মিহির কুমার রায়

হরিপদ কাপালীর আবিষ্কৃত হরি ধানকে বাঁচাতে হবে

ড:মিহির কুমার রায়: ঝিনাইদহের কৃষক শ্রী হরিপদ কাপালীর হাতে হরি ধানের আবিষ্কার দুই দশক আগে যার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ হয়নি কেবল দারিদ্রতার কারনে। এখানে উল্লেখ্য যে হরিপদ কাপালী ১৯২২ সালেঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন এবং ২০১৮ সালের ৬ই জুলাই নিজ শ্বশুরালয় আহসান নগর গ্রামে মৃত্যু বরন করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী সুনিতী কাপালী ও এক দত্তক সন্তানরুপ কুমার কাপালীকে রেখে যান। জনাব হরিপদ কাপালীর শেষকৃত্য সম্পন হয় চুয়াডাঙ্গা জেলার আলীয়ারপুর শ্বাশান ঘাটে যেখানে স্থানীয় কৃষি অফিসের কমকর্র্তাসহ আত্মীয় স্বজন উপস্থিত ছিলেন।

শ্রী হরিপদ কাপালীর গবেষনা ধর্ম্মী কাজ শুরু হয় মূলত ২০০২ সালে যেখানে ইরি ধানের খেতে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেন তিন-চারটি ধানের গাছ, যা অন্যগুলোর থেকে মোটা ও আকারে বড়। এই চিন্তা থেকে ভালো ফলন হতে পারে এমন আশায় সেগুলো রেখে দেন এই কৃষক গবেষক। পরবর্তী সময়ে এর বীজ থেকে চারা তৈরি করে ছোট্ট এক জায়গায় পরীক্ষামূলক চাষ করেন। সেখানেও ফলন ভালো হয়। এরপর থেকে এ ধানের চাষ বাড়াতে থাকেন হরিপদ কাপালী এবং পরে স্থানীয়ভাবে ও আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে বিন্তর লাভ করে দেন এ ধান। এটি ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে হরি ধান হিসেবে। বর্ষা মৌসুমে চাষকৃত মোটা জাতের এ ধানের বিঘাপ্রতি ফলন হয় গড়ে ১৫- ১৬ মণ হারে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলনামূলক অনেক কম এবং ভাত খেতে অনেক সুস্বাদু হওয়ায় একসময় ধানটি স্থানীয় কৃষকের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর থেকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ধানটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গবেষকরা বলছেন, হরি ধান মূলত ধানের জিনগত মিউটেশন সৃষ্ট জাত। ইনব্রিড জাত, হাইব্রিড নয়। হাইব্রিডের ক্ষেত্রে বীজ বারবার কিনতে হয়। পরের বছরের জন্য বীজ করে চারা করলে উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু ইনব্রিড ধানে প্রায় শতভাগ উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব । এই সফল আবিস্কারটি নিয়ে প্রথমে বেসরকারী টিভি চ্যানেল আই এর পরিচালক ও গনমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সাইক সিরাজ প্রচারে নিয়ে আসে যা সকল কৃষিগবেষক মহলে ব্যাপক উৎসাহের বিষয়ে পরিণত হয় ।।বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকগনের একটি দল শ্যী হরিপদ কাপালীর গবেষনার ক্ষেত্র পরিদর্শন করেন এবং বিভিন্ন যুক্তি তর্কে অবতির্ণ হয় এই বলে যে এটি কোন নূতন আবিস্কার নয় যাকে বলা হয় ভ্যারইটেল ট্রায়েল যা এর আগে অনেক দেশেই হয়েছে । কিন্তু মিডিয়া ব্যক্তি সাইক সিরাজের প্রচারনায় বিষয়টি সরকারের নজরে আসে এবং সরকারের কৃষি বিভাগ পরীক্ষামূলক হিসাবে জামালপুর জেলাকে বেছে নয় এবং হরিধান চাষে কৃষকদের পরামশর্ দেয় । বিষয়টি যখন ধীরেধীরে এগুতে থাকে তখন প্রতিযোগিতার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে এবং কৃষি বিভাগ ব্রি-১১, ব্রি-৫৬ জাতের চেয়ে হরি ধানের ফলন কম বলে যুক্তি দিচ্ছে। তারা দেখিয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি হরি ধানের উৎপাদন হার যেখানে ৪ দশমিক ২ টন, সেখানে ব্রি-৫৬র উৎপাদন হার তার চেয়েও বেশি যা হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৭৪ টন অথচ স্বাধীন গবেষণায় উল্টো তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, হরি ধান আমন মৌসুমের উচ্চফলনশীল জাত ব্রি-৫৬-এর চেয়েও বেশি ফলন দেয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ব্রি-৫৬-এর গড় উৎপাদন যেখানে ৫ দশমিক ৫১ টন, সেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে হরি ধান উৎপাদন হয় ৬ দশমিক শূন্য ৮ টন। কাজেই হরি ধান ফলন কম দেয় তাদের এমন দাবি কতটা যুক্তিসংগত, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে।

