মো. মহিউদ্দিন রুবেল: বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে বৈশ্বিক নেতা হিসেবে নিজের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্য রাখে। তবে সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পূর্ববর্তী রফতানি তথ্য উল্লেখযোগ্যভাবে সংশোধন করায় প্রকৃত পোশাক রফতানি ৪৭ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। সংগত কারণেই সংশোধিত রফতানি তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংশোধিত রফতানি লক্ষ্যমাত্রাও জরুরি। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পোশাক রফতানি ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে, যা একটি শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির গতিপথ এবং শিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য অর্জনকে প্রতিফলিত করে। যদিও বর্তমান অর্থবছরের পর এখন পর্যন্ত পোশাক রফতানির দূরবর্তী কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি, তবে শিল্পের অংশীজনরা একটি স্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং অর্জনযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণের ওপর গুরুত্বসহকারে জোর দিচ্ছেন।
রফতানিতে বৈচিত্র্যকরণ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি:
অ্যাকটিভওয়্যার ও টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের মতো উচ্চমূল্যের পণ্যগুলোর রফতানি বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইআরপি সিস্টেমের মতো অটোমেশন এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা হলে তা উৎপাদন দক্ষতা বাড়াতে ও খরচ কমাতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মতো সম্ভাবনাময় বাজারগুলো অন্বেষণ করে অব্যবহৃত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে বাজার প্রবেশাধিকার বাড়ানো যেতে পারে।
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পকে শক্তিশালী করে একটি শক্তিশালী সাপ্লাই চেইন তৈরি করা গেলে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে এবং সেই সঙ্গে প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়বে। জ্ঞান বিনিময় ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। বৈশ্বিক টেকসই মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতি রেখে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণ এবং কাস্টমস ও বন্দরসংক্রান্ত কার্যক্রমগুলো সুবিন্যস্ত করা হলে তা বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে।
টেকসই ও দেশের ব্র্যান্ডিং:
বৈশ্বিক ক্রেতাদের জন্য টেকসই একটি অগ্রাধিকার এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন, বিশেষ করে বাংলাদেশ যে আজ ২৩৫টি সবুজ কারখানার আবাসস্থল, তা বিশ্বব্যাপী আরো প্রচারণা দরকার। বাংলাদেশকে একটি পরিবেশগতভাবে টেকসই উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা অপরিহার্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা এবং টেকসই কর্মসূচিগুলো বাংলাদেশের এই ইমেজকে আরো উজ্জ্বল করতে পারে, পাশাপাশি সরকার নেতৃত্বাধীন উদ্যোগগুলোর উচিত হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রধান বাজারগুলোয় বাংলাদেশের এ সাফল্যগুলো আরো বেশি তুলে ধরা, যে বাজারগুলোয় শিল্প সম্পর্কে ক্রেতাদের ধারণার পরিবর্তন/উন্নয়ন ঘটানো জরুরি।
পণ্যের জন্য ক্রেতা কর্তৃক যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ প্রকারান্তরে এথিক্যাল উৎপাদন খরচের কথাই বলে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায্য মজুরি, আবাসন ব্যবস্থা এবং সহায়ক কাজের পরিবেশসহ কর্মীদের কল্যাণগুলো অবশ্যই অগ্রাধিকারে থাকবে। এ প্রচেষ্টাগুলো শিল্পের সব পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সক্ষমতা ও খ্যাতি বৃদ্ধি করবে।
লক্ষ্য অর্জনে চ্যালেঞ্জ:
উচ্চাভিলাষী পোশাক রফতানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পর্যাপ্ত জ্বালানি প্রাপ্যতা না থাকা, বিশেষ করে গ্যাস ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে সীমিত অ্যাকসেস এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়া শিল্পের জন্য অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। কভিড-পরবর্তী সময়ে শ্রমের ঘাটতি এবং কর্মশক্তির গতিশীলতার (ডিনামিক্স) পরিবর্তন শিল্পকে আরো চাপে ফেলেছে। অতিরিক্ত বিনিয়োগ পোশাক শিল্পে অতিরিক্ত সামর্থ্য অর্জন (ওভার ক্যাপাসিটি) এবং আর্থিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ শুল্ক সুবিধা হারানোসহ অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং এতে করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ধারণা অনুসারে ১৪ শতাংশ রফতানি হ্রাস পেতে পারে। এ প্রভাবগুলো প্রশমিত করার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে হবে, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে এবং সৌর ও বায়ু মিলের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলোয় মনোযোগ দিতে হবে।
সস্তা শ্রম থেকে শিল্পের নজর অন্যত্র স্থানান্তর:
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দীর্ঘকাল ধরে সস্তা শ্রমের সঙ্গে হলেও শিল্পটি এখন সস্তা শ্রম থেকে নজর সরিয়ে উদ্ভাবন, টেকসই ও গুণমানের দিকে মনোনিবেশ করছে। নির্ভরযোগ্য জ্বালানি, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা এবং শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি প্রদান করবে। উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়ার আগে শিল্পের ভিত্তিমূল মজবুত করা অপরিহার্য। সঠিক পরিকল্পনা ও সম্পদের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য পেতে পারে।
এ রূপকল্প সুশাসন ও কার্যকর নীতি সহায়তার ওপর নির্ভর করে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং একটি নিরপেক্ষ পরিচালন পরিবেশের জন্য স্বচ্ছতা ও দক্ষতার উন্নতি নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক, শুল্ক এবং কর ব্যবস্থায় সংস্কার আনা প্রয়োজন। উৎপাদন, শ্রম এবং পরিবেশগত অনুশীলনে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হলে তা বৈশ্বিক বাজারে বিশ্বাসভাজন হিসেবে বাংলাদেশের সুনামকে শক্তিশালী করবে।
কর্মশক্তির উন্নয়ন ও ব্যবসায় পরিবেশ:
একটি দক্ষ কর্মীগোষ্ঠী গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। ভাষা, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতায় সম্প্রসারিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, ন্যায্য মজুরি এবং ব্যবস্থাপনা ও ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সহযোগিতা, টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য শর্ত, যা স্থিতিশীল শ্রমশক্তি তৈরিতে সহায়তা করবে।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য শুল্ক, কর প্রশাসন এবং অন্যান্য পরিষেবা প্রদানকারী সংস্কারের মধ্যে সংস্কার সাধন অত্যাবশ্যক যা একদিকে সুবিন্যস্ত, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করে দেশী ও বিদেশী উভয় বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবে, অন্যদিকে শিল্পের প্রসারও ঘটাবে।
সর্বোপরি প্রস্তুতকারী, ক্রেতা ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক পদ্ধতি টেকসই অগ্রগতির চাবিকাঠি। ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, কমপ্লায়েন্স প্রতিপালন এবং শ্রম কল্যাণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে এবং শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে।
লেখক: বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//