প্রতিবেদক, বিনিয়োগবার্তা, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তেল কোম্পানিগুলো রিজার্ভের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এ খাতের কয়েকটি কোম্পানির রিজার্ভ কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধনের ৭ গুণ হতে ১৪ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। এরফলে তেল কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষ রিজার্ভের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে, বৃহৎ রিজার্ভ গড়ে উঠায় এই কোম্পানিগুলো এখন নিজস্ব ব্যবসা থেকে যে পরিমাণ মুনাফা করছে, ব্যাংকে গচ্ছিত রিজার্ভের উপর প্রাপ্ত সুদ থেকে প্রায় সমপরিমাণ মুনাফা তুলছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বর্তমানে ৩৩২টি। এরমধ্যে প্রায় ৩৮ শতাংশ কোম্পানির রিজার্ভ কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধনের ১ গুণের কম, ২৯ শতাংশ কোম্পানির রিজার্ভ ২ গুণের কম, ২৪ শতাংশ কোম্পানির রিজার্ভ ৩ গুণের কম এবং ৯ শতাংশ কোম্পানির রিজার্ভ ৩ গুণের বেশি। এই ৯ শতাংশ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৭ শতাংশ কোম্পানির রিজার্ভ মাত্রাতিরিক্ত, ৭ শতাংশ হতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বা বেশি।
বিশ্লেষকদের মতে, রিজার্ভ কোম্পানিকে ঝুঁকিমুক্ত রাখে এবং আপদকালীন সময়ে বিনিয়োগকারীদের সহায়তা করে। সে কারণে তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিজার্ভ পরিশোধিত মূলধনের অন্তত ২-৩ গুণ থাকা বাঞ্চনীয়। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে রিজার্ভের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। কিন্তু রিজার্ভের পরিমাণ ৫-৬ গুণের বেশি হওয়া বাঞ্চিত নয়। কারণ কোম্পানির রিজার্ভ বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড বঞ্চিত করেই মূলত: গড়ে উঠে।
মাত্রাতিরিক্ত রিজার্ভের কোম্পানিগুলোর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানির সংখ্যাই বেশি। এরসাথে অন্যান্য কোম্পানির সাথে ৪টি তেল কোম্পানিও রয়েছে। তেল কোম্পানিগুলো হল-যমুনা ওয়েল, পদ্মা ওয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং ইস্টার্ন লুব্রিকেন্ট।
তেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে রিজার্ভের দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যমুনা ওয়েল। এর পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১১০ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং রিজার্ভের পরিমাণ ১ হাজার ৪৭৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ যমুনা ওয়েলের পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে রিজার্ভের পরিমাণ ১৩.৩৪ গুণ বেশি বা ১৩৩৪ শতাংশ বেশি। ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৯৯ লাখ এবং রিজার্ভের পরিমাণ ১০ কোটি ১৫ লাখ। পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টের রিজার্ভের পরিমাণ ১০.২৫ গুণ বেশি বা ১০২৫ শতাংশ বেশি। পদ্মা ওয়েলের পরিশোধিত মূলধন ৯৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং রিজার্ভের পরিমাণ ৮১৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে পদ্মা ওয়েলের রিজার্ভের পরিমাণ ৮.২৯ গুণ বেশি বা ৮২৯ শতাংশ বেশি। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পরিশোধিত মূলধন ১০৮ কোটি ২২ লাখ টাকা এবং রিজার্ভের পরিমাণ ৭৬৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা। পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের রিজার্ভের পরিমাণ ৭.১১ গুণ বা ৭১১ শতাংশ বেশি।
তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, বৃহৎ পরিমাণের রিজার্ভ গড়ে উঠায় এই কোম্পানিগুলো ব্যাংকে গচ্ছিত রিজার্ভ অর্থের উপর সুদ বাবদ বর্তমানে সমপরিমাণ মুনাফা লাভ করছে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি মুনাফা লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। যমুনা ওয়েলের সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৬ মাসে যমুনা ওয়েল নিজস্ব ব্যবসা হতে মুনাফা করেছে ১৩৭৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর এই সময়ে কোম্পানিটি অন্যান্য খাত হতে মুনাফা করেছে ১৩৩২ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে কোম্পনিটি অন্যান্য খাত হতে প্রায় সমপরিমাণ মুনাফা লাভ করেছে, যার সিংহভাগ অর্থই এসেছে বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত রিজার্ভের উপর আহরিত সুদ বাবদ।
বৃহৎ রিজার্ভ গড়ে উঠায় কোম্পানিগুলোর মুনাফায়ও বড় ধরণের প্রবৃদ্ধি আসছে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে যমুনা ওয়েল শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১২.৪৬ টাকা। আগের বছর একই সময়ে এর শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ৮.৩৯ টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি এসেছে ৪৮ শতাংশেরও বেশি। পদ্মা ওয়েল গত ৬ মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১০.৯৪ টাকা। আগের বছর একই সময়ে এর শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ৭.৫০ টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি এসেছে প্রায় ৪৬ শতাংশ। মেঘনা পেট্রোলিয়াম গত ৬ মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১০.১২ টাকা। আগের বছর একই সময়ে এর শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ৮.৩৯ টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি এসেছে প্রায় ২১ শতাংশ। ইস্টার্ন লুব্রিকেন্ট গত ৬ মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১৩.২২ টাকা। আগের বছর একই সময়ে এর শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ১০.৬৫ টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি এসেছে ২৪ শতাংশ।
এছাড়া, বৃহৎ রিজার্ভের কোম্পানিতে পরিণত হওয়ায় এই কোম্পানিগুলোর নেট এ্যাসেট ভ্যালুও (এনএভি) অনেক বেড়েছে। ২০১৩ সালে যমুনা ওয়েলের শেয়ারপ্রতি এনএভি ছিল ৬৫.৫০ টাকা। বর্তমানে এর এনএভি দাঁড়িয়েছে ১৬৭.৯৬ টাকায়। পদ্মা ওয়েলের ২০১৩ সালে শেয়ারপ্রতি এনএভি ছিল ৬০.৭৫ টাকা। বর্তমানে এর এনএভি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৩.৮৬ টাকায়। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ২০১৩ সালে শেয়ারপ্রতি এনএভি ছিল ৫২.২০ টাকা। বর্তমানে এর এনএভি রেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১.২৩ টাকায়। ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টের ২০১৩ সালে শেয়ারপ্রতি এনএভি ছিল ৭১.০১ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫.৬৬ টাকায়। রিজার্ভ, এনএভি ও মুনাফা প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যমুনা ওয়েল।
তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, তেল কোম্পানিগুলো প্রতিবছর প্রায় ২০০ শতাংশ মুনাফা তোলে। কিন্তু মুনাফার অর্ধেক বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড হিসেবে প্রদান করে এবং অবশিষ্ট প্রায় সমপরিমাণ মুনাফা কোম্পানির রিজার্ভ ফান্ডে রেখে দেয়। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মতে, কোম্পানিগুলো যদি ভবিষ্যতে রিজার্ভ ফান্ড বাড়ানোর পথে অগ্রসর না হয়, তাহলে কোম্পানিগুলো অনায়াশে বিনিয়োগকারীদের ২০০ শতাংশের বেশি ডিভিডেন্ড দিতে পারে। এতে কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বাড়বে এবং কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতাও দৃশ্যমান হবে।
(ইউএম/ ১২ মার্চ ২০১৭)