মিহির

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দেশবাসীর জন্য গর্ব ও অহংকারের

ড: মিহির কুমার রায়: আর মাত্র কিছুদিন পরই অর্থাৎ ২৫ জুন বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমগ্র জাতি এই সেতু উদ্বোধনের জন্য অধীর অপেক্ষায় রহিয়াছে। এ সময় তিনি পদ্মা সেতু এলাকায় ৫টি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন এবং এরি মধ্যে সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে মাওয়া প্রান্তে সুধি সমাবেশ, সেতুর টোল প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধন,  মাওয়া প্রান্তে সেতুর ফলক উন্মোচন,  জাজিরা প্রান্তে সেতুর ফলক উন্মোচন ও কাঁঠাল বাড়ীর জনসভায় ভাষণ দেবেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে সব অনুষ্ঠানের স্যানিটেশন  ও সুপেয় পানি সরবরাহ করবে স্থানীয় সরকার বিভাগের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। কাঁঠাল বাড়ীতে ১০-১৫ লাখ মানুষের জনসভায় সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আশা করা হচ্ছে, ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রায় ১০-১৫ লাখ মানুষের সমাগম হবে। জনসভায় উপস্থিত মানুষের জন্য সার্বক্ষণিক সুপেয় পানি সরবরাহের লক্ষ্যে সাবমার্সিবল পাম্পসহ দুটি উৎপাদন নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ১২টি জলাধার থেকে ৫০০টি ট্যাপের মাধ্যমে ওয়াটার সাপ্লাই স্থাপন করা হবে। এছাড়া গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের জন্য ৬০ হাজার বোতল পানি,  ২০টি ভিআইপি টয়লেট এবং জনসাধারণের জন্য চলমান পানিসহ ৫০০ টয়লেট স্থাপন করা হবে। খরস্রোতা আমাজন নদীর ওপর কেউ সেতু করার সাহস না করলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রমত্তা পদ্মার বুকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পদ্মা সেতু করতে গিয়ে দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তার দৃঢ়চেতা মনোবল এবং অসীম সাহসীকতায় পদ্মা সেতু আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এই সেতু দেশের গর্বের ও অহংকারের।’

বহু ঘাম, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা ও চ্যালেঞ্জ জড়াইয়া আছে এই সেতুর সহিত।  উন্নয়নশীল একটি দেশে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতু পদ্মার মতো খরস্রোতা নদীর উপর নির্মাণ করা সহজ কথা নহে। ইহার পাশাপাশি পদ্মা সেতু নির্মাণ করিতে গিয়া নানামুখী বাধাও অতিক্রম করিতে হইয়াছে। সরকারের জন্য শুধু প্রয়োজনীয়তাই নহে, ইহা এক পর্যায়ে নির্মাণ করা একটি চ্যালেঞ্জ হইয়া দাঁডাইয়াছিল। উল্লেখ্য,  ১৯৯৯ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। সেই উদ্যোগের অনেকে হয়তো এখন দৃশ্যপটে নাই;  কিন্তু তখন দেশের সরকার প্রধান ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে পরাজয়ের পর এই সেতুর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব অকার্যকর হইয়া যায়। পরবর্তীকালে ২০০৯ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর মহাজোট সরকার গঠন করিবার মাত্র ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রায় একই সময়ে সরকার জমি অধিগ্রহণও শুরু করে। আর পিছনে ফিরিয়া তাকাইতে হয় নাই। তবে এই সেতু নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক রাজনীতি হয়েছে। একজন পন্ডিত অর্থনীতিবিদ,  যিনি সারাদিন বাংলাদেশের সর্বনাশের ছিদ্র খোঁজেন,  প্রমিত বাংলায় পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করলে কী কী বিপর্যয় হবে তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছিলেন। ওই ফিরিস্তিতে তিনি বলেছিলেন,  বৈদেশিক মুদ্রার চাপ পড়বে,  দারিদ্র্য বাড়বে। অবশ্য তখন সরকার জানত না ২০২০ সালে করোনার তান্ডব গোটা বিশ্বকে উল্টে দেবে। ভাগ্যিস ওই পন্ডিতদের কল্পনায় করোনা ছিল না। থাকলে তো তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীতে বাংলাদেশ নামে দেশটাকেই বিলীন করে দিতেন। শুধু ওই এক পন্ডিত নন,  এরকম বহু পন্ডিত সেদিন নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আমরা মূর্খ জনতা পন্ডিতদের অমৃত বাণীতে আস্থা রেখেছি। সরকারের এসব পাগলামি নিয়ে চায়ের আসর গরম করেছি। বুদ্ধিজীবীদের কথায় উদীপ্ত হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়াও। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি দুর্নীতির মামলায় দন্ডিত হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে ছাত্র দলের এক সভায় পন্ডিতদের বাণীতে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার,  কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না অনেক রিস্ক আছে। দেশের মানুষের অর্থায়নে প্রমত্তা পদ্মায় যে সেতু গড়ে উঠছে শুরুতে সে প্রকল্পে একটি বড় অর্থায়ন করার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংক ও কয়েকটি  বিদেশী উন্নয়ন সংস্থার। তখন এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। মোট অঙ্কের ভেতরে বিশ্ব ব্যাংক একাই অর্থায়ন করতে চেয়েছিল ১২০ কোটি মার্কিন ডলার। বাকি অর্থ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক,  জাপানী উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের জোগান  দেয়ার কথা ছিল। হঠাং করে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। বিশ্ব ব্যাংক সরে যাওয়ায় অন্যান্য বিদেশী দাতা সংস্থাও প্রকল্পটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ঋণ চুক্তি ২০১২ সালের ২৯ জুলাই বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক। পরবর্তীকালে বিশ্ব ব্যাংক ও সরকারের মাঝে নানা আলোচনার এক পর্যায়ে বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ সহায়তা না নেয়ার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সরকারকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করা হবে বলে জাতীয় সংসদে ঘোষণা দেন। এ লক্ষ্যে তিনি দেশের মানুষ ও প্রবাসীদের সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের প্রেক্ষিতে শুরু হয় অর্থ সংগ্রহ। সব মন্ত্রী একমাসের সম্মানী জমা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সচিবরাও দেন একটি উৎসব ভাতার সমপরিমাণ অর্থ। এভাবে চলতে থাকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজ। অনেক চড়াই-উতরাই শেষে নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ। ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হয়।

