Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়
Thursday, 06 Feb 2025 06:00
Biniyougbarta | বিনিয়োগবার্তা: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বিনিয়োগের খবর প্রতিদিন সবসময়

ড: মিহির কুমার রায়: উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চলছে বিশৃঙ্খলা। এ কারণে বড় ধাক্কা লেগেছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)। যার শুরু হয়েছিল গত অর্থবছরের মাঝামাঝিতে। জাতীয় নির্বাচনের চাপে সে সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন ছিল কম। সেই ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং সরকার বদলের ঘটনায় সংকট গভীর  হয়। অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় উন্নয়ন কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় এডিপি কাটছাঁটের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ফলে এবার বড় অঙ্কের বরাদ্দ ছেঁটে ফেলতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। বিগত সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির বাস্তবায়ন ছিল অত্যন্ত কম। পুরো অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করেছে ২ লাখ ৫ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা,  যা মোট সংশোধিত এডিপিব রাদ্দের ৮০ দশমিক ৯২ শতাংশ। ওই অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির বাস্তবায়ন হার ছিল ৮৫ দশমিক ১৭ শতাংশ।

সেই ধারাবাহিকতা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও অব্যাহত আছে। এখনো গতি ফেরেনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে। চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে  (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)  বাস্তবায়ন হয়েছে ১৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত কয়েক বছরের মধ্যে এডিপির বাস্তবায়ন নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে এখন (উৎস্য:  বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) অগ্রগতি প্রতিবেদনে, ২০২৪)। আইএমইডি বলেছে,  চলতি অর্থবছর এডিপিতে মোট বরাদ্দ দেওয়া আছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি,  বৈদেশিক সহায়তা ১ লাখ কোটি এবং  বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ১৩ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। গত ৬ মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে ৫০ হাজার ২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয়েছিল ৬১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ মাসে খরচ হয়েছিল ৬০ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৬ হাজার ৯৬২ কোটি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে এডিপি বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকা অর্থাৎ ১০ শতাংশের নিচে বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো,  নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, সেতু বিভাগ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, প্রধান উপদেষ্ঠার কার্যালয়,  কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ,  সুরক্ষা সেবা বিভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এছাড়া পরিবেশ-বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়,  সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। আরও আছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়,  নির্বাচন কমিশন সচিবালয়,  পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়।  এদিকে এডিপি বাস্তবায়নে এগিয়ে থাকা ৫০ শতাংশের ওপরেও বাস্তবায়ন করা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো- মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এখানে উল্লেখ্য চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে আর্থিক সংকট, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন,  অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ সহ নানা কারণে চলমান ১ হাজার ৩৫২ প্রকল্পে বিরাজ করছে স্থবিরতা। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিকভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)  বাস্তবায়ন এবং বৈদেশিক অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে। এ কারণে কর্মসংস্থান, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি,  অর্থ প্রবাহের স্বাভাবিক গতি কমা এবং প্রকল্পগুলো থেকে প্রত্যাশিত সুফল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি প্রকল্পগুলোয় মেয়াদ ও  ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব বলেন,  বলতে গেলে এডিপিভুক্ত সব প্রকল্পেই স্থবিরতা আছে। এর মূল কারণ হলো-চাহিদামতো অর্থ ছাড় না হওয়া। এখন কোন প্রকল্প প্রয়োজনীয় বা কোনটি রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়েছিল,  সেগুলোর যাচাই-বাছাই না করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। দেশের সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের অন্যতম স্থান হলো প্রকল্প। সেই প্রকল্পই যদি বাস্তবায়ন না হয়,  তাহলে কর্মসংস্থান কমবে। এছাড়া দেশের উৎপাদনও কমবে। যেমন:  বাংলাদেশ স্টিল মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ইতোমধ্যে বলেছে তাদের বিক্রি ৫০ শতাংশ কমেছে। একই অবস্থা সিমেন্ট,  ইট সহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে। এটি মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হওয়ার কারণেই হচ্ছে। এডিপির বাস্তবায়ন কম হওয়ায় ত্রিমুখী প্রভাব পড়বে। প্রথমত কর্মসংস্থান কমবে। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তৃতীয়ত,  প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সময়মতো না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে অবকাঠামোগত সমস্যার সৃষ্টি হবে। সব মিলিয়ে মোটা দাগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। সরকারের উচিত দ্রুত একটি স্টাডি করে দেখা আগামী এক বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হলে এর কী প্রভাব পড়বে সে অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ করতে হবে।

