মিহির

আইএমএফ’র ঋণ, অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়ন ভাবনা

ড: মিহির কুমার রায়: বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশে ঘাটতি বাজেট পূরনের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহন ও সময়মত পরিশোধকরন একটি চিরাচরিত বিষয় বলে বিবেচিত। এছাড়া বাজেটে এর জন্য একটি নিদৃষ্ঠ অর্থ বরাদ্ধ রাখা হয়। বাংলাদেশে বাজেটে যে ঘাটতি থাকে,  তা জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি নয় এবং ঘাটতি পূরণের উৎসের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ একটি যার জন্য বাংলাদেশের ট্র্যাক রেকর্ড প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশে এখন সব মিলিয়ে যে ঋণ নিয়েছে, তা জিডিপির ৪০ শতাংশ যা অন্যান্ন দেশে ১০০ শতাংশের বেশি। যেমন: প্রতিবেশী দেশ ভারতের ঋণ জিডিপির হার ৫০ শতাংশের এবং ইংল্যান্ডে ১১৫ শতাংশ। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ১২.৫ শতাংশের মতো। বিগত আর্থিক বছরে জুন শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ৯০০ কোটি ডলার এবং এবার বাজেটে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধের জন্য রাখা হয়েছে, যার মধ্যে সুদ বাবদ রাখা হয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের প্রধান উৎস হলো বিশ্ব ব্যাংক,  আইএমএফ, জাইকা, ইউএনডিপি ইত্যাদি।এই সকল প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ বিশেষত: দীর্ঘ্যমেয়াদে অবকাঠামো উন্নয়নে ঋণ ব্যবহার করে থাকে। 

কভিড-১৯ পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ যা বাংলাদেশের ব্যাপারেও প্রযোজ্য যা মোকালোর জন্য অর্থের প্রয়োজন, বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে। একদিকে রফতানি আয় কমছে, আমদানি ব্যয় বাড়ছে, বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ কমছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ক্রমশই অবনতশীল বিধায় মূল্যস্ফীতি এখন চরমে উঠেছে যা সাধারন মানুষের জীবনমানকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এই ধরনের একটি বৈশ্বিক পরিস্থিতির  মোকাবেলায়  চলতি বছরের ২৪ জুলাই বাংলাদেশ সরকার ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা চেয়ে আইএমএফ সংস্থাটিকে পত্র দেয় যেখানে বলা হয়েছিল,  চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের বার্ষিক বোর্ড সভার ফাঁকে আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেখানে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে মৌখিকভাবে আশ্বাস পাওয়া যায়।

আইএমএফ তিনটি উইন্ডোতে ঋণ দিচ্ছে। এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইইএফ) এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)। আরএসএফ নতুন একটা উইনডো, যা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত। এতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে।

ওই ঋণের ব্যাপারে আলোচনা করতে আইএমএফের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় আসে এবং আইএমএফ এর প্রতিনিধি দলটি ১৫ দিনের বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং এই দলটি ৯ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানকালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড,  বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের নীতি নির্ধারক এবং অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করেন। আইএমএফের প্রতিনিধি দলটির সম্ভাব্য আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব খাতে সংস্কার, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হারের কাঠামো সহজ করা, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা,  ব্যাংক ঋণের বর্তমান সুদ হার ৯ শতাংশ তুলে দেওয়া, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকসহ ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো,  ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা,  নজরদারি বাড়ানো এবং ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতি বিলম্বে সংরক্ষণ।

বাংলাদেশে ১৫ দিনের সফর শেষে সচিবালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফের এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দ বলেন বৈশ্বিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বিধায় এই মুহূর্তে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই সরকারের মূখ্য দায়িত্ব। ঋণের টাকা পাওযার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হবে,  বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়বে এবং এ জন্য সরকারকে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো শর্ত ছাড়াই  বাংলাদেশকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। রাহুল আনন্দ বলেন,  বাংলাদেশ কখনো বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি, ‘আইএমএফ বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগী, দীর্ঘ বছর ধরে এদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে যা  ভবিষ্যতেও এ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। সভা শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্থফা কামাল বলেন আমরা আইএমএফ থেকে যেভাবে ঋণ সহযোগিতা চেযেছিলাম সেভাবেই বাংলাদেশকে মোট সাত কিস্তিত ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে যাচ্ছে যার প্রথম কিস্তি ৪৪৮.৪৮ মিলিয়ন  ডলার ছাড়ের প্রক্রিযা শুরু হবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে।  এরপর পরবর্তী ছয় কিস্তি সমান করে মোট ৬৫৯ মিলিয়ন ডলার করে ছাড় করবে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে এই ঋণ ছাড়ের প্রক্রিযা সম্পন্ন হবে। এ ঋণের গ্রেস পিরিয়ড রাখা হয়েছে  সাড়ে পাঁচ থেকে দশ বছর। আইএমএফ বাংলাদেশে মিশন শেষ করে তারা ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা তাদের প্রধান কার্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ে উপস্থাপন করবে। তার আলোকে নির্বাহী বোর্ডের সভা হবে,  ওই সভায় ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হবে যা সম্পন্ন হতে ২ থেকে ৩ মাস সময় লাগতে পারে।

