ড: মিহির কুমার রায়: বাজার সিন্ডিকেট, ব্যবসার ক্ষেত্রে একটি বহুল আলোচিত নাম যার শিকড় বাংলাদেশের ব্যবসার অঙ্গনে অত্যন্ত গভীর এবং এই সিন্ডিকেট মূলত ব্যবসায়ী শ্রেণির শক্তিশালী গোষ্ঠী যারা রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ সিন্ডিকেটের আধিপত্য দেশের বহু খাতে বিস্তৃত। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের জন্যই বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নিত্যপণ্যের সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান ও পরিবহনসহ—সব জায়গায় এই সিন্ডিকেটের শৃঙ্খল খুঁজে পাওয়া যায়। একদিকে সরকারের দুর্বলতা, অন্যদিকে রাজনীতির সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক। এতে সাধারণ মানুষ ক্রমাগত কষ্টের মধ্যে পড়ছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রত্যাশা ছিল- এবার হয়তো ভাঙবে বাজার সিন্ডিকেট, কমবে ভোগ্যপণ্যের দাম। বর্তমান সরকারের একশ দিন পার হয়ে গেলেও দেশের সাধারণ মানুষের সে আশা পূরণ হয়নি। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের প্রথম কাজ ছিল সিন্ডিকেটের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা। প্রাথমিকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনা এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর করসাজি বন্ধ করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার আজও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিশেষত, খাদ্য ও বাজারজাতকরণে সিন্ডিকেটের প্রভাব রয়ে গেছে এবং জনগণের চরম দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। বিগত সরকারের সময় সিন্ডিকেটের নেপথ্য ভূমিকা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছিল। সেই সরকারের অধীনে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিশাল অর্থনৈতিক লাভবান হয়েছে কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। আবার বর্তমান পরিস্থিতিতেও দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সমর্থনে সিন্ডিকেটের শক্তি আরও বিস্তৃত হচ্ছে। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, তাদের রাজনৈতিক সহযোগিদের মাধ্যমে, সরকারের দুর্বল অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছেন।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে দাম নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে; কিন্তু তাতে তেমন কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। স্বস্তি ফেরেনি; বরং বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম আরো বেড়েছে। বেশি বেড়েছে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, আলু, ব্রয়লার মুরগি, ডিম প্রভৃতির দাম। মোটা চাল ও চিনির দাম সামান্য হলেও বেড়েছে। কমেছে শুধু অ্যাংকর ডালের দাম। শীত মৌসুম চলে এলেও মৌসুমি সবজির দাম এতদিন চড়া ছিল। কয়েকদিন ধরে কমছে, তবে তা খুব বেশি নয়। আলু পেঁয়াজের দাম কমাচ্ছে না ব্যবসায়ীরা বাজারে সবজিসহ পেঁয়াজ, আলু ও ভোজ্যতেলের বাড়তি দরে রীতিমতো অসহায় ভোক্তা। কয়েক মাস ধরেই এসব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বগতি। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য নির্ধারণ করা হলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। বরং নীতিনির্ধারকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাড়তি দামেই বিক্রি করছেন তারা। পরিস্থিতি এমন- প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে ক্রেতার ১০০-১২০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। নতুন আলুর কেজি ১০০ এবং পুরোনোটি সর্বোচ্চ ৮০ টাকা। বাড়তি ভোজ্যতেলের দামও। এছাড়া দু-একটি বাদে সব ধরনের সবজির দাম কেজিপ্রতি ৬০-৮০ টাকা। এছাড়া কিছু সবজির দাম ১০০ টাকার বেশি। বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে বাজারে ক্রেতাসাধারণ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, তিন টার্মে ক্ষমতাসীন গত সরকার ১৫ বছরের মেয়াদপূর্তি করলেও এ সময়ে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে সরকার বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। বরং দুর্নীতিবাজ এ চক্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততার বিস্তর অভিযোগ মিলেছে মন্ত্রী-এমপিদের। সিন্ডিকেট ভাঙতে গেলে উল্টো বেকায়দায় পড়তে হতে পারে বলে দায় এড়িয়েছে সরকারের দায়িত্বশীলরা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ভুল কৌশলের কারণেই সরকার মূলত বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙতে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া অধিকাংশ কৌশলী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে সফল না হওয়ায় এই চক্র দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, মূল সংকটের সমাধান না করে এলোমেলোভাবে তদারকি বাড়ানোর কারণে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং কোনো কোনো পণ্যের বাজার উল্টো তেঁতে উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ভাঙতে অবৈধ মজুতদারদের কঠোর সাজার আওতায় আনা এবং তদারকি কার্যক্রম সারা বছর জোরদার রাখা জরুরি। অথচ এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বরাবরই ভুল পথে হেঁটেছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দাম কমাতে বেশ কিছু পণ্যের শুল্ক ছাড়সহ আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, পাশাপাশি বাজার অভিযান জোরদার করেছে। একসঙ্গে মাঠে নামানো হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিন উপসচিবের নেতৃত্বে তিনটি টিম। