undefined

ঝর্ণাধারা চৌধুরীর স্মৃতি বিজরিত গান্ধীআশ্রম

ড: মিহির কুমার রায়: এই নামটির সংগে আমরা অনেকেই পরিচিত নই। তবে যারা মানবতাবাদী শান্তির অন্বেষনে মানুষের জন্য কাজ করে থাকেন যাদের সংখ্যা একেবারেই সীমিত তারাই এই নামটির সাথে পরিচিত। তিনি ঝর্নাধারা চৌধুরী যার জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ই অক্টোবর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ উপজেলায় কালুপুর গ্রামে, যিনি তার পিতা গান্ধীয়ান প্রথম চৌধুরী ও মাতা আশালতা চৌধুরীর এগার সন্তানের মধ্যে দশম। মিস শ্রী চৌধুরী চট্রগ্রামের খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, কুমিল্লা ভিক্টোরীয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন ষাটের দশকে। তার পিতার মৃত্যুর পর ১৯৫৬ সালে এই উপমহাদেশের শান্তিবাদী নেতা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত অন্বিকা কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাস্টে (বর্তমানে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট) যোগ দেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীতে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারনে মহাত্মা গান্ধী সেখানে উপস্থিত হয়ে (Peace Mission of Mahatma  Gandhi) নামে একটি কর্মসুচির সুচনা করেন এবং গ্রামে গ্রামে মানুষকে শান্তিপুর্ণভাবে সহ অবস্থানের বুঝতে শুরু করেন অহিংস দর্শনের ভিত্তিতে। তিনি ১৯৪৭ সালে ২৯শে জানুয়ারী জয়াগ (বর্তমানে সুনাইমুরি উপজেলায় অবস্থিত) আসলে সর্বস্তরের গ্রামবাসী তাকে সাদরে অভ্যর্থ্যনা জানায়। সেই সময়ে এলাকার স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ব্যারিষ্টার শ্রী হেমন্ত কুমার ঘোষ তার সকল সম্পত্তি এই এলাকার উন্নয়নের জন্য মাহাত্মা গান্দীর হাতে সমর্পন করেন এবং অম্বিকা কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এর শুভ সুচনা হয় এই সম্পদের হাত ধরে। ফলে গান্ধী গ্রুপ যা পরবর্তিতে গান্ধীত্ন মিশন নামে আত্মপ্রকাশ করে যার অফিস জয়াগে স্থানান্তরিত হয়। এই গান্ধী গ্রুপ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রামে গ্রামে কাজ করতে থাকে, যা ১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তির আগ পর্যন্ত চলতে থাকে সুন্দর ভাবেই। কিন্তু এক দিকে ভারত বিভক্তি অন্যদিকে আততায়ীর হাতে মহত্মা গান্ধীর নিহত হওয়ার পর কয়েক জন ব্যতীত গান্ধীর অনুসারিরা নোয়াখালী ত্যাগ করতে শুরু করেন এবং পাকিস্থান সরকারের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারন গান্ধীবাদীদের দুর্দিন নেমে আসে এবং একে একে সকলেই করাবরন করতে থাকে, যা সাড়া পাকিস্থান আমলটিতেই বহমান ছিল। সাথে সাথে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল তথা ভুমি দুস্য বলে খ্যাত এলাকাবাসী এই ট্রাস্টের জমি দখল করতে শুরু করলে এই কর্মসূচি চালিয়ে নেয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় এবং শান্তি মিশনের দলনেতা শ্রী চারু চন্দ্র চৌধুরীকে জেলে আটক করা হয় দীর্ঘ সময় ধরে এই আশ্রমের কার্য্যক্রমের জন্য যা ছিল খুবি হৃদয় বিদারক।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রী চারু চৌধুরী কারাগার থেকে মুক্তি পায় এবং আশ্রমের কাজ নতুন উদ্যমে সংগঠিত করা শুরু করে যার মধ্যে ছিল দখল হয়ে যাওয়া জমি সহ অন্যান্য সম্পত্তি পুন:রুদ্ধার যা ছিল খুবি কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ্য। তারপর বাংলাদেশ সরকার ২রা অক্টোবর ১৯৭৫ সালে একটি গ্যাজেট জারীর মাধ্যমে এই কর্মসূচিকে আইনগত স্বীকৃতি দেয়া যেখানে এই  (Ambika Kaliganga Charitable Trust) নাম পরিবর্তন করে ( Gandhi Asram Trust) করা হয়। এই ট্রাস্টে কার্যক্রমের পরিচালনার জন্য ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কার্য্যকরি কমিটি গঠন করা হয়। তারপর থেকে প্রতিষ্ঠানটির সনাতনী যে ভাবধারা ছিল যেমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে স্থানীয় ভাবে পুনর্বসতি করা, তা থেকে সরে এসে উন্নয়ন ভাবনায় (বস্তোগত ও আত্বীক) গ্রামবাসিদের সংযুক্ত করা। বর্তমানে এই ট্রাস্টের পরিধি নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী ও কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত, যার আওতায় রয়েছে উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যতীত গ্রাম উন্নয়নে দারিদ্র বিমোচন প্রকল্প, তিনটি স্কুল, একটি চিকিৎসা প্রশিক্ষন প্রতিষ্ঠান, তিনটি তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্র ও দুটি হস্থচালিত তাত কেন্দ্র। শ্রীমতি ঝর্না ধারা চৌধুরী ১৯৬০ সালে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সংসার ত্যাগীদের সংগঠন চট্রগ্রামের প্রবর্তক সংঘের যোগদানের মাধ্যমে মানবতার সেবায় নিয়োজিত হন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় অবস্থান করেন এবং শরনার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরন করেন। ১৯৭৯ সালে শ্রীমতি চৌধুরী আবার গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন সচিব শ্রী চারু চৌধুরীর মৃত্যুর পর তিনি সচিবের দায়িত্ব পালন করেন জীবনের সবটুকু সময়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তিনি জায়গে ট্রাস্টের ক্যাম্পাসে সার্বক্ষনিক ভাবে অবস্থান করতেন এবং অফিস ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে মাঠ কার্য্যক্রমের প্রকল্প গুলোও দেখভাল করতেন। এই সময়ে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের কর্মসুচিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি, মানব সম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা প্রসার, গ্রামীন জনগনের আয় বর্ধকমূলক কাজ, কৃষি পশুপালন মৎস চাষ, কুটির শিল্প, আম্বর চরকার মাধ্যমে খাদি কাপড় তৈরী, দেশব্যাপী গান্ধী বাদ নীতি ও আদর্শ প্রচার, কুমিল্লায় অভয় আশ্রমের উন্নয়ণ, নির্যাতিত মানুষদের আইনী সহায়তা, জরুরী ভিত্তিতে ত্রান ও পুনর্বাসন কর্মসুচি পরিচালনা এবং গবেষনা প্রকাশনা।

