ড: মিহির কুমার রায়: মুদ্রানীতি হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত নীতি যা দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংন্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে ও সুদের হার তথা অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রচলিত নিয়মানুসারে বছরে দুবার (জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বন) মুদ্রানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের এবং বিশ্বের অর্থনীতি যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে তাতে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা বছরে একের অধিক হলে অর্থনীতির জন্য ভালো। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে বছরে ছয়বার (দুই মাস অন্তর ) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে গত কয়েক মাস ধরেই বহিঃঅর্থনীতির প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি, তারল্য এবং বিনিময় হারে বড় ধরনের চাপ অনুভূত হতে দেখা গেছে বিশেষত ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ এবং সুশাসনের চ্যালেঞ্জের কারণে আর্থিক পরিস্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মুদ্রানীতি প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভেতর ও বাইরের অংশীজনের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তারা বিভিন্ন পক্ষের পাশাপাশি প্রথম বারের মতো চট্টগ্রামের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে দেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য নীতিগত পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছে। সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং।
জানা গেছে, আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য মুদ্রানীতি (এমপিএস) ঘোষণা করার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সম্ভাব্য তারিখের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কর্মকর্তারা বলেন, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য সঙ্কোচনমূলক ধরন বজায় রেখে এবং মূল্যস্ফীতি মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এমপিএস প্রণয়ন করা হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়া ড. আহসান এইচ মনসুর প্রথমবারের মতো মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন। এবারের মুদ্রানীতি প্রনয়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিনিময় হার এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। ২০২৫ সালের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসছে মূল্যস্ফীতি যা বিদায়ী ২০২৪ সালেও ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে বছরজুড়ে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এখনও দ্রব্যমূল্য কমাতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন থেকে নীতি সুদের হার কয়েকবার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, সদ্য সমাপ্ত বছরের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি আগের মাসের ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ থেকে কিছুটা কমে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমেছে। গত বছরের ১৮ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য সর্বশেষ মুদ্রানীতি প্রকাশ করে। মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার নীতি সুদহার প্রয়োগের মাধ্যমে বাজারের অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। যেহেতু এটি কোনো ফল দিতে পারেনি। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে আর কোনো হাতিয়ারও নেই, তাই বর্তমানে প্রধান সমস্যা সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পক্ষগুলোকে নিয়ে সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে।’ মুদ্রানীতিতে কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত জানতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়, দরকার সমন্বিত পদক্ষেপ। আসন্ন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও কৃষকের ঋণ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া। এছাড়া বেসরকারি ঋণে সময়োপযোগী টার্গেট নির্ধারণ এবং ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে পদক্ষেপের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া। একইসঙ্গে বিনিময় হারের স্থিতিশীলতার বিষয়ে রোডম্যাপ এবং বকেয়া পেমেন্ট কেমন আছে সেগুলো পরিশোধের বিষয়ে পরিকল্পনা তুলে ধরা। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া সত্ত্বেও দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকার বিষয়ে অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি। এর বাইরে রাজস্ব নীতি, চাহিদা ও জোগানের ব্যবধান কমিয়ে আনা, পণ্যের মজুদ ঠিক রাখা, সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মতো বিষয়গুলোও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আমাদের অর্থনীতি অন্যান্য দেশের মতো সুদের হারের প্রতি স্পর্শকাতর নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু নীতি নেয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতির মাত্রা কিছুটা কমবে। তবে এজন্য সময় লাগবে।’
