মিহির

কবি নির্মলেন্দু গুন: কর্ম ও জীবন

ড: মিহির কুমার রায়: গত ২১শে জুন, ১৯৪৫ খৃষ্ঠাব্দ, নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার কাশতলা (বর্তমানে কাশবন)  গ্রামে কবি নির্মলেন্দু গুন জন্মগ্রহন করেন। তার আসল নাম নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী, যিনি নির্মলেন্দু গুণ নামে ব্যাপক পরিচিত। এই নেত্রকোনা জেলাটি ছিল তখনকার আমলে বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রভিন্সের অন্তর্গত। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অপর দিকে নেতাজী সুভাস বোসের নেতৃত্বে স্বদেশী  আন্দোলন তখন একাকার, তার কিছু দিন পর ১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তি শিশু নির্মলেন্দু গুনকে পেয়ে বসেছিল। বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ এবং মা বীণা পাণি দত্ত রায়/গুণ,  বাবা-মায়ের তিন মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে নির্মলেন্দু ছোট ছেলে। মেয়েদের নাম ছিল রুপালী গুন,  সানালী গুন, ঝিল্লিকা বাবু এবং ছেলেদের নাম ছিল নীহারেন্দু গুন ও শৈবালেন্দু গুন। সুখেন্দু প্রকাশ গুণ ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা যার ফলে এই পরিবারটিতে শিক্ষার সবসমই একটা প্রধান্য ছিল। মাত্র চার বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু হলে বাবা পুনরায় বিবাহ করেন এবং নতুন মায়ের (সংযুক্তা গুন)   কাছেই নির্মলেন্দুর শিক্ষা শুরু হয় যা অনেকটা পরিচিত ঘটনা নয়। নির্মলেন্দু গুনের শিক্ষা জীবনটা খুবই বৈচিত্র ভরা যদিও তিনি অত্যন্ত মেধাবী  ছাত্র ছিলেন। প্রথমে বার হাট্টার করোনেশন কৃষ্ণ প্রসাদ ইন্সটিটিউটে তৃতীয শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ছাত্র জীবনের গতিময়তা  দেখা যায় যে ১৯৬২ সালে তিনি দুইটি বিষয়ে লেটার সহ প্রথম বিভাগে মেট্রিক পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ন হন,  এরপর আই.এস.সি পড়তে চলে আসেন ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে,  মেট্রিক পরীক্ষায ভালো রেজাল্টের সুবাদে পাওয়া রেসিডেন্সিয়াল স্কলারশিপ সহ পড়তে থাকেন।  তার কিছুদিন পর তিনি নেত্রকোণার করেজে চলে আসেন এবং ১৯৬৪ সালের জুন মাসে আই.এস.সি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের  ১১৯ জন প্রথম বিভাগ অর্জনকারীর মাঝে তিনিই একমাত্র নেত্রকোণা কলেজের প্রার্থী ছিলেন৷ পরবর্তীতে বাবা চাইতেন ডাক্তারী পডাতে কিন্তু নিমর্লেন্দু গুন চান্স পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ফার্মেসি বিভাগে পড়তে,  ভর্তির প্রস্তুতি নেন নির্মলেন্দু গুণ৷ হঠাৎ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয় ঢাকায়। দাঙ্গার কারণে তিনি ফিরে আসেন গ্রামে৷ ঢাকায় অবস্থার  উন্নতি হলে ফিরে গিয়ে দেখেন তাঁর নাম ভর্তি লিষ্ট থেকে লাল কালি দিয়ে কেটে দেওয়ায় আর ভর্তি হওয়া হলো না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে৷  ফিরে আসেন গ্রামে৷ আই.এস.সি-তে ভালো রেজাল্ট করায় তিনি ফার্স্ট গ্রেড স্কলারশিপ পেলেন মাসে ৪৫ টাকা, বছর শেষে আরও ২৫০ টাকা যা তখনকার দিনে অনেক টাকা৷ ১৯৬৯ সালে প্রাইভেটে বি.এ. পাশ করেন তিনি, যদিও বি.এ.  সার্টিফিকেটটি তিনি তোলেন নি। ১৯৬৫ সালে আবার বুয়েটে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সে সময় পাক-ভারত যুদ্ধ। 
 
