Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Friday, 10 Jan 2025 06:00
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়

ড: মিহির কুমার রায়: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদন ৫ই জানুয়ারী প্রকাশ করেছে বিবিএস। এতে বলা হয়েছে দেশে নারীর চেয়ে বেশি বেড়েছে পুরুষ বেকারের সংখ্যা। এছাড়া দেশের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বেড়েছে বেকার মানুষের সংখ্যা। বিদায়ী বছরের শুরুতে বেকার মানুষের কম থাকলেও বছর শেষে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এতে বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজারে। এ সময়ে কৃষি,  শিল্প ও সেবা সব খাতেই কমেছে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। ২০২৩ সালের এই সময়ে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। এর মানে গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে,  বেকার জনগোষ্ঠী মূলত তারাই যারা গত সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং গত এক মাস ধরে কাজ খুঁজেছেন, কিন্তু মজুরির বিনিময়ে কোন কাজ পাননি। তারা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বিবিএস এই নিয়ম অনুসারেই বেকারের হিসাব দিয়ে থাকে।

এদিকে বিবিএস এবার দুইভাবে শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এ বিষয়ে বিবিএস জানিয়েছে, শ্রমশক্তির তৃতীয় প্রান্তিকের ফলাফলটি ১৩তম এবং ১৯তম আইসিএলএস (পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন) অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। আইএলও কর্তৃক প্রণীত ১৩তম এবং ১৯তম আইসিএলএসএ কর্মে নিয়োজিত প্রাক্কলনে পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত যারা শুধুমাত্র নিজেদের ভোগের জন্য কাজ করেন তাদেরকে আইএলওর ১৩তম গাইড লাইন হিসেবে কর্মে নিয়োজিত হিসেব করা হয়, আর যারা মজুরি বা মুনাফার জন্য কাজ করেন তাদেরকে আইএলও’র ১৯তম গাইড লাইন হিসেবে কর্মে নিয়োজিত হিসেব করা হয়। বিবিএসের ১৯তম আইসিএলএস হিসাবে, ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজারে। আর আগের গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রথম প্রান্তিকে বেকার ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। তিন মাস পর দ্বিতীয় প্রান্তিকে বেকার বেড়ে হয় ২৬ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২০ হাজার বেকার। আর ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে দেশে বেকার মানুষ ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। সেই হিসেবে বছরের ব্যবধানে বেকার বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। তৃতীয় প্রান্তিকের হিসেব অনুযায়ী, দেশে নারী বেকারের চেয়ে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। বিবিএস হিসাব অনুসারে, গত সেপ্টেম্বর মাস শেষে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৯০ হাজার, আর নারী বেকার ৮ লাখ ৭০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে পুরুষ বেকার ১৬ লাখ ৪০ হাজার, আর নারী বেকার ছিল ৮ লাখ ৫০ হাজার। সেই হিসেবে পুরুষ বেকার বেড়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার, নারী বেড়েছে ২০ হাজার। বিবিএস বলছে, শ্রমশক্তিতে এখন ৫ কোটি ৯১ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। অথচ ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে ছিল ৬ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে শ্রমশক্তি অংশগ্রহনকারী মানুষের সংখ্যা কমেছে ১৯ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার। এছাড়া শ্র্রমশক্তির বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। তারা কর্মে নিয়োজিত নয়, আবার বেকার হিসেবেও বিবেচিত নয়। এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার। তারা মূলত সাধারণ ছাত্র, অসুস্থ ব্যক্তি, বয়স্ক নারী-পুরুষ, কাজ করতে অক্ষম ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং কর্মে নিয়োজিত নন বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক গৃহিণী। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে যুব শ্রমশক্তি ২ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার। এর মধ্যে পরুষ ১ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার, আর নারী ১ কোটি ২২ লাখ ৭০ হাজার। বছরের ব্যবধানে যুব শ্রমশক্তি জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কমেছে। জরিপ অনুযায়ি, ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে যুব শ্রমশক্তি ছিল ২ কোটি ৬১ লাখ ৯০ হাজার, যা ২০২৪ সালের একই সময়ে কমে হয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার। সেই হিসেবে যুব শ্রমশক্তি কমেছে ২১ লাখ ১৭ হাজার। 