এরপরে আসে রিজার্ভ ও ডলারের বিনিময় হার; এতে দেখা যায় ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে প্রান্তিক ভিত্তিতে বাংলাদেশের রিজার্ভ মুদ্রা বা মুদ্রাবাজারে থাকা তারল্যের সীমা বেঁধে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। যদিও আইএমএফ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪ সালের প্রথম তিন প্রান্তিক শেষে বাজারে প্রকৃত রিজার্ভ মুদ্রার পরিমাণ ছিল আইএমএফের বেঁধে দেয়া সীমার চেয়ে কম। গত মার্চ শেষে আইএমএফের বেঁধে দেয়া রিজার্ভ মুদ্রার সীমা ছিল ৪ লাখ ১৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এসময়ে বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ মুদ্রার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। সর্বোচ্চ সীমার তুলনায় রিজার্ভ মুদ্রা কম ছিল ৬০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। গত জুনে আইএমএফের বেঁধে দেয়া ৪ লাখ ২৫ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা সীমার বিপরীতে প্রকৃত রিজার্ভ মুদ্রার পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে পার্থক্য ছিল ১২ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ মুদ্রার পার্থক্য ছিল ৩০ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত নোট ও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা থাকা ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থ তথা সিআরআরের পরিমাণই হচ্ছে রিজার্ভ মুদ্রা। চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে ২ শতাংশ। যদিও গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ মুদ্রা প্রবৃদ্ধির ধারায় না থেকে বরং ঋণাত্মক হয়েছে। গত ১ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ মুদ্রা কমেছে ৪৭ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। ১৫ সেপ্টেম্বর দেশে রিজার্ভ মুদ্রা ৩ লাখ ৬৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা ছিল। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক তথা মাইনাস ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আইএমএফের সীমা অনুসারে, এ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ১৯০ কোটি এবং ডিসেম্বর শেষে ৪ লাখ ১৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রিজার্ভ মুদ্রা রাখার সুযোগ রয়েছে। ডলারের বিনিময় হারে দেখা যায় চলতি বছরে আগের মতো ডলারের দাম ধরে না রেখে ধীরে ধীরে তা বাজারভিত্তিক করার দিকে নেওয়া হয়েছে। এতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১০ টাকা হলেও ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলার কিনছে ১২২-১২৩ টাকা দামে। ফলে এর চেয়ে বেশি দামে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। ডলারের দাম তিন দফায় কমানো হয়েছে। এখন ডলার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দামে। মাঝে অস্থিরতায় খোলা বাজারে ডলারের দাম ওঠে ১২৭ টাকায়, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দর। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস। ২০২২ সালে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে নেতিবাচক ধারা থাকলেও এ বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংন্থাটির মতে, দেশের প্রবাসী আয়ে এখন ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ বছরের শেষে আনুষ্ঠানিক তথা বৈধ চ্যানেলে বাংলাদেশের মোট প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ২৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার যদিও হুন্ডির সঙ্কট রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়ে, ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, অর্থবছরের প্রথম চার মাসের শেষে (জুলাই-অক্টোবর) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৬। এই হার গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু তাই নয়, এ সময় শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। এছাড়া ২০২৩ সালের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানির ‘এলসি সেটেলমেন্ট’ কমেছে ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ঋণপত্রের নিষ্পত্তি হয়েছে কম। ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমলে বাজারে জোগান কমে দাম বেড়ে যায়, এটাই অর্থনীতির চিরাচরিত নিয়ম। অন্যদিকে মূলধনি ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও সক্ষমতা কমে যায়। এসব কিছুর প্রভাব পড়ে প্রবৃদ্ধির ওপর। বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে যা ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামবে। সেটা হলে তা হবে দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি, কেবল কোভিড-১৯ এর ২০২০-২১ অর্থবছর বাদে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ হারের ভারিত গড় ছিল ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের সুদ হার এখন ১৪-১৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকছে। আবার সংকটে থাকায় গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না কয়েকটি ব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান এখন কর্মীদের বেতনও দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে প্রকট হয়ে উঠেছে তারল্য সংকট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ ছিল ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। আগস্ট শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৭০২ কোটি টাকায়। এ হিসাবে এক মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি খাতের উৎপাদনকে চাপে রেখেছে জ্বালানি সংকট। এ চাপকে আরো বাড়িয়ে তোলে সাম্প্রতিক শ্রম অসন্তোষ। আবার ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক অস্থিরতারও ভুক্তভোগী বেসরকারি খাত। