মিহির

বন্যা নিয়ন্ত্রনে প্রয়োজন সমন্বিত কর্মসূচী

ড: মিহির কুমার রায়: প্রতিবছরই বাংলাদেশে গ্রীষ্মের শেষার্ধ থেকে শরতের প্রথমার্ধে এক বা একাধিকবার বন্যা দেখা দিয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান বৃষ্টিবহুল অঞ্চল উত্তর-পূর্ব ভারতে বর্ষাকালে যে বৃষ্টিপাত হয়,  তা নদীপথে গড়িয়ে এসে সমতলের বাংলাদেশে বন্যা ঘটায়। বার্ষিক এই প্লাবন বঙ্গীয়  বদ্বীপের ফসলি জমির উর্বরতা যেমন রক্ষা করে,  তেমনই অভ্যন্তরীণ ভূমির উচ্চতা বাড়ায় ও উপকূলীয় ভূমির সম্প্রসারণ ঘটায়। নদীর সঙ্গে জলাভূমির সম্পর্ক রক্ষা করে;  মৎস্য সম্পদের আবাসন ও প্রজনন প্রক্রিয়াও সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মনুষ্য সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা কীভাবে জীবন ও সম্পদ বিনাশী হয়ে উঠতে পারে তা প্রায় প্রতিবছরই কম বেশি সে চিত্র দেখা যায়। 

বিভিন্ন নদী অববাহিকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের যে ১১২টি পানি স্তর পরিমাপক স্টেশন রয়েছে;  পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটের বন্যা মানচিত্রে চার রঙের সূচক থাকে যেমন সূচকের রং 'সবুজ'  মানে নদী প্রবাহ স্বাভাবিক; বন্যার ঝুঁকি নেই,  নদীর প্রবাহ যদি বাড়তে শুরু করে এবং বিপদসীমার নিচেই থাকে, তাহলে সূচকের রং হবে  'হলুদ', বিপদ সীমায় পৌঁছলে বা বন্যা দেখা দিলে সূচকগুলো 'কমলা'  রং ধারণ করবে এবং প্রবল বন্যা দেখা দিলে 'লাল'  হয়ে যাবে। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকা এবং উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানিস্তর পরিমাপক স্টেশনগুলোর সূচক ছিল লাল ও কমলা। মধ্যাঞ্চলের সূচকগুলো ছিল হলুদ। এখন যখন সব সূচকই সবুজ, তখন কি আমরা আশ্বস্থ হবো? 

বিষয়টি মনে রাখা দরকার যে এখন কেবল বর্ষাকাল চলছে, একযোগে যখন গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা অববাহিকায় বর্ষণ বেড়ে যাবে, তখন বন্যা আসবে, কখনও কখনও সেই বন্যা প্রাকৃতিকভাবেই প্রলয়ঙ্করী হয়ে ওঠবে। অনেকে বলেন,  সেই বড় বন্যারও একটি প্রাকৃতিক চক্র রয়েছে-  প্রতি পাঁচ বছরে একবার। সাম্প্রতিক অতীতে ১৯৮৮ সাল,   ২০১৭ সালে পর্যন্ত সাতটি বছর আমরা একটি করে বড় বন্যা দেখেছি। এখানে লক্ষণীয়,  প্রতি বছর দেশজুড়ে বড় বন্যার আগে দফায় দফায় 'ছোট'  বা আঞ্চলিক বন্যা হয়। সর্বশেষ বড় বন্যা ২০১৭ সালের পর ইতোমধ্যে পাঁচ বছর কেটে গেছে। আরেকটি বড় বন্যা আসন্ন কেবল এই কারণে নয়;  অতীতের মতো এবার সিলেট ছাড়াও উত্তর বঙ্গে একাধিকবার স্থানীয়ভাবে বন্যা দেখা দিয়েছে। সিলেটের মতো রংপুর অঞ্চলেও কৃষকের ধান খেয়ে গেছে। উদাহরনস্বরুপ বলা যায় চলতি বছরে বাংলাদেশে এপ্রিল-মে মাসে সিলেট বিভাগের হাওয়র এলাকায় বিপুল  বন্যা হয়েছে, বর্তমান জুন মাসে একই প্রকৃয়া চলছে যার ফলে আউস ফসল নষ্ট হয়ে গেছে,   আমন ফসলের বীজতলা তৈরীতে বিঘ্ন ঘটছে যার একটি প্রভাব পড়বে আমন ধানে,  ৪০ লাখ মানুষ পানি বন্দী হয়ে গেছে, সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জানান,  ১২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের আবাদ করা হয়েছে যা বন্যায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।  জেলা মৎস্য কর্মকর্তার মতে বন্যায় মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১০ কোটি টাকা, বিশেষ করে দিন মজুররা খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছেন,  চলমান বন্যায় সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ শতাংশ আর সিলেটের ৮০ শতাংশ তলিয়ে গেছে,  বাজার, দোকান, হাসপাতাল, শিক্ষালয় সব বন্ধ। মার্চ, এপ্রিল,  মে মাসের দু'দফার বন্যায় বোরো ও আউশের পর এবার আমন মৌসুমের জমি তলিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎও কার্যত  যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে দেশের অন্যতম এ প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক শস্য ভান্ডার বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।  সিলেট নগরের অন্যান্ন উপজেলার অন্তত ৫০০ গ্রাম এরই মধ্যে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে এসব এলাকার একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে,  এই অবস্থায় সরকার চলমান বিভিন্ন বোর্ডের মাধ্যমিক পরীক্ষা বন্ধ ঘোষনা করেছে। কেবল সিলেট অঞ্চল নয়;  একই সঙ্গে তলিয়ে গেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম,  মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের বহু অঞ্চল। এ অঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল মেঘালয় পাহাড়ের চেরাপুঞ্জির ভাটিতেই বাংলাদেশের সর্বাধিক বৃষ্টি প্রবণ অঞ্চল শ্রীমঙ্গল। আবহাওয়া পরিসংখ্যান বলছে,  উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে একই সঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে এই জুনে। আর একক সময়ে এই অঞ্চলে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানিই তৈরি করেছে এই আচমকা নিদারুণ বন্যা পরিস্থিতি। বৃটিশ শাসক লিন্ডসে তাঁর লেখায় তখনকার ভাটির সিলেট ও উত্তর-পূর্ব ভারতের যে বিবরণ দিয়েছেন,  সেখানেও বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাওয়ার এমন মর্মান্তিক চিত্র বর্ণনা করেছিলেন। তাহলে এখন বৃষ্টি হলেই কেন হাওর তলিয়ে যায় বা এভাবে কেন সর্বব্যাপী প্লাবিত হলো সিলেট ও সুনামগঞ্জ?

