ড: মিহির কুমার রায়: মানুষের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়, যা সব মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। অতএব এক কথায় আমরা বলতে পারি- মানুষের জীবন, অধিকার, সমতা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ সুবিধাগুলিই মানবাধিকার। মানবাধিকার একটি বহুল আলোচিত বিষয় যা মানুষের আইনগত অধিকার, নৈতিক অধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকারের সমষ্টি অর্থ্যাৎ সকল আইনগত অধিকার, নৈতিক অধিকার ও মৌলিক অধিকারই মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। প্রায় ৭৬ বছর যাবত এ দিবসটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে পালিত হচ্ছে। অর্থাৎ ১৯৪৮ থেকে আজ অবধি এ দিবসের হীরকজয়ন্তী পেরিয়ে গেলেও সঙ্গত কারণেই এ দিবসটি পালনের গুরুত্ব কমেনি এতটুকু! সাধারণত ‘মানুষ’ হিসেবে যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণ, প্রতিষ্ঠা, চর্চার বিষয়টিকেই ‘মানবাধিকার’ বলে মনে করা হয়। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হওয়ার পর ১৯৫০ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বিশ্বজুডে দিনটি পালিত হয়ে আসছে যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
গবেষণায় বলছে, মানবাধিকারের ধারণাটি সর্ব প্রথম এসেছে আঠারো শতকে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশকালের ফসল হিসেবে। তবে কি সময়ের প্রয়োজনেই বিশ্বব্যাপী এই দিবস আজ একবিংশ শতাব্দীতেও এত গুরুত্বপূর্ণ! প্রশ্ন জাগে, এই মানবাধিকার বা মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা, এত আলোচনা? কেনই বা প্রতি বছর ‘মানবাধিকার’ নামক একটি দিবস পালিত হয়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক একটি সনদ হিসেবে সর্বসাধারণের মৌলিক অধিকারের ধারণার বিকাশ ঘটে যা আজ ‘সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’ (ইউডিএইচআর) নামে পরিচিত। বর্তমানে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে বিশেষ করে যে কোন বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের ধারণা যেন একটি প্রাথমিক কাঠামোগত ভিত্তি হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত; যেখানে মানব সত্তার মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। ইউডিএইচআর-এর ১নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে যে, ‘সব মানুষই স্বাধীন অবস্থায় সম-মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই মানুষের সমতা, ন্যায্যতা, অধিকার, মর্যাদা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সবার আগে যেটি প্রয়োজন, তা হলো মানবিকতা!
এবার দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে এমন একটি প্রেক্ষাপটে, যখন কিনা বিশ্ব একটি ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক অতিমারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, শরণার্থী-সংকট, উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান, জনরঞ্জনবাদের আবির্ভাব এবং জাতিগত বিভেদের দরুন বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর কেবল মাত্র রপ্তানিমুখী অর্থনৈতিক নীতি, ক্রমবর্ধমান বর্ণবাদ, পশ্চিমা বিশ্বে বেড়ে যাওয়া জেনোফোবিয়া, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, কর্মক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা এবং শ্রেণীবৈষম্য আমাদের মানবাধিকারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এছাড়াও গৃহযুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ, নিষেধাজ্ঞা এবং অবরোধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক উল্টোযাত্রা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি একবিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ দৃশ্যমান হয়েছে। বিশ্বব্যাপী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং জনতুষ্টিবাদের রাজনীতি আগের চেয়ে আরও ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠছে। ফলে সাদা চোখেই একটি উল্টোযাত্রা দৃশ্যমান হয়েছে। জন হপকিন্স স্কলার ইয়াশা মাউঙ্কও বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের এমন উল্টোযাত্রা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। উদারবাদী মূল্যবোধ বিশ্বব্যাপী ক্ষয় হচ্ছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি আমাদের সমাজকে আরও ক্ষতিগ্রস্থকরছে। সম্ভবত ইতিহাসে এটি একটি প্রথম ঘটনা, যেখানে মহান শক্তিগুলো তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব এবং বাইডেনের মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা পররাষ্ট্রনীতি এমন দাবির প্রমাণ করে। এ ধরনের রাজনীতি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতিকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
জাতিসংঘ একটি আদর্শবাদী প্রতিষ্ঠান যা বহুপাক্ষিকতার প্রচার করে এবং গোষ্ঠী রাজনীতি এবং পরাশক্তির দ্বন্দের বাইরে গিয়ে জাতিসংঘ তার সদস্যদের একত্রিত করে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করে। বিগত সময়ে জাতিসংঘ চিহ্নিত করেছে যে আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতা গত কয়েক বছরে হুমকির মুখে পড়েছে এবং বিশ্বব্যাপী মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতিসংঘের সকল সদস্য যেহেতু ইউডিএইচআর গ্রহণ করেছে, তাই আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে সচেষ্ট হতেই হবে। একটি বিপর্যয় অর্থনৈতিক কাঠামো, কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, জেনোফোবিয়া, বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদ, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, সব ধরনের সংঘাত, সহিংসতা এবং ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আমাদের মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতাকে হরণ করছে।
বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় দৃঢ় বিশ্বাসী একটি দেশ এবং তাই ১৯৭৪ সালে সদস্য হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রায় সব সংন্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণ বজায় রেখেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। এটি মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য এবং ইউএনএইচসিআরের সাথে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রাখছে। মানবাধিকার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনের রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মানবাধিকারের বিভিন্ন নির্দেশকে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। বিশ্ব জনসংখ্যা পর্যালোচনা রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২১ সালে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ফলে মৃত্যুর দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে যথাক্রমে ব্রাজিল (৪৯,৪২৬ জন), যুক্তরাষ্ট্র (৩৭,০৩৮ জন) এবং মেক্সিকোতে (২২,১১৬ জন)। এই প্রতিবেদন অনুসারে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রথম তিনটি দেশ হলো যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উন্নত দেশের তুলনায় ভালো। মানবাধিকার রক্ষা, এর চর্চা ও বিকাশ আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে শুরু করে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধ এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে মুক্তি সংগ্রাম প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার নির্মোঘ দাবি ও আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দেয়া এবং মুক্তি ও গণতন্ত্রকে জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ প্রমাণ করে বাংলাদেশ শুধু মানবাধিকারের প্রবক্তাই না, মানবাধিকার রক্ষক, প্রচারক। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর অবদান, নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের সফলতা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বে আমাদের রোল মডেলের স্বীকৃতি বলে দেয় মানবাধিকারের প্রতি বাংলাদেশের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও প্রচেষ্টা। গত পাঁচ বছর ধরে প্রায় ১২ লাখ রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে, শিশু অধিকারে এবং সম্ভবত হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকার করা গত দশকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের বহুদিনের দাবি- ভোটাধিকারও নিশ্চিত করেছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধিতেও সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, এছাড়াও একটি জাতি হিসেবে বাঙালি তার আতিথেয়তার জন্য পরিচিত এবং বর্ণবাদ, জেনোফোবিয়া, আধিপত্য ইত্যাদির মতো প্রথম বিশ্বের অনেক সমস্যা থেকেও মুক্ত। তবুও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি রাজনৈতিক সহিংসতা, জলবায়ু পরিবর্তন, নিম্নমানের শ্রম পরিস্থিতি এবং দুর্বল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা একটি পুনরাবৃত্ত ঘটনা। একটি ব-দ্বীপ হিসেবে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয় যা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, অভ্যন্তরীণ ভাবে বস্তুচ্যুত ব্যক্তি এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়াও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। এই প্রত্যেকটি বিষয়ে সরকার দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করছে যা দেশে বিদেশে প্রসংশিত হয়েছে।
স্বাধীনতার গত ৫৩ বছরে সাফল্য পর্যালোচনায় আসে আইনগত সংস্কার, প্রশাসনিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও চুক্তির প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার এবং প্রতিপালন প্রমাণ করে মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন বাঙালি জাতির সহজাত সংস্কৃতি। মানবাধিকার রক্ষা ও বিকাশে বাংলাদেশ আইনগত পদক্ষেপ ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন সাধনসহ অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মানবাধিকার রক্ষায় ২০০৮ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা, তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা, শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং ১০টি শ্রম আদালত স্থাপন, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন, ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয়় লিঙ্গের স্বীকৃতিসহ বাংলাদেশ অনেক আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন করেছে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচনে বাংলাদেশ পঞ্চমবারের মতো সাফল্যের সঙ্গে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে। এর আগে বাংলাদেশ ২০০৬, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালেও জয়লাভ করে সদস্য নির্বাচিত