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের টিমও ঢাকাসহ সারাদেশে নিয়মিত বাজার তদারকি করছে। এছাড়া প্রতিযোগিতা কমিশন, বিএসটিআই, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও নড়েচড়ে বসেছে। একই সঙ্গে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কম দামে বেশ কিছু নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে এবং খাদ্য অধিদপ্তর ভর্তুকি মূল্যে চাল-আটা বিক্রি শুরু করেছে। আবার সরকার প্রতিবেশী দেশ থেকে ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল এবং কাঁচামরিচের আমদানিও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তবুও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসছে না পেঁয়াজ ও আলুর দাম। এরই মধ্যে আমদানি করা পেঁয়াজে কাস্টমস শুল্ক ও রেগুলেটরি শুল্ক অব্যাহতি এবং আলুর আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার পাশাপাশি ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক তুলে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপরও খুচরা বাজারে চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ দুই পণ্য। এখানে উল্লেখ্য যে সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপুরনে ভারত থেকে খাদ্যপণ্য আমদানীতে বাধা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যা বাজার পরিস্থিতিকে আরও সমস্যায় ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাজারে আমনের নতুন ধান উঠেছে। উৎপাদনও আশানুরূপ। ১০ দিনের মধ্যে ধানের দাম মণপ্রতি কমেছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা। এরপরও চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে ক্ষোভ বাড়ছে ভোক্তাদের। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ বাড়ানো জরুরি। শুল্ক কমানো হলো; কিন্তু আমদানি বাড়ল না- তাতে সুফল পাওয়া যাবে না। চাল, পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের বাজারে শুল্ক কমানোর পরও আশানুরূপ আমদানি না আসায় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না বলে মনে করেন তারা। এ ব্যাপারে (ক্যাব) সাবেক সভাপতি বলেন, কর কমানো একটি উপায় হলেও বেশির ভাগ সময় তা সুফল দেয় না। আমি মনে করি, নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা ও এ ব্যাপারে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনাটা জরুরি। চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে হবে। একদল চাঁদাবাজি করে চলে গেছে, আরেক দল চাঁদাবাজি করার দায়িত্বে এসেছে- এটাকে যদি সরকার স্বাভাবিকভাবে নেয়, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। সরকারের পরিবর্তন হলেও খেলোয়ারের কোন পরিবর্তন হয় নি।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ও বর্তমানে এফবিসিসিআইর প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা হাফিজুর রহমান বলেন আলুর মূল সিন্ডিকেট হয় হিমাগারে। আলুর সিন্ডিকেট নিয়ে তদন্ত করে দেখতে ইতোমধ্যেই প্রতিযোগিতা কমিশনের কর্মকর্তাদের দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়েছে। তদন্ত টিম প্রথমে আলু ব্যবসায়ীদের কাছে এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা চাইবে, ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে তদন্ত টিম সরজমিন তদন্তে মাঠপর্যায়ে যাবে। দোষ প্রমাণ হলে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। আলুর মতোই ডিমেও সিন্ডিকেটের প্রমাণ মিলেছে। ডিমে অবশ্য কয়েকটি স্তরে সিন্ডিকেট হচ্ছে। আর ডিম ও মুরগিতে সিন্ডিকেটে নেতৃত্ব দিচ্ছে পোল্ট্রি খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের খামার থেকে যখন ডিম বিক্রি করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে; তখনই মূলত সিন্ডিকেটটা হচ্ছে। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে দেখা গেছে, মূলত সাত থেকে আটটি হাত বদলের কারণেই দাম বাড়ছে সবজির। সরবরাহ ব্যবস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের হাতবদল হচ্ছে। এমনিতেই বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি দাম বাড়ছে হাতবদলের নামে সিন্ডিকেটের কারণে।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের প্রথম কাজ ছিল সিন্ডিকেটের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা। প্রাথমিকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনা এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর করসাজি বন্ধ করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার আজও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিশেষত, খাদ্য ও বাজারজাতকরণে সিন্ডিকেটের প্রভাব রয়ে গেছে এবং জনগণের চরম দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। সিন্ডিকেটের শক্তিকে ভাঙা শুধু সরকারের জন্য নয়, সমগ্র দেশের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক কার্যকর পদক্ষেপ অপরিহার্য।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//