DCCI Picture_Bi-annual_14

ঢাকা চেম্বারের সেমিনারে বক্তারা

‘অর্থনীতিতে বিদ্যমান চাপ সাময়িক’

নিজস্ব প্রতিবেদক: শুধুমাত্র বাংলাদেশের অর্থনীতিই নয়, বৈশ্বিক সংকটের কারণে পুরো বিশ্বব্যবস্থাই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, জ্বালানি সংকট এবং সাপ্লাইচেইনের বিপর্যস্ত অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতে, বেড়েছে মূল্যস্ফীতি, এমতাবস্থায় আমাদের অর্থনীতিতে বিদ্যমান চাপ সাময়িক বলে মত প্রকাশ করেন ঢাকা চেম্বার আয়োজিত সেমিনারের আলোচকবৃন্দ। 

উল্লেখ্য, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) রবিবার (১৪ আগস্ট, ২০২২) ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জানুয়ারি-জুন ২০২২) বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে, যেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। 

সংসদ সদস্য ও এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি মোঃ শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।   

সেমিনারের সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকা চেম্বারের ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি আরমান হক।  

ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান উক্ত ওয়েবিনারে ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটের উপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মূল প্রবন্ধে তিনি অর্থনীতিতে বৈশ্বিক সংকট ও কোভিড মহামারীর প্রভাব, এলডিসি উত্তরণ, জাতীয় বাজেট ও মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, কৃষি, উৎপাদন ও সেবা খাত নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে গত অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৯.৫% এবং আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪০.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এছাড়াও কোভিড মহামারীর কারণে জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২৩.৭% নেমে এসেছে, যদিও গত অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি প্রথমবারের মত ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। 
তিনি জানান, এলডিসি উত্তরণের কারণে আমাদের রপ্তানি আয় প্রায় ৫.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে যেতে পারে, তা মোকাবেলায় বিদ্যমান শুল্ক প্রতিবন্ধকতা নিরসন, বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর সাথে ‘রিজিওন্যাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনেমিক পার্টনারশীপ এগ্রিমেন্ট (সেপা)’ স্বাক্ষর এবং দ্রুত ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ করা অপরিহার্য। ডিসিসিআই সভাপতি উল্লেখ করেন, বৃহৎ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শতভাগ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পুরো রাজস্ব ও শুল্ক ব্যবস্থার অটোমেশন এবং করজাল সম্প্রসারণের কোন বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের ঋণ গ্রহণের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ আশাব্যঞ্জক নয় বলে মত প্রকাশ করেন, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি। বৈশ্বিক সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক সাপ্লাইচেইন প্রভাবিত হওয়ায় স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যের ঊর্ধ্বগতি মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিচেছ, ফলে ভোগান্তিতে পড়ছে দেশের সাধারণ জনগন, এ অবস্থা নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করছে, তবে স্থানীয় বাজারে ডলারের মূল্যের অস্থিতিশীলতা নিরসনে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান, রিজওয়ান রাহমান। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং ডলারের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি আমাদের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে ব্যাহত করতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। বিশেষকরে কৃষি ও কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতের আধুনিকায়ন, চামড়াখাতে বন্ড লাইসেন্সের সীমা ৩ বছর পর্যন্ত বর্ধিতকরণ, ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ট্যাক্স হলিডে সুবিধা সম্প্রসারণ ও এপিআই উৎপাদনে ভ্যাট এবং এসিডি প্রত্যাহার, হালকা প্রকৌশল খাতের স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়ন ও স্বল্পসুদে ঋণ সহায়তা প্রদান, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধা প্রাপ্তিতে ব্যাংক ঋণ নীতিমালার সহজীকরণ ও নতুন সংজ্ঞায়ন, দেশের দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে একটি দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম সম্প্রসারণের আহ্বান জানান ঢাকা চেম্বার সভাপতি।
 
