‘দেশে অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ ও মাল্টিন্যশনাল কোম্পানি কাজ করছে। দীর্ঘ দিন ধরে তারা এ দেশে ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে। অথচ তারা পুঁজিবাজারে আসছে না। পুঁজিবাজারে আসলে তাদের হিসাব নিকাশে আরো সচ্ছতা আনতে হবে, এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান ও মানুষের কাছে জবাবাদিহীতা করতে হবে। এসব কারনে তারা বাজারে আসতে চায়না। তবে ভালো কোম্পানি না আসলে ভালো বিনিয়োগকারীও আসবে না। আর বাজারটি বিকশিতও হবে না। এক্ষেত্রে সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে নতুন ও ভালো কোম্পানি তালিকাভূক্তি করতে ইস্যু ম্যানেজার বা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে নূন্যতম কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে।’
বিনিয়োগবার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ কথাগুলো বলেন শেলটেক ব্রোকারেজ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মঈন উদ্দীন।
নিম্নে তার সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো।
বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করুন।
মঈন উদ্দিন: বর্তমানে পুঁজিবাজারে অবস্থা অনেকাংশে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এখন বাজার নিয়ে শঙ্কার কোনো কারন নেই। বাজারে টার্ণওভার বাড়ছে। কিন্তু যেটি লক্ষ্যনীয় সেটি হলো যে, ইদানিং অপেক্ষাকৃত দূর্বল কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ছে। এটি কেন হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে হুজুগে শেয়ার কিনেই কিন্তু ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে ধ্বস নেমেছিল। আমরা সেখান থেকে শিক্ষা পারছি না। প্রতিদিন ১০০ পয়েন্ট বাড়া কোনোভাবেই বাজারের ভালো লক্ষণ নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারে শেয়ার কেনা বেচার চাপ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে সেটি হুট-হাট করে নয়, ধীরে ধীরে। বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেরই এ বিষয়টি বুঝা উচিত। এখন সবাই মিলে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এটি ঠিক হচ্ছে না। বুঝেশুনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আসা উচিত।
বিনিয়োগবার্তা: রাষ্ট্রায়ত্ত ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তালিকাভূক্তি নিয়ে বলুন।
মঈন উদ্দিন: দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাতো আমরা সকলেই জানি।
এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারন মানুষের হয়রানীর কোন সীমা নেই। এছাড়া তাদের হিসাব নিকাশেও খুব বেশি সচ্ছতা নেই। পুঁজিবাজারে আসতে হলে তাদেরকে পোর্টফোলিও নিয়ে আসতে হবে, বছর বছর অডিটসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক চিত্র সাধারন মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। এসব কারনেই তারা পুঁজিবাজারে আসতে চায় না। আর এক্ষেত্রে সরকারেরও কিছুটা তদারকির অভাব রয়েছে বলে আমি মনে করি। কারন, সরকার জোড়ালোভাবে চাইলে তারা অবশ্যই পুঁজিবাজারে আসতো। এরফলে প্রতিষ্ঠাগুলোতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ততা বাড়তো। পাশাপাশি তাদের সচ্ছতা ও জবাবদিহীতা আরো বাড়তো। আর সাধরণ মানুষও উপকৃত হতো।
তবে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর তালিকাভূক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা আশা করি তার যথাযথ পদক্ষেপে শিগগিরই এ প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আসবে।
বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারে বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলোর তালিকাভূক্তি সম্মন্ধে বলুন।
মঈন উদ্দিন: দেশে অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ ও মাল্টিন্যশনাল কোম্পানি কাজ করছে। দীর্ঘ দিন ধরে তারা এ দেশে ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে। অথচ তারা পুঁজিবাজারে আসছে না। পুঁজিবাজারে আসলে তাদের হিসাব নিকাশে আরো সচ্ছতা আনতে হবে, এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান ও মানুষের কাছে জবাবাদিহীতা করতে হবে। এসব কারনে তারা বাজারে আসতে চায়না। তবে ভালো কোম্পানি না আসলে ভালো বিনিয়োগকারীও আসবে না। আর বাজারটি বিকশিতও হবে না। এছাড়া এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে।
তবে এসব কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনে ইনসেনটিভ দিয়ে হলেও বাজারে আনতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইন-কানুনের কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। আর যেকোনো প্রক্রিয়ায় তাদেরকে বাজারে আনলে এ বাজার আরও অনেক বড় হবে, আন্তর্জাতিক মানদন্ডে পৌঁছাবে। কারণ তাদের পরিশোধিত মূলধন বেশি, টার্ণওভার বেশি, তাদের ব্যবসা অনেক বিস্তৃত। এ কারনেই তারা বৃহৎ বা বহুজাতিক শিল্পগ্রুপ।
বিনিয়োগবার্তা: অভিযোগ রয়েছে, বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর প্রস্তাব করছে। আপনি কি মনে করেন?