এখন এর কারন অনুসন্ধান করে জানা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীজুড়েই চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া এখন। কোথাও অতি বৃষ্টি, আবার কোথাও  খরা। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে এবার ১২৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে বৃষ্টি হয়েছে। উজানের নদীগুলোয় বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না,  অথচ বন্যা মৌসুমে বাঁধের গেট খুলে দেওয়ায় ঢল নামে। বাংলাদেশের নদী,  হাওর ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো দখল ও দূষণে আমরা প্রায় মেরে ফেলেছি। এরপর অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রকৃতি বিরুদ্ধভাবে বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে,  পলিথিন ও পলিতে জলাশয়ের পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে এবং বড় বন্যার পেছনে এমন বহু কারণ রয়েছে যেগুলো দীর্ঘদিনে অবহেলার অযাচিত ফসল মাত্র।

ব্রিটিশ আমলে হাজারো জায়গায় কাটাকুটি করে গেছে পূর্ব-পশ্চিমগামী রেললাইন যার ফলে বন্যার পানি বয়ে যাওয়ার বন্যায় ভরে যাওয়া ভূমিতে উঁচু রেল বাঁধ পড়েছে,  এভাবে নদী শাসনের নামে নদীর গতি নষ্ট করে সৌভাগ্যের জননীকে পরিণত করা হয় দুর্যোগের ডাকিনীতে। ব্রিটিশ নদী প্রকৌশলী স্যার উইলিয়াম উইলকক্স ১৯২৮ সালে দেওয়া এক বক্তৃতায় অভিযোগ করেন,  ‘ইংরেজ আমলের গোড়াতেই সনাতন খাল ব্যবস্থাগুলোকে কাজে লাগানো ও সংস্কারতো করাই হয়নি, বরং রেল পথের জন্য তৈরি বাঁধের মাধ্যমে এগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।’ 

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জি থমসন ও হিন্দু ও মুসলিম যুগের নদী ব্যবস্থাপনা ধ্বংসকেই বাংলার কৃষি ও জলদেহকে বিপর্যস্ত করার দায় দিয়েছেন। তাতে মাটি অনুর্বর হয়েছে,  মাছের আধার ধ্বংস হয়েছে, ম্যালেরিয়া মহামারি আকার পেয়েছিল এবং নদী স্ফীতিজনিত চাপে নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশ ভরে গেছে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় পৌর্তিক কাজ দিয়ে। ভারতীয় নদী বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত মহলানবীশ সেই ১৯২৭ সালেই বলেছিলেন,  বাঁধের ফলাফল হিসেবে তলানি জমে নদীতল ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসবে যা উন্নয়নবাদীরা শোনেন নি। সে সময়ের এক বড় বন্যা ছিল ১৯৪৩ সালের দামোদরের বন্যা। পবন দাস বাউলের গাওয়া বিখ্যাত গান,  ‘বসুন্ধরার বুকে বরষারই ধারা, তারা ভরা হাহাকার’  সে বন্যা নিয়েই তৈরি করেছিলেন কোনো অজ্ঞাত শিল্পী। ওই সময় ‘ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’ লিখেছিল, ‘বন্যার জন্য দায়ী নদ-নদী নয়, অতি বৃষ্টি নয়,  দায়ী ব্রিটিশের তৈরি রেলপথ’। গানের মধ্যেও রয়েছে সেই ফরিয়াদ। 

