বরইয়ের যত উপকারিতা

বিনিয়োগবার্তা ডেস্ক: কিছু খাবারের কথা শুনলে জিবে যেমন জল আসে, তেমনি মানুষ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। বরই বা কুল যে নামেই ডাকি না কেন, এই ফলও সে রকমই একটি খাবার। আমের কথা শুনলে যেমন মনে পড়ে বৈশাখি ঝড় অথবা কাঠফাটা রোদে ছুটে বেড়ানো দুরন্ত কিশোরের কথা, বরই বা কুলের কথা শুনলে তেমনি শালুকপাতা চুরির কথা মনে পড়বে কারও কারও। সেই সঙ্গে মনে পড়বে বাঁশের চোঙ, ঘুঁটনি আর পকেটে খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া লবণ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো একটুকরা কিশোরকাল। সে অনুভূতি কাউকে বুঝিয়ে বলা যাবে না।

শীত শুরুর সময় প্রকৃতিতে যখন শীতনিদ্রার প্রস্তুতি চলতে থাকে, বরইগাছের তখন অভিসারকাল, সেটা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। সবুজ জমিনে সাদা ফুলের বাহারে তখন উর্বশী কুলগাছ। এরপর গুটি, গুটি থেকে ‘খাইবার যোগ্য’ হয়ে উঠতে তার সময় লাগে বেশ খানিকটা। মাঘ মাসের দিকে কিছু বরই পাওয়া যায় বটে, কিন্তু এর পরিপক্ব হয়ে উঠতে উঠতে ফাগুন এসে যায়। সে জন্যই হিন্দুধর্মের লোকেরা বরই খেয়ে থাকে সরস্বতীপূজার দিন থেকে। এ সময়ে বরই একেবারে পরিপক্ব হয়। ধর্মের সঙ্গে এর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই, যতটা আছে প্রকৃতির সঙ্গে, পরিপক্ব হওয়ার সঙ্গে।

বরই মানে শালুকপাতা, বরই মানে বাঁশের চোঙ, বরই মানে পকেটে লুকানো লবণ, বরই মানে কাঁটার আঘাত সয়ে সফল হওয়ার নাম। বরই মানে এক অদ্ভুত মায়াময় কোমল শৈশব। শৈশব-কৈশোরে যাদের চোখ খুলে গিয়েছিল, তাঁরাই জানেন, সব জাতের বরই বরই হলেও সব বরই কুল নয়। নারকেলি বরই বলে যেটিকে আমরা চিনি, দেশি বরই থেকে আকারে কিছুটা বড় আর নারকেলের মতো দেখতে, সেটিই আদতে বরইশ্রেষ্ঠ কুল—অভিজাত আর সুস্বাদু। এই ‘কুল বরই’ বা ‘কুলি বরই’ কিশোর কালের অদ্ভুত আকর্ষণের নাম। কারণ, একটি এলাকায় এক শতে এক–আধটা কুলি বরইয়ের গাছ পাওয়া যায়। যাদের বাড়িতে কুল বরইয়ের গাছ থাকত, তারা আবার গাছের গোড়ায় বসাত নিরাপত্তাচৌকি। ফলে সে থাকত নাগালের বাইরে।

অন্যদিকে কিশোর আর নারী মহলে রাজত্ব করত দেশি বরই। টক টক এ বরই খাওয়ার জন্যই চোখের নিমেষে চুরি হতো শালুকপাতা বা শলুফা, ধনেপাতার সৎভাই। বাঁশের চোঙে বরই ঢুকিয়ে তাতে পরিমাণমতো লবণ, হালকা হলুদ, হাত দিয়ে যত দূর সম্ভব কুচি করে ছেঁড়া শালুকপাতা দিয়ে ‘দে ঘুঁটা’। আচ্ছামতো ঘুঁটে উদার আর সিংহ হৃদয়ের ‘ঘুঁটনেদার’ বাড়িয়ে দেওয়া হাতগুলো ভরিয়ে দিয়ে অবশিষ্টাংশ রাখত নিজের জন্য। এই উদারতার পেছনের রাজনীতি কঠিন, ভূরাজনীতির হিসাবের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কারণ, সব মসলা আর উত্তম ঘোঁটানো বরইয়ের অংশটাই থাকত একেবারে শেষের পাতে।