মঈন উদ্দিন: আসলে সিন্ডিকেটের বিষয়টি নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। এ ধরনের গুঞ্জন আমাদের কানেও আসে। কিন্তু পর্যাপ্ত এ্যাভিডেন্স না থাকায় আমরা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজারে টার্ণওভারের একটি বড় অংশ ধরে রাখে। এক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারহোল্ডের পরিমান নগন্য। তাই তারা সিন্ডিকেট করছে না কি করছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আমি মনে করি, বুকবিল্ডিংয়ের নতুন পদ্ধতিতে আগের চেয়ে অনেক সচ্ছতা এসেছে। তবে তা প্রতিষ্ঠা পেতে সময় লাগবে। সেজন্য আমাদের আরো সময় অপেক্ষা করতে হবে।
বিনিয়োগবার্তা: অনেক ইস্যু ম্যানেজার বছরের পর বছর ধরে বাজারে কোনো ইস্যু আনতে পারছে না। তাদের বিষয়ে বলুন।
মঈন উদ্দিন: পুঁজিবাজারে নতুন ও ভালো কোম্পানি তালিকাভূক্তি করতে ইস্যু ম্যানেজার বা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে নূন্যতম কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
শুধু লাইসেন্স নিয়ে বসে থাকবে, আর বছরজুড়ে একটিও নুতন কোম্পানি বাজারে আনতে পারবে না, তা হতে পারে না। এসব বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরো বেশি তদারকি করতে হবে। নতুন ইস্যু না আসলে বাজার বড় হবে কেমন করে। ইস্যু ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর উচিত প্রতি বছরই অন্তত এক/দুটি ইস্যুর প্রস্তাব নিয়ে আসা। এছাড়া বাজারে বড় কোম্পানি আনতে তাদের নানাভাবে এ্যাওয়ারনেস চালানো উচিত। বাজারে কোম্পানিগুলো কেন আসবে, এখানে আসলে তারা কি ধরনের সুযোগ সুবিধা পাবে- এসব বিষয়গুলোতো তাদেরই তুলে ধরা উচিত। নূন্যতম কোটা পূরণ করতে না পারলে এসব ইস্যু ম্যানেজারদের লাইসেন্স বাতিল বা শোকজ করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই অনেক নতুন নতুন ও ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসবে।
বিনিয়োগবার্তা: আসছে বাজেটে সম্মন্ধে কিছু বলুন।
মঈন উদ্দিন: আগেরবারের বাজেটও পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক ছিল। এসবের মধ্যে করপোরেট ট্যাক্স কমানো, গেইন ট্যাক্স কমানো, ফিনান্সিয়াল রিপোটিং এ্যাক্ট বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া গ্রহনসহ অত্যন্ত ভালো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে ইতিামধ্যেই বাজারে অনেক ইতিবাচক প্রভাব পড়তেও শুরু করেছে। এবারের বাজেটেও পুঁজিবাজারের জন্য বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে বলে আমার ধারনা। এক্ষত্রে লিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ট্যাক্সের পরিমানটা আরেকটো কমালে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবে। এতে কোম্পানিগুলো আরো বেশি ডিভিডেন্ড দিতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।
বিনিয়োগবার্তা: সম্প্রতি পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স কমানোর বিষয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে-এ বিষয়ে কিছু বলুন।
মঈন উদ্দীন: শুধু ট্যাক্স কমিয়ে দিলেই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে তা আমি মনে করিনা। তাদের বিষয়ে পরিপূর্ন একটি নীতিমালা তৈরী করতে হবে। তারা কাদেরকে ট্যাক্স দিবে, কে তাদের ট্যাক্স ক্যালকুলেট করবে, তারা কী পরিমান পুঁজি নিয়ে আসছে আর কি পরিমান মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে, কে এসব কিছু মনিটরিং করবে- সবকিছুরই একটি সুন্দর কাঠামো তৈরী করতে হবে। তবে আমরা দেখছি যে, সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে। একটি সুন্দর নীতিমালা বা কাঠামো তৈরী হলে এ বিনিয়োগের মাত্রা আরও বাড়বে বলে আমি মনে করি।
বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
মঈন উদ্দিন: প্রত্যেক বিনিয়োগকারীকে নিজেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় কিভাবে বিনিয়োগ করলে তার টাকা নিরাপদ থাকবে, কিভাবে লাভবান হতে পারবেন। কোনো শেয়ারের দাম বাড়লেই তা কেনার জন্য সবাই পাগল হয়ে যায়। কেন? হুজুগে পড়ে ব্যবসা করতে হবে কেনো। কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে সে কোম্পানির মৌলভিত্তি, কোম্পানির ব্যবসা বানিজ্যের সমসাময়িক হাল-অবস্থাসব কিছু জেনে নিতে হবে। মোট কথা, হুজুগে নয় জেনে-শুনে এবং বুঝে তবেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত বলে আমি মনে করি।
(শামীম/ ২৭ মার্চ ২০১৭)