হয়। এটি মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ও অঙ্গীকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সুতরাং ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ মানবাধিকারের রক্ষক ও চর্চাকারী। অথনৈতিক সূচক, পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে অগ্রগতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি বিশেষ দিক হলো অর্থনৈতিক মুক্তি যে ব্যবস্থায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই বেঁচে থাকবে নিজ নিজ সামর্থ্যের মহীমায় যা ছিল আমাদের জাতির পিতার স্বপ্ন। গত এক যুগে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য বেশ ঈর্ষণীয়, সরকারের পরিকল্পিত কৌশল গ্রহণের ফলে এ সময়ে দারিদ্র্যের হার নেমে আসে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে এবং অতি দারিদ্র্যের হার নেমে আসে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ, মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮ শত ২৮ মার্কিন ডলারে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বের প্রতিটি দেশের ন্যায় বাংলাদেশের অগ্রগতিও হঠাৎ হোঁচট খায় যদিও সরকারের বেশকিছু দ্রুত সাহসী পদক্ষেপে অতি অল্প দিনেই বাংলাদেশ ফের উন্নয়নের ট্র্যাকে উঠে আসতে সক্ষম হয়। সাম্প্রতিক কালে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক চরম রুপ নিয়েছে এবং বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে আগামী বছর বিশ্বে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এই ধরনের একটি প্রেক্ষাপটে সরকার দারিদ্র্যদের খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে ১ সেপ্টেম্বর থেকে সারা দেশে অর্থ্যাৎ হতদরিদ্রদের কাছে স্বল্পমূল্যে চাল বিতরণ করে তাদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করা এ কর্মসূচির লক্ষ্য যা নিঃসন্দেহে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এরই মধ্যে দেশটি সামাজিক ও আর্থিক খাতে উন্নয়নের জন্য বিশ্ব পরিসরে রোল মডেল হওয়ার প্রশংসা কুড়িয়েছে স্বীকৃতির মাধ্যমে। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারন অর্থনীতি বিভাগ মনে করেন ব্যাপকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচি বাস্তবায়নের ফলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে; বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন জনগনের শ্রম আয় বেড়েছে, দারিদ্র কমেছে, বিবিএস আরও বলছে খানা প্রতি মাসিক আয় বেড়েছে, খাদ্যাভাস পরিবর্তন হয়েছে, বিল্ডিং বাড়ীর সংখ্যা বেড়েছে ও সামাজিক নিরাপত্তারও অগ্রগতি হয়েছে। নিরপেক্ষ গবেষকগন বলছেন বাংলাদেশর দারিদ্য হ্রাসের একটি মূল কারন গ্রামের গরীব মানুষের অর্জিত রেমিট্যান্স যা গ্রামীন অর্থনীতির রুপান্তরের একটি বড় নিয়ামক। কৃষিমুখী নীতির কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সত্যেও গত এক দশকে দেশে ধারাবাহিকভাবেই কৃষি খাতে উৎপাদন বড়েছে। এই উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখছে কৃষি খাতে নানামুখী সংস্কার এবং যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ফলে দেশের কৃষি ব্যবস্থয় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ক্ষুধার্থকে অন্নদান গৃহহীনকে গৃহদান, জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভিত্তিতে ভাতা প্রদান, বিধবা ভাতা চালু, উপজাতী নৃগোষ্ঠি সম্প্রদায় শ্রেণীর জন্য চাকুরীতে কোটা পদ্বতি বহাল প্রত্যেকটিই সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার একটি উজ্জল দৃষ্ঠান্ত। মানুষের পাচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা (বর্তমানে শিক্ষার হার ৭২.৫%) ও স্বাস্থে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবা গ্রামের মানুষের কাছে পৌছানো), মোবাইল/এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরন, সমাজের সুধিাভোগী/সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে ডিজিটাল সুবিধা প্রদান, প্রায় সিংহভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ সুবিধা দিয়ে জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদি সবই সরকারের অর্জন যার সাথে মানবাধিকারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। তারপরও অর্থনীতি ও মানবাধিকারের বিভিন্ন ঝুঁকি আছে এবং অনেক সময় একীভূত বিশ্ব ব্যবস্থায় সেগুলো মোকাবেলা করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বিধায় অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। চলমান বৈশ্বিক সংকটও ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠবে, অর্থনীতি তথা মানবাধিকার কখনো একই গতিতে এগোয় না, সেখানে সংকোচন ও প্রসারণ থাকে, সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করে আমরা বিশ্বাস করি, সামষ্টিক স্থিতিশীলতা আনা যাবে। সরকার গত দেড় যুগ মানবাধিকার ব্যবস্থাপনায় আমরা পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছি, যার ফলে আমাদের সকল সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে অবশ্যই বহুত্ব ও বহুপাক্ষিকতার পথ বেছে নিতে হবে, আমাদের মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হবে-, মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নে বাংলাদেশ অতীতেও কাজ করেছে, বর্তমানেও করছে এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত রাখবে।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//