আর একধরনের বরই পাওয়া যায়, তার নাম বালুশাই। দেশি বরইয়ের চেয়ে আকারে কিঞ্চিৎ বড়, দেখতে প্রায় একই রকম, কিন্তু স্বাদে কিছুটা ভিন্ন। টক নয় এর স্বাদ। আবার কুল বরইয়ের মতো মিষ্টিও নয়, মাঝামাঝি। কিন্তু একটু বালু বালু ভেতরটা। সে জন্যই এর নাম বালুশাই। এরও কদর ছিল ভীষণ। কোনো কোনো দেশি বরইয়ের গাছেই এক–আধটা বালুশাই বরই পাওয়া যায়। সেগুলোকে না ঘুঁটে এমনি এমনি খাওয়া হয়।

এখন এসবের বালাই নেই। সবকিছু এখন সহজ। বাজারে গিয়ে খোঁজ করবেন নারকেলি বরই, বাউকুল, দেশি টক–মিষ্টি বরই, মিষ্টি বরই আর আপেল কুলের। পেয়ে যাবেন যতটুকু পরিমাণ চান, ততটুকু। স্বাদ? সব কটিই মিষ্টি শুধু দেশি বরই ছাড়া। আর কী আশ্চর্য বিষয়, এখন শুধু টিয়ে রঙের বরই নয়, পাবেন টিয়ের লাল টুকটুকে ঠোঁটের রঙের বরইও। এরপর হয়তো ইচ্ছামতো রঙের বরই পাওয়া যাবে, আমরা যেমন চাইব তেমন।

দেশি বরই না কিনলেও কুল বরই আগা–গোড়াই কিনে খাওয়া হতো। এখন বাজারে যেসব বরই পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো দরদাম করলে ৮০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন প্রতি কেজি।

বরই শুধু কাঁচা খাওয়ার জিনিস নয়। দেশি বরই কড়া রোদে শুকিয়ে ‘টোপা বরই’ বানিয়ে রাখা যায়। চৈত্রের খর দিনে পাঁচফোড়নে রান্না করা এই শুকনা বা টোপা বরই দিয়ে রান্না করা অম্বল মুখে রুচি ফেরায়। বৈশাখে নতুন বছরের খাবারে শুকনা বরইয়ের অম্বল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবেই চিহ্নিত। এটি দিয়ে বানানো যায় আচার। অনেক খাবারে অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ করা যায় শুকনা বরই।

কেন খাবেন বরই? এ প্রশ্নের অনেক উত্তর দেওয়া যায়। এর স্বাস্থ্যগুণের কথা বলে থিসিসও করে ফেলা যায়। কিন্তু আমি বলব, এমনি এমনি বরই খান। শীতে যেমন বাড়ির বাইরে পা রাখলেই কমলার দেখা পাওয়া যায়, বসন্তে তেমন রাস্তাঘাটে থরে থরে সাজানো বরই পাওয়া যাচ্ছে। বাজারে, ফুটপাথে, বাড়ির পাশের অস্থায়ী বাজারে, ভ্যানে—সবখানে এখন হরেক রকমের বরই রাজত্ব করছে। মৌসুমের ফল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। তাই ইচ্ছামতো বরই খান। বরইয়ের অনেক গুণ। সেই সঙ্গে একঝলক দেখে নিন, এই নাগরিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া নিজের কিশোরকাল। বসে পড়ুন না একটু বরই আর লবণ, শর্ষের তেল, শালুক না হোক ধনেপাতা নিয়ে। বাঁশের চোঙ পাবেন না। সমস্যা নেই। কাচের গ্লাসে ফল কাটার ছুরির বাট দিয়ে একটু ঘুঁটে নিন। দেখবেন মন কেমন ফুরফুরে লাগছে। সূত্র: প্রথম আলো।

(এসএএম/০১ মার্চ ২০২১)


Comment As:

Comment (0)