আমি ২০০৭ সালে পরিবার সহ গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের কর্মসুচিগুলো দেখার জন্য গিয়েছিলাম যা এর আগে কখনও যাইনি। সেখানকার কর্মকর্তারা আমার পরিচয় জেনে আমাকে আদর আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং সেখানকার সচিব শ্রীমতি ঝর্না ধারা চৌধুরীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তখন সকাল ৮.৩০ মিঃ এবং আমার জন্য সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো তাদের অতিথী শালায় যা অত্যন্ত পরিপাটি। আমার কাছে মনে হলো সেখানকার প্রতিটি কর্মীই যেন একটি আদর্শ অনুসরন করার মত, যা এর আগে কখনও দেখিনি। তারপর শ্রীমতি ঝর্না ধারার সাথে আনুষ্ঠানিক কথোপকথন শুরু হলো এবং তিনি জানতে চাইলেন আমার এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহের ব্যাকুলতা কেন। আমি উনাকে বলেছিলাম এমন একটি প্রতিষ্ঠানে আমি চাকুরী করি যার প্রতিষ্ঠাতা গান্ধী দর্শনের অনুসারি ছিলেন এবং তার শিক্ষাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে দেখার জন্য এই আশ্রমের কার্য্যক্রম। তারপর আশ্রমের যাদুঘরে আসলাম যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০০ সালে কেবল মাত্র শান্তির অহিংসার বাণী নিদর্শন স্বরুপ যা এই আশ্রমের মাঝখানে তিনটা রুম অবস্থিত। এই যাদুঘরে মহাত্মা  গান্ধীর ১২০টির মতো ফটো, বিভিন্ন চিঠিপত্র, পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ও অন্যান্য ডকুমেন্ট রয়েছে। গৌতম পাল এই যাদুঘরে মহ্ত্মা গান্ধীর মুর্তি তৈরি করেছিলেন যা এই ঘরের একটি ব্যতিক্রম আকর্ষন। তাছাড়াও গান্ধীজির নোয়াখালিতে অবস্থানকালে তার ব্যবহৃত কাপড় চোপড় রয়েছে এবং আরো আছে তাকে নিশংস ভাবে হত্যা করার পর সৎকারের ছাই ভস্য। তারপর এই ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, যেমন - দুঃগ্ধবতী গাভী পালার খামার, মৎস্য খামার, আম্বর চরকা, তাতের কাপড় তৈরির কারখানা, শস্য খামার উৎপাদন ইত্যাদি দেখলাম। আরও জানতে পারলাম ট্রাস্টের চতুরর্দিকের গ্রামগুলোতে রয়েছে দারিদ্র বিমোচনের প্রকল্প এবং আশ্রমে তাদের আয় বর্ধনমুলক কাজে বিভিন্ন প্রশিক্ষন দেয়া হয়। তারপর শ্রীমতি ঝর্না ধারা চৌধুরী এই আশ্রমের পরিচালনায় বেশ কিছু সম্যসার কথা তুলে ধরলেন যার মধ্যে কতগুলো স্থানীয়, কতগুলো নীতি নির্ধারনী ও কতগুলো প্রশাসনিক। তখন এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি দেবেশ ভট্রাচার্য্য এবং উনার মৃত্যুর পর তদীয় তনয় দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডঃ দেবপ্রিয় ভট্রাচার্য্য  সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আরও বললেন স্থানীয় জমি জমা সংক্রান্ত বেশ কিছু বিরোধ রয়েছে যা মোকাবেলা করার জন্য একটি শক্তিশালী পরিচালনা পর্ষদ দরকার। তাছাড়াও কুমিল্লা শহরে অবস্থিত গান্ধী আশ্রমের বেশ সম্পদ রয়েছে যেগুলো রক্ষা করার খুবি কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে যেগুলোর রক্ষাকল্পে আমি কিভাবে তাদেরকে সাহ্যয্য করতে পারি।