এখন হরিধানের বীজ সম্প্রসারন ও অনুমোদনের যে প্রশাসনিক পদ্বতি তার জালে আটকে গেছে এই হরি ধানের ভবিষ্যত । তথ্য উপাত্ব বলছে উচ্চফলনশীল জাতটির উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী সরকারি জেলা পর্যায়ের কিছুপুরস্কার পেয়েছেন যেমন জেলা প্রশাসক পুরস্কার, কৃষি সম্প্রসারন পুরস্কার,গনস্বাস্থ্য পুরস্কার,রোটাারি ক্লাব পুরস্কার,চ্যানেল আই পুরস্কার ইথ্যাদি। কিন্তু ২০১৮ সালে হরিপদ কাপালীর মৃত্যুর পর হরি ধানটি এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়নি। নিয়ম অনুযায়ী স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কিছু নিয়ম ও নানা শর্ত পূরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রথমে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে আবেদন করতে হয়, এরপর পরীক্ষা করা হয়, টিকলে সেটা বীজ বোর্ডে আবেদন করলেই অনুমোদন মেলে। বীজ বোর্ডে এখন বীজ ব্যবসায়ীদের একটা আধিপত্যের খবর মিলছে, হরি ধান জাত হিসেবে স্বীকৃত না হওয়ার পেছনে তাদের একটা প্রভাব থাকতে পারে বলে অনেকের অভিমত। স্থানীয় কৃষকের ভাষ্যে গুণে-মানে হরিধান এগিয়ে থাকলেও বীজকেন্দ্রিক রাজনীতিতে এর স্বীকৃতি না পাওয়াটা দুঃখজনক।

আরও বিষয় হলো স্বাভাবিকভাবে হরি ধানের বাজারও সম্প্রসারণ ঘটেনি। এর পেছনে যথাযথ সংরক্ষণের ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক শৈথিল্য, অনীহা, মাঠ সম্প্রসারণে তদারকির অভাবসহ আরো ফ্যাক্টরের কথা উঠে এসেছে। একটা সময় ধান বীজের পুরো উৎস ছিল গ্রামের কৃষক। কৃষক নিজে বীজ সংরক্ষণ করতেন, সে বীজ বিক্রি করতেন অন্য কৃষকের কাছে। সময়ের ব্যবধানে বীজ নিয়ে গবেষণা, উন্নয়ন ও উৎপাদনে যুক্ত হয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানি শুরু করে। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা বরাবরই স্থানীয় জাতগুলোকে বাজার ব্যবস্থাপনায় আসতে নানাভাবে বাধা গ্রস্থ করে। হরি ধানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, দেশীয় প্রজাতির উদ্ভাবিত এ উচ্চফলনশীল জাত সুকৌশলে একটি মহল বাজার থেকে উঠিয়ে দিয়েছে। জাতটির আবাদ সম্প্রসারণ না করে উল্টো মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ধানটির চাষাবাদ কমেছে। হারিয়ে গেছে স্থানীয় পর্যায়ে হরি ধানের মত উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল অনেক ধানবীজ, বিলীনের পথে আরো কিছু জাত। এর মধ্যে হরি ধান অন্যতম। বিভিন্ন গবেষণায় এ ধানের উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও কম সার লাগার তথ্য মিলেছে। দীর্ঘ সময় পেরোলেও এ ধানের আবাদ সম্প্রসারণ করা যায়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত বীজের জাত হিসেবে এর সরকারি স্বীকৃতিও মেলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় এ জাতটির বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এর সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। কৃষি ক্ষেত্রে নানা অগ্রগতি হলেও ফলন বাড়াতে গুণগত মানের বীজের ঘাটতি আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা। সেক্ষেত্রে হরি ধানের মতো মোটামুটি পরীক্ষিত একটা ভালো বীজের প্রায় অবলুপ্তির সংকট তৈরি হওয়াটা ভীষণ উদ্বেগজনক। জাতটি সংরক্ষণ ও বাজার সম্প্রসারণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে । কারন দেশের কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হাইব্রিড বীজের পাশাপাশি স্থানীয়
প্রজাতির উচ্চফলনশীল জাতগুলোও বড় ভূমিকা রেখেছে। নতুন নতুন জাত উন্মোচন হলেও হরি ধানের মতো সেগুলো বাজার কাঠামোয় অনেকটা সংকুচিত। নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে বড় বীজ প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় উন্নত বীজগুলোর স্বীকৃতি প্রক্রিয়া থেকে শুরুকরে বাজার সম্প্রসারণ ব্যাহত করছে। এটা বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় উচ্চফলনশীল ধানবীজগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ, বাজার ও আবাদ সম্প্রসারণ করতে হবে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তায় স্থানীয় বীজের প্রসার নির্বিঘ্ন হবে বলে প্রত্যাশা।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা ও সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি,ঢাকা।


 


Comment As:

Comment (0)