এখন এই অবস্থা থেকে উত্তরনের উপায় কি তা খুজে দেখার সময় এসেছে; স্তক্রগ মিশনের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্থান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। ওই কর্তৃপক্ষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং দীর্ঘ মেয়াদি পানি উন্নয়নের যে পরিকল্পনা করে,  সেখানে বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়নই ছিল প্রধান বিষয়। এই কর্তৃপক্ষ ঔপনিবেশিক চিন্তা  থেকেই বাংলাদেশের নদী ও জল প্রবাহকে দেখেছিল। আর সেই ঔপনিবেশিক উন্নয়ন চিন্তাই একের পর এক রুদ্ধ করেছে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের পথ। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে বৃষ্টির কারণে আমাদের এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা অনাবৃষ্টি, অকালবৃষ্টি,  অতিবৃষ্টির মতো ঘটনাকে জলবায়ু সংকটের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। কিন্তু অতিবৃষ্টির ফলে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে আটকে থেকে এলাকার পর এলাকা প্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়া নিশ্চয় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল নয়। সাম্প্রতিক বন্যা আমাদের প্রকৃতি বিরুদ্ধ উন্নয়নের এক অযাচিত ফসল মাত্র। এ থেকে বেড়িয়ে আসার এটাই উপযুক্ত সময়; দ্বিতীয়ত:  আকস্মিক বন্যার কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় কারও কোনো ধরনের প্রস্তুতি  ছিল না অথচ বাংলাদেশকে বলা হয় দুর্যোগ নিয়ন্ত্রনের রোল মডেল যা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে যা বন্যা নিয়ন্ত্রনের কাজে লাগানো হচ্ছে না কেন?  মৌসুমের প্রধান বন্যার আগে আগাম বন্যাগুলোর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সেই প্রাকৃতিক চক্র এবার কাজ করেনি। হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলোর মেরামত ও সংস্কার যেহেতু সময়মতো সম্পন্ন হয়নি;  বেশ কিছু হাওরের প্রায় পাকা ফসল এক বেলার ঢলে কৃষকের চোখের সামনেই তলিয়ে গেছে যা সত্যি ঘটনা এবং আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়,  সিলেটের ছড়াগুলো সংস্কার কিংবা সুরমা খনন নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু কিছু অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে নিতান্ত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া কীভাবে বিপুল মানুষের জন্য দুর্যোগ ও দুর্ভোগ বয়ে আনতে পারে;  সিলেট অঞ্চলে তার সর্বশেষ প্রমাণ এবার পাওয়া গেল। এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মনুষ্য সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা কীভাবে জীবন ও সম্পদ বিনাশী হয়ে উঠতে পারে যা প্রায় প্রতিবছরই কম বেশি সে চিত্র দেখা যায়। এখন থেকে প্রস্তুতি নিলে পরিস্থিতি সামলানো সহজ হবে;  বলাবাহুল্য। বন্যা বাহিত দুর্যোগ মোকাবিলায় কিছু ভূল তথ্য  প্রতি বছর সতর্কতা ও প্রস্তোতির কথা বলেন, নদী দখল, ভরাট বন্ধ করতে বলেন;  বন্যার প্রাকৃতিক পথ মুক্ত রাখতে বলেন কিন্তু দেশের দায়িত্বশীল পদে থাকা আধুনিক গ্রামবাসী সতর্ক হন না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত:  এবারও একই চিত্র স্পষ্ট। বরং ছোট বন্যায় বড় ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। এখনও সতর্ক না হলে বড় বন্যায় বৃহত্তর বিপর্যয় অনিবার্যভাবেই অপেক্ষা করে থাকবে; তৃতীয়ত:  আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌসুমি বৃষ্টিপাত পূর্বাভাস ২০২২ সালের জুন,  জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট,  ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নির্দেশ করেছে। এ পূর্বাভাস সঠিক হলে সুরমা ও মেঘনা অববাহিকায় চলমান বন্যা ছাড়াও তিস্তা  ও যমুনা নদীর অববাহিকায় স্বাভাবিকের চেয়ে বড় বন্যার শঙ্কা আছে। আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আবহাওয়া পূর্বাভাসে আগেই বিষয়টি এসেছে। বড় বন্যার শঙ্কার কথা গত ৪ জুন সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসেছে এবং এছাড়া বেশ কিছু টেলিভিশনে ৫ ও ১২ জুন আমি স্পষ্ট উল্লেখ করেছি,  জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিলেট বিভাগে খুবই ভারি বৃষ্টিপাত হবে যা ৬০০ থেকে ১ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম। ফলে একথা বলার সুযোগ নেই,  এবারে