ্য জানতেন এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে শেয়ার বিক্রি করেছেন।
বাংলাদেশে ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধে কয়েকটি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা। যদিও ইনসাইডার ট্রেডিং নিষিদ্ধ, তবে এই অপরাধ প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন। এর জন্য তথ্যপ্রমাণ এবং একটি কার্যকর তদন্ত প্রক্রিয়া প্রয়োজন, যা আমাদের দেশে এখনও উন্নত নয়। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। ডিএসই এবং সিএসইর মতো বাজারগুলোতে আধুনিক লেনদেন পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। ফলে অস্বাভাবিক লেনদেন সনাক্ত করা বেশ কঠিন।
আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে ইনসাইডার ট্রেডিং: আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের সমস্যা নতুন নয়। তবে উন্নত দেশগুলোতে এর বিরুদ্ধে কঠোর আইন এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যায়। ইউএসএ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (SEC) ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। ১৯৮০ সালে বিখ্যাত ‘ইভান বোয়েসকি’ কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্রে SEC প্রায়শই ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের Market Abuse Regulation (MAR) অনুযায়ী, ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। জার্মানির Wirecard কেলেঙ্কারির পর আইন আরও কঠোর করা হয়েছে। ভারতেও ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (SEBI) নিয়মিতভাবে লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে এবং অসাধু কার্যকলাপের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে SEBI বেশ কিছু কোম্পানির বিরুদ্ধে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের অভিযোগ প্রমাণ করে তাদের জরিমানা করেছে।
তুলনামূলকভাবে, বাংলাদেশে ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধে উন্নত দেশগুলোর মতো পদক্ষেপ এখনো নেওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের সিকিউরিটিজ আইন থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং সচেতনতার অভাবের কারণে এই সমস্যা সমাধানে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়।
ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জঃ ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধে বাংলাদেশকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রথমত, তথ্যপ্রযুক্তির অভাব। উন্নত দেশের মতো লেনদেন বিশ্লেষণের জন্য অত্যাধুনিক সফটওয়্যার এবং ডেটা অ্যানালাইটিক্স প্রযুক্তি আমাদের দেশে নেই। দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দক্ষ জনশক্তির অভাব। বিএসইসি এবং ডিএসইর মতো সংস্থাগুলোতে প্রশিক্ষিত পেশাজীবীর সংখ্যা সীমিত। তৃতীয়ত, জনসচেতনতার অভাব। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অনেক সময় জানেন না যে ইনসাইডার ট্রেডিং তাদের বিনিয়োগের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
এছাড়া, করপোরেট গভর্ন্যান্সের দুর্বলতাও একটি বড় সমস্যা। অনেক কোম্পানি তাদের পরিচালনা পর্ষদে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, যা ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের ঝুঁকি বাড়ায়।
ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ ইনসাইডার ট্রেডিং প্রতিরোধে একটি কার্যকর পরিকল্পনার প্রয়োজন। প্রথমত, প্রযুক্তির উন্নয়ন অপরিহার্য। ডিএসই এবং সিএসইর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নত লেনদেন পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি চালু করতে হবে। যেমন- ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে লেনদেন আরও স্বচ্ছ এবং পরিবর্তনযোগ্য নয় এমন প্রক্রিয়া তৈরি করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোরতা বাড়ানো প্রয়োজন। সঠিক তদন্ত এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীদের নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া, আইনের শাস্তি কঠোর করতে হবে, যাতে অপরাধীরা এই কাজে লিপ্ত হতে ভয় পায়। তৃতীয়ত, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেমিনার, কর্মশালা এবং গণমাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানানো যেতে পারে।
সর্বপরিঃ ইনসাইডার ট্রেডিং একটি গুরুতর সমস্যা, যা পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার জন্য বড় হুমকি। এটি প্রতিরোধে বাংলাদেশের জন্য একটি সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। আইন প্রয়োগ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। আন্তর্জাতিক উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের বাজারের জন্য একটি কার্যকর কৌশল তৈরি করতে হবে। পুঁজিবাজারে ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা গেলে এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//