বর্তমানে গান্ধী আশ্রমের জায়গাগুলোতে ছাত্রাবাস তৈরি করে ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে যারাই এই সম্পদ রক্ষা করার প্রধান শক্তি। তারপর আমার জন্য মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করা হলো পুকুরের মাছ সবজী ইত্যাদি দিয়ে দুতলায় অফিস হলের পাশে সেখানে সকল ষ্টাফ সহ শ্রীমতি ঝর্না ধারা চৌধুরী অংশগ্রহন করলেন, যা একটি বিশেষ ধরনের আয়োজন। সার্বিক বিষয়গুলো পর্যালোচনায় মনে হলো এই আশ্রমের কর্মীগন যাদের সিংহ ভাগ মহিলা বিশেষ ভাবে অনুপ্রানিত ভিন্ন জগতের মানুষ যাদের মনে চাওয়া পাওয়ার কিছুই নেই কেবল দান করে যাওয়া ছাড়া। এখন আমাদের ভোগ বাদী সমাজের যেখানে এককেন্দ্রীকতাই মূখ্য বিষয় সেখানে আদর্শিক শান্তির বানী দিয়ে অহিংস আন্দোলনে শরীক করানো মানুষ কোথা থেকে আসবে যা এই ধরনের প্রতিষ্ঠান চালানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ কি নয়? আমি শ্রীমতি ঝর্না ধারা চৌধুরীকে প্রশ্ন করলাম গান্ধী বাদী অহিংস নীতির অনুসারি আপনার অবর্তমানে সেই জায়গায় কে প্রতিস্থাপন হবেন তা নিয়ে আপনার ভাবনা কি? উত্তর দিলেন বড় কঠিন প্রশ্ন এবং এর উত্তর সময়ই বলে দিবে এই কারনে যে গৃহত্যাগী সংসার ত্যাগী যে কেবল বৌদ্ধ ভিক্ষু কিংবা রামকৃ্‌ষ্ন মিশন কেন্দ্রীক কিছু ফিলানথ্রপিক সংগঠনের দেখা যায় যা এই আশ্রমের কতটুকু সফল হবে? 

আমার কথাই সত্যি হলো এবং এই খ্যাতিনামা গান্ধীয়ান শান্তিকর্মী গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সচিব ঝর্না ধারা চৌধুরী ২৭ শে জুন ২০১৯ তারিখে বৃহস্পতিবার সকালে মস্তিস্কে রক্তক্ষরনজনিত কারনে মৃত্যু বরন করেন। গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের পরিচালক নব কুমার রাহা শ্রীমতি ঝর্না ধারা চৌধুরীর ইচ্ছা মতে তার মরদেহ গবেষনা কাজে ব্যবহারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। এই মহিয়সী রমনী তার জীবন দশায় আন্তর্জাতিক বাজাজ পুরস্কার ১৯৯৮, শান্তি পুরস্কার-ওল্ড ওয়েষ্টবেরী বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকা-২০০০, অনন্যা-২০০১, দুর্বার নেটওয়ার্ক ২০০৩, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিস এন্ড কনফ্লীক্ট বিভাগ হতে ২০০৬, সাদা মনের মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি ২০০৭, শ্রী চৈতন্য পুরস্কার-২০১০, কীর্তিমতী  নারী ২০১০, রনবীর সিংহ গান্দী স্মৃতি পান্তিসদ ভাবনা পুরস্কার-২০১১, ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার-২০১৩, বেগম রোকেয়া পুরস্কার ২০১৩, একুশে পদক ২০১৫ ও ডেইলি স্টার কর্তৃক সন্মাননা ২০১৬ পদক লাভ করেন।

তার মৃত্যুতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি ও সাবেক জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)