চলতি অর্থবছরে অনুমোদন পাওয়া নতুন প্রকল্পগুলোয়ও বরাদ্দ মিলছে না। পাশাপাশি চলমান অন্যান্য প্রকল্পেও আছে ধীরগতি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে সাধারণ সরকারি সেবা খাতে মোট ৩৫টি প্রকল্প রয়েছে। এছাড়া প্রতিরক্ষায় ১২, জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষায় ২৭,  শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৬৮, কৃষিতে ১৩৫, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ৯৪,  পরিবহণ ও যোগাযোগে ২২৮ এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১০২টি প্রকল্প আছে। আরও আছে পরিবেশ,  জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১৩৯, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলিতে ২৬৬, স্বাস্থ্যে ৬৩, ধর্ম-সংস্কৃতি ও বিনোদনে ৫৭,  শিক্ষায় ১১৯, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে ৫৪ এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৫৫টি প্রকল্প। পাশাপাশি সমীক্ষা,  কারিগরি সহায়তা এবং স্ব-অর্থায়নের প্রকল্পও রয়েছে। এডিপিতে এসব প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া আছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বলছে, প্রকল্পের বাস্তবায়ন কম হওয়ায় চলতি অর্থবছরের অর্থ ছাড় কমে গেছে। গত চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর)  উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ১২০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ঋণ ১০১ কোটি ১৩ লাখ এবং অনুদান ১৯ কোটি ৬ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ১৬২ কোটি ৬১ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঋণ ১৫৬ কোটি এবং অনুদান ৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এছাড়া নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতিতেও বিরাজ করছে দুরবস্থা। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে নতুন ঋণ অনুদানের প্রতিশ্রুতি এসেছে ২৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। কিন্তু গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রতিশ্রুতি ছিল ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ ডলার।

এখন দেশে কেয়ারটেকার সরকার ক্ষমতায় রয়েছে এবং আগামী জুন মাসে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষনার কথা রয়েছে। এ  ব্যাপারে সরকার চলতি উন্নয়ন বাজেটে কাটসাট করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। নতুন আগামী বাজেটে সরকারের জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ্। কারন একদিকে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি অপরদিকে আইএমএফ এর চাপ অবশ্যি বাজেটকে প্রভাবান্বিত করবে।  আবার আগামী বছরের মাঝামাঝিতে দেশে সংসদিয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে যেখানে সরকার পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই কৌশলগতভাবে বছরটির গুরুত্ব অপরিসীম। বৈশ্বিক কারনে সরকার ব্যয়ের ব্যাপারে সংকোচন নীতি গ্রহন করেছে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য যা সাম্প্রতিক মুদ্রানীতিতে উল্লেখিত হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি তিন ঝুঁকিতে রয়েছে যেমন অব্যাহতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া,   ডলারের বিপরীতে টাকার মানে নিম্নমুখীর প্রবণতা ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ছে যা অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত করে যাচ্ছে। এ কারণে সরকারের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে,  বাড়তি ব্যয় মেটাতে বেড়েছে সরকারের ঋণ নির্ভরতা এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়,  রাজস্ব বাড়ানো ও ভর্তুকি কমানোর মাধ্যমেই  এই চাপ কমানো সম্ভব। অর্থনীতিবিদগন বলছে বিদেশি ঋণের চাপ কমাতে হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তবে কর আহরণ বাড়াতে যে ধরনের সংস্কার দরকার তা এখনও করা হয়নি। রাজস্ব খাতে কার্যকর সংস্কার ছাড়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।

একেতো এডিপিতে বরাদ্ধ কম, তারপর সরকারের রক্ষনশীল মুদ্রানীতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি,  সরকারের অত্যাধিক লোন নির্ভরতা ইত্যাদি সার্বিক পরিস্থিতির জন্য কিছুটা স্পর্শকাতর বিধায় আগামী ছয় মাসে (জানুযারী-জুন)  উন্নয়ন বাজেটের (এডিপি)  ৮২ শতাংশ প্রচলিত আর্থিক কাঠামোতে কিভাবে ব্যয়িত হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বৈশ্বিক এই ক্রান্তিকালে সরকার ব্যয় সাশ্রয়ী নীতি গ্রহন করলেও বাজেটভুক্ত উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয়িত করতে সরকার তো নিরুৎসাহিত করেননি। এখন শুধু প্রয়োজন দক্ষতার সাথে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলা যা হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাই প্রশাসনিক মন্ত্রনালয়, পরিকল্পনা কমিশন,  অর্থ মন্ত্রনালয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা একযুগে সরকারী নির্দেশনা মেনে এগিয়ে আসবে উন্নয়নের অংশীদার হয়ে এই আশা রইল।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//