আইএলওর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে উদ্ভূত বিতর্ক প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ আইএলওর সদস্য হিসেবে এ সংজ্ঞায় সম্মতি দিয়েছে এবং এ সংজ্ঞা বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য, যে কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ এটি অনুসরণ করে। এর কারণ হলো আন্তর্জাতিক মানদন্ড বজায় রাখা, আমাদের দেশের কর্মসংন্থানের সংজ্ঞা অন্য দেশের সংজ্ঞার সঙ্গে যেন আলাদা না হয়ে যায়। এখন আয়ের ক্ষেত্রে সেটি আসলে দারিদ্র্য, ক্রয় ক্ষমতা এবং অসমতাকে বোঝায়। শ্রম বাজারের জরিপে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করার সময় একজন শ্রমিক হয়তো সপ্তাহে ১/২/৩ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন, কিন্তু দেখা যাবে যে জরিপ শেষ হওয়ার পরই সে পরের তিন সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা কাজ করছেন। এখানে সময়ের ব্যাপারও রয়েছে, যেমন গ্রামীণ এলাকায় কৃষি কাজের ক্ষেত্রে ফসল কাটা ও ঘরে তোলার সময় যদি জরিপ চালানো হয়, তাহলে সবাই বলবে তারা কাজ বেশি করেছে, অন্য মৌসুমে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে তো বলতে পারবে না বেশি কাজ করেছে, এক্ষেত্রে অনেক ইস্যু থাকে, যে কারণে এটি আসলে বলা যায় আংশিক দৈবচয়নের ভিত্তিতে করা হয়। তাই কিছু ক্ষেত্রে এটি যেমন পরিপূর্ণ তথ্য দেয়, আর কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য দেয় না। এখন বেকারত্ব কি আসলেই কমেছে? এটা আইএলওর বেকারত্বের সংজ্ঞার চেয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ, এক্ষেত্রে বিবিএসের তথ্য কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে সেখানে তো আইএলওর ভূমিকা নেই এবং এ তথ্য কতটা নির্ভুল ছিল সেটিওতো প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। আবার বিবিএস চাইলেই কি প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে পারবে, এক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক ইস্যুও জড়িত নয়? 

আইএলও এ বিষয়ে নিশ্চিত নয় এবং এটি বলার দায়িত্ব আইএলওর নয় বলে সংন্থাটি দাবি করেছে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে অমিল থাকার যে প্রশ্নটি উঠেছে তাতে আইএলওর সংজ্ঞার আলোকে বিবিএসের জরিপ এবং বেকারত্ব নিয়ে তথ্য নতুন করে বিতর্কেরই জন্ম দিয়েছে। এখানে আরও উল্লেখ্য যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রায় চার বছর অতিবাহিত হতে চলেছে, আর আছে মাত্র এক বছর। এদিকে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট, নিত্য পণ্যের চড়া দাম, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি এবং সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে আগামী এক বছরে বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ পাঁচটি ঝুঁকি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সাম্প্রতিকতম ‘গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, দারিদ্র্য নিরসনে চিহ্নিত কৌশলগুলোর সর্বাগ্রে রয়েছে জিডিপিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হার অর্জন এবং এ হার গড়ে প্রতি বছর ৮ শতাংশ, সরকারি হিসাবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৯৪ শতাংশ (বাজেট বক্তৃতা ২০২২-২৩), ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি, চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ৬.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, বিশ্বব্যাংকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৪.১ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, দারিদ্র্য নিরসনে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে যে উচ্চ হারে গড়ে প্রতিবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার অর্জনের (আট শতাংশ) প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারত্বের হার হ্রাসের ওপর যে জোর দেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ২০১৬-১৭ তে দেশে শ্রমশক্তির যুব বেকারত্ব হারের উল্লেখ ছিল মোট শ্রমশক্তির ১০.৬ শতাংশ, এ হার বেড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। আইএলওর তথ্যের বরাত দিয়ে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে তরুণ বেকারের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৫ লাখ। অর্থনীতির সংজ্ঞা মতে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসের একটি উপায় হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত হলেও দেশে এ কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে কাঙ্খিত সাফল্য বয়ে আনতে পারছেনা যার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অর্থ বরাদ্দের স্বল্পতা, উপকারভোগী নির্বাচনে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংন্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। এই ধরনের একটি পরিস্তিতিতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ কতটুকু গবেষকদের স্বস্তি’ দেবে তা ভেবে দেখার বিষয়। তবে বিভিন্ন উৎসের একি বিষয়ের তথ্যের ভিন্নতা নুতন কিছু নয় এবং এ ব্যাপারে গবেষকদের নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে হবে। তবে বেকারত্ব হ্রাসে সরকারের কর্মসূচী যা বর্তমানে চলমান রয়েছে তার শতভাগ বাস্তবায়ন জরুরী এবং সরকারের আগামী জুন মাসে বাজেট আসছে তাতে বেকারত্ব নিরসনের বিষয়টি যেন অধিক গুরুত্ব পায় তা বিবেচনায় রাখতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//