এ ব্যাপারে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হলো আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করা হয়েছে; অর্থাৎ ঋণ লাগবে, ঋণ যে লাগবে সেটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তারা যে পরামর্শ দিচ্ছে, সেগুলো দেখতে হবে। এ নিয়ে সংবেদনশীল হওয়ার কিছু নেই। সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আইএমএফের দক্ষতা রয়েছে,  সব দেশেই তারা যখন ঋণ দেয়, তখন সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের কিছু কথাবার্তা থাকে, কিছু পরামর্শ থাকে। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কিছু পরামর্শ তারা দিচ্ছে, সেগুলো তারা দিতেই পারে, বাংলাদেশ যদি মনে করে সেগুলো বিবেচনা করলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে,  তাহলে তা পালন করা হবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রায় দুই যুগ ধরেই পরিপক্কতা এবং দক্ষতা দেখিয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ আগে থেকেই আইএমএফের ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল। তাদের যুক্তি ছিল দুটি। যেমন অর্থনীতি আইএমএফের নজরদারিতে থাকলে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের আস্থা বাড়বে এবং সরকার বাধ্য হয়ে সংস্কার করবে। গত দুই দশকে বাংলাদেশে কার্যত বড় কোনো সংস্কার হয়নি। আইএমএফের শর্ত মেনে ভ্যাট আইন করা হলেও তাতে অনেক অসংগতি দেখা গেছে। কেননা এটি অনুমোদনের সময় বাংলাদেশ আর আইএমএফের ঋণের আওতায় ছিল না। একই কারণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রত্যক্ষ কর আইন আলোর মুখই দেখছেনা। বিনিময় হারে কোনো নমনীয়তা ছিলনা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘ সময় ধরে ডলারের বিপরীতে টাকাকে শক্তিশালী করে রেখেছিল। ফলে এখন বিপদে পড়ে অল্প সময়ে বেশি হারে অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নজরদারির কারণে বেড়েছে খেলাপি ঋণ, ঘটেছে একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি। সব রীতিনীতি ভঙ্গ করে সুদ হার বেঁধে দিয়েছে সরকার, যা বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ বছরের পর বছর সংস্কারহীন অবস্থায় আছে। এখন আইএমএফের শর্ত মেনে সে সব সংস্কার করতে হবে তবে অনেকগুলোই জনপ্রিয় হবে না বিশেষ করে ভর্তুকি হ্রাস, কর মওকুফ সুবিধা তুলে নেয়া,  জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি। সুতরাং আইএমএফের ঋণ নিয়ে সরকার কী কী সংস্কার পদক্ষেপ নেয়,  সেটিই এখন দেখার বিষয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর প্রতি তৈরি হওয়া বিদেশী ব্যাংকের আস্থার ঘাটতিও কেটে যাবে, অর্থনীতিতে যে কোনো নাজুক অবস্থা মোকাবিলা করতে এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, উন্নয়ন যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়,  পরিবেশবান্ধব হয়- সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বলা হয়েছে, তা হচ্ছে মূল্যস্ম্ফীতি কমানো এবং আধুনিক মুদ্রা নীতি কাঠামো। এটি বলতে গিয়ে তারা সুশাসন নিশ্চিত করা,  সুদের হারের সীমা তুলে দেওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে। সে যাই হউক না কেন বাংলাদেশ তার সকল বাধা বিপত্তি কাটিয়ে উন্ন্য়নের অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌছবে এবং উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে সারা বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করবে। তবে সেগুলো নিশ্চিত করতে গেলে আমাদের অবশ্যই স্থানীয় রাজস্ব আয় বৃদ্ধি,  রপ্তানিতে প্রণোদনা ও জ্বালানি সহায়তা,  সরকারের খরচ কিংবা অপচয় কমানো এবং আর্থিক খাতের সেবার পরিধি বৃদ্ধি ও সরকারের সামগ্রিক ব্যয় শৃঙ্খলার ওপর জোর দিতে হবে। রাজস্ব আয়ের পরিধি বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা আনতেও প্রণিধানযোগ্য উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।


Comment As:

Comment (0)