নিজস্ব প্রতিবেদক: কাস্টমস পদ্ধতি সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অংশীজনদের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপনের লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে একযোগে পালিত হয় আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উদারিকরণের অংশ হিসেবে পণ্য আমদানিতে শুল্ক হার হ্রাস পেলেও কাস্টমসের গুরুত্ব কোন অংশেই হ্রাস পায়নি বরং দেশের সার্বিক নিরাপত্তা, নাগরিক স্বাস্হ্য ও পরিবেশের সুরক্ষা, আমদানি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানিকে উৎসাহিতকরণসহ বাণিজ্য সহজীকরণে অপরিহার্য ভূমিকার জন্য কাস্টমসের গুরুত্ব পূর্বের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। World Customs Organization (WCO) এর ১৮৬টি সদস্য দেশ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা এবং গুরুত্বের সাথে একযোগে প্রতিবছর এ দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কেন্দ্রীয়ভাবে এবং ঢাকাসহ সারা দেশের সকল মাঠ পর্যায়ের দপ্তরসমূহে স্থানীয়ভাবে দিবসটি উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হচ্ছে।
আমদানি শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে General Agreement on Tariffs and Trade (GATT) স্বাক্ষরিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় কাস্টমস সংক্রান্ত নীতিমালা বিশ্লেষণের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে ১৩টি ইউরোপিয়ান দেশ কর্তৃক একটি স্টাডি গ্রুপ তৈরির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই স্টাডি গ্রুপের সিদ্ধান্তের আলোকেই পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী কাস্টমসের কার্যক্রমে uniformity এবং harmonization আনয়নের লক্ষ্যে Customs Co-operation Council (CCC) যা পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে World Customs Organization (WCO) নামে আত্মপ্রকাশ করে। Customs Co-operation Council এর প্রথম সভার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার অভিপ্রায়ে ২০০৯ সাল হতে প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস উদযাপিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সাল হতে বাংলাদেশ WCO এর সক্রিয় সদস্য।
আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস-২০২৫ এর প্রতিপাদ্য ও বাংলাদেশ:
কাস্টমসের পরিবর্তিত ভূমিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে WCO প্রতি বছর আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস উদযাপনের জন্য প্রাসঙ্গিক একটি প্রতিপাদ্য নির্বাচন করে থাকে। দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সমৃদ্ধি অর্জনে কাস্টমসের অপরিহার্য ভূমিকার গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে:
“Customs Delivering on its Commitment to Efficiency, Security and Prosperity”
“কাস্টমস সেবায় প্রতিশ্রুতি
দক্ষতা নিরাপত্তা প্রগতি”
রাজস্ব আহরণের ঐতিহাসিক ভূমিকার পাশাপাশি বৈধ বাণিজ্য সহায়তাকরণের উদ্দেশ্যে নতুন প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষতার উন্নয়ন, অপবাণিজ্য প্রতিরোধ, জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান এবং দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা ও বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অংশীদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশে দেশে কাস্টমসের এরুপ ভূমিকা অক্ষুণ্ন রাখার যে প্রত্যয় এবং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যতে উন্নততর সেবা প্রদানের যে অঙ্গীকার তা অর্জনে সদস্য দেশসমূহকে কার্যকরী ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করতেই WCO কর্তৃক অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস-এর এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বহির্বিশ্বের সাথে মিল রেখে বাংলাদেশ কাস্টমসও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও সমৃদ্ধি অর্জনে তার ঐতিহ্যগত ভূমিকা ও ভবিষ্যত প্রয়াসের উপর গুরুত্বারোপ করে আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস, ২০২৫ উদযাপন করছে।
উল্লিখিত প্রতিপাদ্যের আলোকে দক্ষতা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ কাস্টমস ইতোমধ্যে কাস্টমস কম্পিউটার সিস্টেম (ASYCUDA World) এর উন্নয়ন, Bangladesh National Single Window, Time Release Study (TRS) পরিচালনা, পণ্যচালান খালাসোত্তর নিরীক্ষা (Post Clearance Audit), বাধ্যতামূলক ইলেকট্রনিক পেমেন্ট , Advance Ruling, E-auction , অটোমেটেড বন্ড ব্যবস্থা চালুকরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহন করেছে যার সুফল ইতোমধ্যে অংশীজন ভোগ করছেন।
দক্ষতা উন্নয়ণের পাশাপাশি বৈশ্বিক নিরাপত্তা মানদন্ড অর্জনেও বাংলাদেশ কাস্টমস নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রিত এবং নিষিদ্ধ পণ্যের আমদানি-রপ্তানি প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ, মূদ্রা পাচার প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ, দূর্যোগ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের চলমান উন্নয়ন ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ কাস্টমস নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। রাজস্ব আহরণ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর আমদানি পর্যায়ে আরোপযোগ্য শুল্ক-কর যৌক্তিকীকরণ, দেশীয় শিল্পের বিকাশ, রপ্তানি প্রসার ও নির্বিঘ্নকরণ মেধাসত্ত্ব লঙ্ঘিত পণ্যের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ, বাণিজ্য সহজীকরণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশীয় অবস্থান সুসংহতকরণ ও স্বার্থ রক্ষা, সীমান্ত বাণিজ্য সমন্বয় কমিটি গঠন, যাত্রীসেবা উন্নয়ন ইত্যাদি তার মধ্যে অন্যতম।
আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস-২০২৫ এর প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কাস্টমস বিনির্মাণ করা হবে মর্মে আমরা আশাবাদী। আমাদের প্রত্যাশা ভবিষ্যতে অংশীজন ঘরে বসেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ কাস্টমস সেবা নিতে পারবেন। ডাটা এনালিটিক্স, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং মেশিন লার্নিং এর ন্যায় প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে আরো সুনিশ্চিত এবং নির্ভুল করা হবে । বিভিন্ন Non-Intrusive inspection tools and equipment যেমন: কন্টেইনার স্ক্যানার, ব্যাগেজ স্ক্যানার , হিউম্যান বডি স্ক্যানার, প্যালেট স্ক্যানার, Electronic Cargo Tracking System এর মাধ্যমে বৈধ বাণিজ্যের ধারাকে নিরবচ্ছিন রেখে অপবাণিজ্যকে রোধ করা হবে, উদ্ভাবনী দক্ষতাকে প্রতিরক্ষণ করা হবে ও উদ্যোক্তাগণকে যথাযথ নীতি সহায়তার মাধ্যমে উৎসাহিত করা হবে, ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করা হবে, এবং অভ্যন্তরীণ বাজারকে রাখা হবে নিরাপদ ও প্রতারণামুক্ত। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ কাস্টমসের কার্যক্রম হবে Revised Kyoto Convention (RKC), TFA কে ভিত্তি করে একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।
রাজস্ব আহরণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিল্পের বিকাশ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত পণ্যের গমনাগমন নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে সদা জাগ্রত বাংলাদেশ কাস্টমস। গর্বিত আগামীর নেতৃত্বদানের জন্য পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন, কর্মকর্তাদের পেশাগত জ্ঞান ও গৌরবময় সংস্কৃতির পারষ্পরিক বিনিময় ও প্রসারের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে আগামী দিনের আধুনিক কাস্টমস।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//