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোই ভুগছে সবচেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট মোকাবেলার বড় একটি উপায় হলো ব্যাংক ঋণ। কিন্তু ব্যাংকে উচ্চ সুদহার ও তারল্য সংকটের কারণে সেটি পাওয়াও মুশকিল হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বেসরকারি খাত তীব্র তারল্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। ফলে এ খাতটি তারল্য সংকটে ভুগলে ব্যবসা সম্প্রসারণ হবে না এবং এতে নতুন করে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বছরের শেষের দিকে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে। এ কারণে বছরের অন্য সময় আইএমএফের বেঁধে দেয়া সর্বোচ্চ সীমার থেকে রিজার্ভ মুদ্রার প্রকৃত পরিমাণ কম রাখা হয়।
সার্বিক বিবেচনায় আগামী মুদ্রানীতির বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত ১. আগামী ছয় মাসের মধ্যে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি এবং সামাজিক সুরক্ষানীতি এই তিনটিকে একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমাতে হবে যাতে পণ্য আমদানি ব্যয় কমে; ২. বাজারে মুদ্রা সরবরাহের গতি নিয়ন্ত্রণ করে মুদ্রাস্ফীতির ওঠানামা করণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে সূত্র তা আর কাজে আসছে না। নীতি সুদহার ১০ শতাংশে তুলেও মূল্যস্ফীতিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। তাই আপাতত এই ভোঁতা হাতিয়ার সাবধানে চালাতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আসন্ন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার আর বাড়ছে না। তবে এখনই না কমিয়ে উৎপাদন খাতে কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ আসতে পারে; ৩. দেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে আরও বড় দুটি কারণ রয়েছে। যার একটি হচ্ছে ডলার সংকট, অপরটি বাজার ব্যবস্থাপনা। ডলার সংকটের ফলে আমদানি, ভোগ্যপণ্যের জোগান ও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, এমন পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতিই এখন বেশি তা শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে কমানো মোটেই যৌক্তিক নয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে বাজার ব্যবস্থাপনার বড় ভূমিকা থাকে। তাই বাজার ব্যবস্থপনা যদি উন্নত করা না যায়, তাহলে শুধু খুচরা পর্যায়ে মূল্য বেঁধে দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। খুচরা পর্যায়ে যারা আছে তারাতো বাজার কারসাজির এই খেলার মধ্যে নেই। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে ডলার সংকট কাটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে, ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে ডলার না আসা ও হুন্ডি বড় বাধা। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের দরের পার্থক্য এত বেশি হয়ে গেছে, মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলেই রেমিট্যান্স বেশি পাঠাতে চাইছে। এখানে পরিবর্তন দরকার হবে; ৪. অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নেতৃত্ব দিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগে বাস্তবতার নিরীখে লক্ষ্য নির্ধারণ ও বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া আর্থিক খাতের সংস্কারের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে রোডম্যাপ তুলে ধরা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা; ৫. নীতি সুদ বাড়ানোর পাশাপাশি ভ্যাট বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে নীতিসুদ বৃদ্ধির ফল পাওয়া যাচ্ছে না, তার মতে, মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ের মাধ্যমে এগোতে হবে। তা না করে কেবল নীতিসুদ বাড়ানো হলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; এর জেরে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব পড়বে; ৫. সরকারের কাছে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ যথা প্রথমত: বানিজ্য সহায়ক অবকাঠামো নির্মান করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা: দ্বিতীয়তঃ রাজনৈতিক পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বেড় করা এবং তৃতীয়তঃ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারী প্রতিষ্ঠান বিশেষত: ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। এইগুলোর সমাধানকল্পে সরকারের অবশ্যি উৎসাহের কোন ঘাটতি থাকার কথা নয় যদি মুদ্রানীতির সফল বাস্তবায়ন দেখতে চায় এবং দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চায়। কাজেই এই সকল সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে আগামী মুদ্রানীতিতে আলেচিত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে। তাহলেই দেশের কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন ও কর্মসংন্থান সৃষ্টি সম্ভব হবে।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//