বিশেষ অতিথি’র বক্তব্যে সংসদ্য সদস্য ও এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি মোঃ শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) বলেন, কোভিডকালীন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যবসায়ী সমাজ বিশেষ করে এসএমই খাতের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই জ্বালানি সংকটে রয়েছে, আমাদের টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অফশোর গ্যাস কূপ অনুসন্ধান কার্যক্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি বাপেক্সকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। মহিউদ্দিন জানান, এ মূহুর্তে বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা বেশ ভালো নয়, সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে, তারপরও আমাদের রিজার্ভ সাড়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম, যা বেশ স্বস্তিদায়ক। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অস্বস্তিকর অবস্থাকে সাময়িক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, সরকার বিষয়গুলোকে যচেষ্ট দক্ষতার সাথে মোকাবেলার সর্বাত্বক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, দেশের ব্যবসায়ী সমাজের পাশাপাশি সার্বিকভাবে অর্থনীতির অধিকতর অগ্রগতির লক্ষ্যে রাজস্ব বিভাগকে হয়রানির মনোভাব পরিহার করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। 

প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, স্থানীয় বাজারে ডলারের উপর চাপ কমানো, ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার অতিদ্রুত বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বৈশ্বিক সংকটের কারণে পণ্য আমদানি ব্যাহত হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, তবে অর্থনীতি নিয়ে আতংকিত হওয়ার তেমন কোন কারণ নেই বলে, তিনি মত প্রকাশ করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কিছুটা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনঃবিবচেনা করা যেতে পারে বলে প্রতিমন্ত্রী অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে দেশের উৎপাদন খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২৩%, যা আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ইতিবাচক দিককে বহন করে। মন্ত্রী বলেন, হয়রানি রোধ, কর আহরণ বৃদ্ধি এবং করজাল সম্প্রসারণে দেশের রাজস্ব কাঠামোর অটোমেশনের কোন বিকল্প নেই। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমরা প্রায় ১০ লক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে সক্ষম হয়েছি, যার ফলে আগামীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বৃদ্ধি পাবে। তিনি জানান, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ পাট, চামড়া ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রভৃতি খাতের প্রতিটি হতে ১ বিলিয়ন ডালারের বেশি পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়, এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি আরো বাড়াতে সম্ভাবনাময় খাত সমূহের উপর বেশি হারে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান।

ওয়েবিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোঃ হাবিবুর রহমান এবং বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম অংশগ্রহণ করেন। 

বাংলাদেশ ব্যাংক-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, মুদ্রা প্রবাহ স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে অর্থনীতির গতিধারা অব্যাহত রাখতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করে আসছে এবং বিশেষকরে কোভিড মোকাবেলায় বেশ কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদান করেছে। তিনি জানান, ভারত এবং চীনের মত বেশ কিছু দেশের সাথে স্থানীয় মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমাদের ম্যানুফেকচারিং খাতে গ্যাসের চাপ উল্লেখযোগ্য হারে কম থাকায় শিল্প-কারখানায় পণ্য উৎপাদন মারাত্বকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায় ব্যয় বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতি উল্লেখজনক হারে বৃদ্ধি পাবে, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পেলে স্থানীয় বাজারে জ্বালানির দাম সমন্বয়ের উপর তিনি জোরারোপ করেন। এছাড়াও ব্যাংক এবং খোলাবাজারে ডলারের ক্রয়-বিক্রয়ের বিশাল তারতম্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন, বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি এবং ডলারের ক্রয়-বিক্রয়ের তফাত ১টার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে মত প্রকাশ করেন। ব্যবসায়ীদের হয়রানি রোধে তিনি রাজস্ব কাঠামোর পুরোপুরি অটোমেশনের আহ্বান জানান এবং সাব-কন্ট্রাক্টিং-এর উপর এনবিআর প্রবর্তিত শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন।

ঢাকা চেম্বারে সহ-সভাপতি মনোয়ার হোসেন সহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
     
বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)