এ প্রসঙ্গে পদ্মা সেতু সম্পর্কিত কিছু মৌলিক তথ্য উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ এ সেতুর পুরো নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’। সেতুটি নির্মাণের জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এই প্রকার সেতুর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এবং ইংরেজি ঝ আকৃতির সেতুর নকশা প্রণয়ন করেছে আমেরিকার একটি মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার (২০,২০০০ফুট) এবং প্রস্থ ১৮ দশমিক ১০ মিটার  (৫৯.৪ ফুট)। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় এটি আরো কয়েক মাস বিলম্বিত হতে পারে,  অর্থাৎ ২০২২ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে বলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে অবগত করেছিলেন। সেতুটি রক্ষণা বেক্ষণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্ব পালন করছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনা বাহিনী। উল্লেখ্য,  এ সেতুর নিকটতম সেনানিবাস হলো পদ্মা সেনানিবাস। কিন্তু আনন্দের বিষয় যে ঠিক পূর্বের নির্ধারিত সময়েই পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে এটাই জাতীর আত্মমর্যাদা ও আনন্দের বড় বিষয়। 

এই সেতু চালু হইবার পর ইহার যে আউটপুট পাওয়া যাইবে তাহা লইয়াও আছে দেশবাসীর গভীর স্বপ্ন। কেবল দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার অর্থনীতি,  যোগাযোগ হইতে শুরু করিয়া মানুষের যাপিত জীবনে প্রত্যক্ষ পরিবর্তন আনিবে তাহাই নয়,  এই সেতু গোটা দেশের এবং বহির্বিশ্বের সহিত যোগাযোগকেও ত্বরান্বিত করিবে। সুতরাং উচ্ছ্বাস থাকাটাই স্বাভাবিক। এই উচ্ছ্বাস হইতেই উদ্বোধনের দিন জন সমাবেশের কথা ভাবিয়াছে সরকার। আমরাও এই সমাগমের সাফল্য কামনা করি। সরকারের পক্ষ হইতে সমাবেশের প্রস্তুতিও গ্রহণ করা হইতেছে। আবার ইহার সহিত সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ইহা বলিয়াও সতর্ক করিয়াছেন যে,  পদ্মা সেতু লইয়া ষড়যন্ত্র চলিতেছে। ১০ লক্ষ মানুষ দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের নিচে;  কিন্তু এই জনসংখ্যা কম নহে। পৃথিবীর পঞ্চাশের অধিক স্বাধীন একেকটি দেশে লোকসংখ্যা ১০ লক্ষের নিচে। অথচ এত বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হইবেন একটি সেতুকে ঘিরিয়া!

সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে চলতে হবে কারন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবার করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়িতে শুরু করিয়াছে। অর্থাৎ এই  সংক্রামক ব্যাধি পৃথিবী হইতে পুরাপুরি বিতাড়িত হয় নাই।  বাংলাদেশে পরিস্হিতি অনেকটাই স্বাভাবিক থাকিলে কিছু দিন ধরিয়া অল্প অল্প করিয়া বাড়িতেছে।  সুতরাং সতর্কতার প্রয়োজন এখনো শেষ হইয়া যায় নাই। আমরা চাই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নির্বিঘ্ন ও আনন্দমুখর হইয়া উঠুক। পদ্মা সেতুর জন্য সার্বিক ও সর্বোপরি শুভ কামনা।

লেখক: গবেষক, অধ্যাপক(অর্থনীতি) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)