এইতো গেলো নির্মলেন্দু গুনের জন্ম, পারিবারিক ও শিক্ষার পরিচয়। এখানে উল্লেখ্য যে বিগত মঙ্গলবার ইংরেজী ২১শে জুন, ২০২২ খৃষ্ঠাব্দ, বাংলা ৭ই আষাঢ়, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ছিল কবি নির্মলেন্দু গুনের ৭৭তম জন্মদিন উপলক্ষে তার প্রতি রইল প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। এই প্রবন্ধটি তারই জন্মদিন উপলক্ষে তাকে স্মরন করার একটি প্রয়াশ মাত্র। এখন আসা যাক তার কবি পরিচিতি নিয়ে সাহিত্য কর্ম এর উপর আলোচনায় এবং স্কুল জীবনেই নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণের প্রথম কবিতা ‘নতুন কান্ডারী’  ‘উত্তর আকাশ’  পত্রিকায়৷ নেত্রকোণার সুন্দর সাহিত্যিক পরিমন্ডলে তাঁর দিন ভালোই কাটতে থাকে৷ এবং সূর্য ফসল নামে একটি ম্যাগাজিন পত্রিকার  সম্পাদক নিযুক্ত হন যা ছিল অনেকগুলো পত্রিকার সংকলন কিন্তু তখনকার সরকার এটি বাজেয়াপ্ত করে তাকে কারাবন্দি করে যদিও  পরবর্তিকালে তার দু-বন্ধুর সহযোগিতায় কারাবন্দী থেকে মুক্ত হন। কিছু দিনের জন্য তিনি তার নিজ এলাকায় বারহাট্টা স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় একটি কবিতা জার্নাল কন্ঠস্বর প্রকাশ করেন। তারপর তিনি আজাদি পত্রিকা, মাসিক মোহাম্মেদিয়া,  সংবাদ, চাষী, মাসিক তকবির ইত্যাদিতে  কাজ করেছেন যা কোনভাবেই তাকেই আর্থিক সচ্ছলতা এনে দেয়নি। তিনি বামপন্থী ধারার  অনুসারি বলে প্রতিবার বাধাপ্রাপ্ত হতে হয় যদিও তার বন্ধুরা তাকে সহায়তা করেছেন বিভিন্ন সময়ে যা অনেক ক্ষেত্রে স্মরণীয়।  তার ছন্ন ছাড়া জীবনে কখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের জগন্নাথ হল, কখনও ইকবাল হল, কখনও বুয়েটের আহসানুল্লাহ হলে বন্ধুদের সাথে থাকতেন যা সচরাচর কবি সাহিত্যিকদের বেলায় হয়ে থাকে। 

নির্মলেন্দু গুণ নামে ব্যাপক পরিচিত, একজন কবি ও চিত্রশিল্পী। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য ও ভ্রমণ কাহিনিও লিখেছেন। তাঁর কবিতায় মূলত প্রেম, শ্রেণি সংগ্রাম ও স্বৈরাচার বিরোধিতা,  এই বিষয়গুলো প্রকাশ পেয়েছে। যৌবনে এই কবি কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ  ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশিত হওয়ার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে।  এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীকালে এর উপর ভিত্তি করে তানভির মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এছাডাও তাঁর স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হল কবিতাটি বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যাযের পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য। কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন গল্প এবং ভ্রমণ সাহিত্য। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম হল ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’, ‘কবিতা, অমীমাংসিত রমণী’, ‘দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’, ‘দূর হ দুঃশাসন’,  ‘চিরকালের বাঁশি’, ‘দুঃখ করোনা, বাঁচো’, ‘আনন্দ উদ্যান’, ‘পঞ্চাশ সহস্র বর্ষ’, ‘প্রিয় নারী হারানো কবিতা’,  ‘শিয়রে বাংলাদেশ’, ‘ইয়াহিয়া কাল’, ‘আমি সময়কে জন্মাতে দেখেছি’, ‘বাৎস্যায়ন’, ‘রক্ষা করো ভৈরব’ ইত্যাদি। ‘আপন দলের মানুষ’ শিরোনামে রয়েছে তার একটি গল্প গ্রন্থ। এছাড়া লিখেছেন ‘সোনার কুঠার’ নামের একটি ছড়া গ্রন্থ।  ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘আমার কণ্ঠস্বর’ ও ‘আত্ম কথা ৭১’  শিরোনামে রয়েছে তিনটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। তাছারাও চৈত্রের ভালবাসা, নহ প্রেমিক, নহ বিপ্লবি,  ইত্যাদি তার অন্যন্ন কবিতা সংগ্রহ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার অনেক লেখালেখি রয়েছে যা স্মরন করার মত। লাইব্রেরী অব কংগ্রেস তার ৩৭টি প্রকাশনার শিরোনাম অন্তর্ভূক্ত করেছে  এবং বাংলাদেশের পাচ জন কবির মধ্যেও তিনিও সুইডেনে অনুষ্ঠিত গটেনবার্জ বই মেলা, ২০১৩ তে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।

সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য নির্মলেন্দু গুণ পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কার। তার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০১১ সালে একুশে পদক, ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার।

ব্যক্তিগত জীবনে নির্মলেন্দু গুন এক কন্যা সন্তানের জনক যার নাম মৃত্তিকা গুন। আমরা কবির দীর্ঘ জীবন ও সু-স্বাস্থ্য কামনা করি। 

লেখক: অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)