জেলা প্রতিনিধি: বগুড়ার সারিয়াকান্দির যমুনা নদীর বিস্তীর্ণ বালুচর একসময় অনাবাদি থাকতো। মানুষের চাহিদার কারণে এখন চরগুলো নানা ফসলে ভরপুর। চরের কৃষকরা এখন তাদের উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। অনেকে চর ছেড়ে উপজেলা সদর এমনকি জেলা শহরেরও বসতি গড়েছেন।
স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার উপজেলায় রেকর্ড পরিমাণ জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। চাষাবাদে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের ফলে এমন সফলতা এসেছে। কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, অনেক মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারিয়াকান্দির ১২ ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় সবই যমুনা ও বাঙালি নদীর তীরবর্তী। এর মধ্যে তিনটি ইউনিয়নে বাঙালি ও সুখদহ নদী বহমান। পৌরসভাসহ ছয় ইউনিয়নের আংশিক ও তিনটি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ যমুনা নদীগর্ভে চলে যায়। ফলে আগে নদী তীরবর্তী বিশালাকার চারণভূমি অনাবাদি থাকতো। তবে যমুনা, বাঙালি ও সুখদহ নদীর নাব্যতা না থাকায় এর অববাহিকায় পলি পরে বিশালাকার কৃষিজমির সৃষ্টি হয়েছে। এসব কৃষিজমিতে পানির অভাবে কৃষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ফসলাদি চাষ করতে পারতেন না। ফসল ফলানোর জন্য আগে বৃষ্টির পানিই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই ডিজেল বা বিদ্যুৎচালিত শ্যালোমেশিন দিয়ে পানি সেচ দিয়ে চাষাবাদ করা হচ্ছে। ফলে উপজেলার উত্তপ্ত বালুচর আর অনাবাদি ফেলে না রেখে সেখানে কৃষকরা নানা ধরনের ফসল ফলাচ্ছেন। আগের চেয়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল বেশি চাষাবাদ করে এখন লাভবান হচ্ছেন চাষিরা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউ কেউ বছর চুক্তিতে জমি নিয়ে ৫০ থেকে ৩০০ বিঘা পর্যন্ত জমি প্রকল্প আকারে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করছেন। এসব ফসল ঘরে তুলে তারা লাভবান হচ্ছেন। তাদের অনেকে চরের বাড়িঘরের পাশাপাশি সন্তানদের শহরে রেখে পড়াশোনা ও সেখানে বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এখন বাঙালি ও যমুনা নদীর চরাঞ্চলের যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই শুধুই ফসল আর ফসল। এগুলোর মধ্যে মরিচ, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, নানা জাতের ধান, বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজি, কলাই, মিষ্টি আলু ও গোল আলু, গম, তিল অন্যতম। এসব ফসল বিক্রির সঙ্গে জড়িত থেকে উপজেলার শত শত বেকার যুবকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। ঘুরছে অর্থনীতির চাকা। পরিবর্তন আসছে জীবনযাত্রায়।
সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, বিভিন্ন ফসলের মধ্যে এ বছর উপজেলায় ৩ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে মরিচ আবাদ হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সাত হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা আবাদ হয়েছে। ১৩০ হেক্টর জমিতে মিষ্টি কুমড়ার আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ১৫ থেকে ২০ টনের বেশি মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন হচ্ছে; যা বাজারে ৫০ টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি হয়। ২০০ হেক্টর জমিতে গম, ১০৩০ হেক্টর জমিতে মসুর ডাল, ৫৩০ হেক্টর জমিতে মাসকলাই, ৭৭০ হেক্টর জমিতে খেসারি, ৯১৪ হেক্টর চিনাবাদাম এবং ১৫ হেক্টরে তিলের আবাদ হয়েছে। এর প্রায় অধিকাংশই চরাঞ্চলে চাষাবাদ হয়েছে।
গত বছর ৩৫ বিঘা জমিতে মিষ্টি কুমড়া আবাদ করেছেন উপজেলার হাটশেরপুর ইউনিয়নের দীঘাপাড়া চরের কৃষক মোস্তফা মিয়া। তিনি জানান, মাত্র তিন মাসে সাড়ে ১০ লাখ টাকা লাভ পেয়েছিলেন। এ বছর ৪৫ বিঘা জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করেছেন। এবার আরও বেশি লাভের আশা করছেন। তার মতো এই চরেই মান্না মিয়া ৪০ বিঘা, হবিবর মিয়া ৭০ বিঘা এবং আমরুল মিয়া ৬০ বিঘা জমিতে মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করেছেন।
চরাঞ্চলে এখন কৃষকরা ২০০ থেকে ৩০০ বিঘা পর্যন্ত জমি প্রকল্প আকারে নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ফসল চাষাবাদ করছেন জানিয়ে মোস্তফা মিয়া বলেন, ‘এগুলো সম্ভব হচ্ছে শ্যালো ইঞ্জিনে ফিতা পাইপের সাহায্যে উঁচু-নিচু জমিতে পানি সেচের মাধ্যমে এবং আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল চাষাবাদের কারণে। এবারও কমবেশি সব কৃষকের জমিতে ভালো ফলন হয়েছে।’
উপজেলার পাইকারি কাঁচামাল ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, শুধুমাত্র যমুনা চরের ফসলের ওপর নির্ভর করেই যমুনা তীরের প্রায় পাঁচটি এলাকায় ফসল বিক্রির আড়ত গড়ে উঠেছে। প্রতিটি আড়তে প্রতিদিন হাজারের বেশি মণ বিভিন্ন ধরনের ফসল আমদানি হচ্ছে। এসব কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।
চরাঞ্চল এখন মানুষের জন্য অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদ বলে উল্লেখ করেছেন সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরামর্শে নানা জাতের উচ্চ ফলনশীল ফসল চরের উর্বর মাটিতে প্রচুর পরিমাণে ফলছে। এসব ফসল বিক্রি করে স্বাবলম্বী লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।’
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//