বন্যা হঠাৎ এসেছে। একইভাবে একথা বলা পুরোটাই অন্যায় হবে যে,  আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ ছিল না। আগে থেকে প্রচার করলে ক্ষতি কমিয়ে আনা যেত। সরকারি দপ্তরগুলো এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর আবহাওয়া পূর্বাভাসের জন্য নিজেরা যে গাণিতিক আবহাওয়া মডেল ব্যবহার করে,  সেটিও আমেরিকার তৈরি যা হলো আঞ্চলিক মডেল। আবহাওয়া পূর্বাভাসের গাণিতিক মডেলগুলো চালাতে খুবই উচ্চ শক্তির কম্পিউটার দরকার এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়,  বর্তমানে ডব্লিউ আর এফ নামক গাণিতিক আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলটি ব্যবহার করে যা থেকে ৭ থেকে ১০ দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাস অনেক নির্ভুলভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু সেটি তারা মানুষের কাছে পৌঁছাতে গণমাধ্যমের সাহায্য নেওয়া উচিত; চতুর্থ:  সাম্প্রতিক কালের বন্যাগুলোর ভয়াবহতা বৃদ্ধির বেশ কিছু মানব সৃষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। যার মধ্যে অন্যতম হলো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করায় ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি,  বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করা এবং অতি বৃষ্টির সময় হঠাৎ বাঁধের সব পানি ছেড়ে দিয়ে বাঁধের ভাটির জনপদে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে যেমন পদ্মা নদীর উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তার নদীর উজানে ভারতের গজলডোবা বাঁধ থেকে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ বাঁধের সব দরজা খুলে দিয়ে পদ্মা ও তিস্তা নদীর উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রনালয় যেমন পররাষ্ট্র, পানি সম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে যা সময়ের দাবি বলে প্রতীয়মান হয়। মনে রাখতে হবে,  দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ যার অবস্থান এখন সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম যা 'বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১'  শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে যা জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচ থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছে। তাই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান বাড়াতে হবে,  আঞ্চলিক সমন্বয় বাড়াতে হবে। আগামীতে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যার কথা জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে এবং দায়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে; পঞ্চমত: দীর্ঘ মেয়াদীভাবে বন্যা প্রতিরোধে আন্ত: নদী পানি প্রবাহ সংযোগসহ যে সকল আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে তার সফল প্রয়োগ সময়ের দাবি বিশেষত:  ভারত ও চীনের সাথে। এখন পর্যন্ত গঙ্গা চুক্তির সুফল আমরা তেমন কিছুই পাই নাই এবং যা হয়েছে তা হলো শুষ্ক মৌসুমে আমরা মৃত পদ্মা পেয়েছি যা রাজশাহী অঞ্চলের মরুকরনকে ত্বরান্বিত করছে। এখন বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে  কূটনীতিতে  বিশেষতঃ ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সর্বশেষ বিষয়গুলোতে যে সফলতা দেখিয়েছে তা আরো জোরদার করতে হবে। সর্বশেষে বলা যায় এখন আমাদের গ্রামীন অর্থনীতির যে অঞ্চলগুলো ফি-বছর বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে তা নিয়ে সরকারের নিবীড় ভাবনা জোরদার করতে হবে এবং এখন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এবং বৃহৎ নদনদীগুলোর দ্বারা বন্যা কবলিত দুই তীরের জনপদের জীবন জীবিকার স্বার্থে সরকার যদি এগিয়ে না আসে তবে আঞ্চলিক বৈষম্য কমবে না,  ভৌগলিকভাবে মানুষ তার ভিটেবাড়ী কম হাড়াবে এবং দারিদ্র নিরশন কর্মসূচী আরও সফল হবে। সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বন্যা খরার বিষয় এবং এর ফলস্রোতিতে গ্রামীন জীবনের যে পরিণতি সেগুলো অগ্রাধিকার কাজের মধ্যে রাথছেন এবং এগুলোর বাস্তবায়নে সমন্বিত কর্মসূচীর কোন বিকল্প নেই।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডীন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য,  সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


 


Comment As:

Comment (0)