প্রতিবেদক, বিনিয়োগবার্তা, চট্টগ্রাম: পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি না আসার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সময় ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা অনেক। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো। তবে এই সম্ভাবনাকে ভাবিয়ে তুলেছে আমলাতান্ত্রক জটিলতা ও সময় ক্ষেপন।
অন্যদিকে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্তির পর কোম্পানির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়লেও সেই ভাবে লাভবান হচ্ছে না কোম্পানিগুলো।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সেচঞ্জ আয়োজিত তিন দিন ব্যাপি ক্যাপিটাল মার্কেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফেয়ারে ‘প্রসপেক্ট অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অব ফিন্যান্সিং থ্রো ক্যাপিটাল মার্কেট’ শীর্ষক সেমিনারে এমন কথা বলেন উদ্যোক্তারা।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার বালা।
সিএসইর পরিচালক শামীম চৌধুরীর সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন, পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফী মিজানুর রহমান, বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলী হোসেন আকবর আলী, বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী, কেডিএস গ্রুপের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মোদাচ্ছের আহমেদ,সিএসইর সাবেক সভাপতি আল মারুফ খান।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম সাইফুর রহমান মজুমদার।
এম সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে উদ্যোক্তারা এখান থেকে সহজে মূলধন সংগ্রহ করতে পারবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত হলে কোম্পানির সুশাসন বাড়বে, ভবিষ্যতে মূলধন সংগ্রহের সহজ জায়গা, সহজেই কোম্পানির পরিচিতি বাড়ানো,সহজে লিকিউড করা যায় এবং কোম্পানিতে খুব সহজেই বিদিশীদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব।
তিনি বলেন, তবে আমাদের পুঁজিবাজারের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সেগুলো হলো এখানে ভালো কোম্পানি তালিকভুক্ত হয়না, তেমন কোনো বিদেশী কোম্পানি নেই, কোম্পানিতে ভালো সুশাসন আছে এমন কোম্পানি সংখ্যা কম, কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা কম, পণ্যের বহুমূখীতা নেই এবং রেগুলেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। ফলে বিএসইসি একটি আইন করলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য একটি আইন করে পুঁজিবাজারে সমস্যা তৈরি করে। এতে করে উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়ে।
অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসনে বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারের সম্ভাবনাগুলো হলো অর্থনীতি যত বড়, পুঁজিবাজার তত বড় নয়। ফলে এর আকার বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারের ব্যাপক সংস্কার হয়েছে, ফলে উদ্যক্তারা চাইলে আইন মেনে সহজে তালিকাভুক্ত হতে পারে।
উদ্যোক্তাদের উদ্যেশ্যে তিনি বলেন, তারা মনে করে শ্রমে ঘামে তৈরি একটি কোম্পানি কেন সবার কাছে দিয়ে দিবো। এটি তাদের ভূল ধারণা। এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। পুঁজিবাজারে কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত হবে।
তিনি বলেন, তবে আমাদের বাজারের সমস্যাগুলো হলো এখানে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নির্ভর, আকার ছোট, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের তেমন ভূমিকা নেই, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কম এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। ফলে পুঁজিবাজারের স্বার্থের কথা ভেবে বিএসইসি একটি সিদ্ধান্ত নিলে অন্যরা আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাধা তৈরি করে। এতে করে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসতে ভয় পায়।
অধ্যাপক স্বপন কুমার বালা বলেন, আগামীর পুঁজিবাজার হবে শিল্প উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী বান্ধব। আসেন সমস্যা থাকলে আলোচনা করে সমাধান করি এবং দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সবাই মিলে একত্রে কাজ করি। তাহলেই আমরা যে সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, আমার বিশ্বাস তাহলেই সেই বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, আগের তুলনায় আমের এই বিভাগ এখন অনেক শক্তিশালী। এই বিভাগের কর্মকর্তা অনেক সক্রিয়। কাগজপত্র ঠিক ঠাকা থাকলে কম সময়ে আইপিও’র অনুমোদন পাওয়া সম্ভব।
সুফী মিজানুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি আনতে হলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে একটি বিষয় আপনাদের পরিস্কার করতে হবে কেন ভালো উদ্যোক্তারা বাজারে আসবে। বিষয়টি পরিস্কার করতে না পারলে তারা বাজারে আসবে না।
তিনি বলেন, আমরাও বিশ্বাস করি পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা অনেক। এই সম্ভাবনার কথাও বলি, আবার ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে বছরের পর বছর সময় পার করি তাহলে হবে না। দুটি জিনিস একত্রে হয় না।
একই সুরে কথা বলেন বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলী হোসেন আকবর আলী। তিনি বলেন, একটি বন্ডের অনুমোদন দিতে বিএসইসির সময় লাগে এক বছর। আর ব্যাংক টাকা দেওয়ার জন্য এসে বসে থাকে। তাহলে কেন সময় ক্ষেপন করে উদ্যোক্তারা বসে থাকবে।
তিনি বলেন, বিএসইসির এমন একটি ফরমেট থাকা উচিত, যে ফরমেট ধরে প্রতিষ্ঠানগুলো কাগজ পত্র জমা দিলে দ্রুত চেক করে যেন অল্প সময়ের মধ্যে আইপিও’র অনুমোদন দেওয়া জায়।
বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু বশর চৌধুরী বলেন, ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে হলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে পরিবেশ তৈরি করেন। নির্ধারিত সময়ে যাতে কোম্পানি বাজার থেকে টাকা তুলতে পারেন,সেই অবস্থা তৈরি করেন। একই সঙ্গে আইনের মারপ্যাচ কমানোর কথা বলেন তিনি।
সিএসইর সাবেক সভাপতি আল মারুফ খান বলেন, আমাদের পুঁবিজারের সম্ভানা অনেক থাকলেও সরকারী ভালো কোম্পানি বাজারে আসছে না। সরকারী কোম্পানি যদি বাজারে না আসে, তাহলে বেসরকারী কোম্পানি কেন আসবে। সরকারী কোম্পানি আসলেই তাদের দেখে,বেসরকারী কোম্পানিগুলো বাজারে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
কেডিএস গ্রুপের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মোদাচ্ছের আহমেদ বলেন, দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজার ভালো জায়গা। তবে এই পুঁজিবাজারে একটি ভালো কোম্পানি আনতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। সমস্যাগুলো সহনীয় মাত্রায় হলে ভালো কোম্পানির সংখ্যা বাড়বে।
বিএসইসির কমিশনার ড.স্বপন কুমার বালা বলেন, সরকারী কোম্পানিগুলো বাজারে আনার জন্য কাজ করছে কমিশন। আমলাদের কারণে এটি হচ্ছে না। তবে মন্ত্রণালয়ের চাপে তারা আসতে রাজী হচ্ছে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারী এর একটি চুড়ান্ত ম্যাসেজ পাওয়া যাবে।
(এমএ/এসএএম/ ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)