মিহির

জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

ড: মিহির কুমার রায়: চলতি ৬ই নভেম্বর থেকে মিসরীয় শহর শারম-আল-শেখে জাতিসংঘের উদ্যোগে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ ২৭ বা কনফারেন্স অব পার্টিজ-২৭) শুরু হয়ে যা ১৮ই নভেম্বর শেষ হয়েছে। যেখানে বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিসহ ১১০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এ সম্মেলনে অংশ গ্রহন করেছেন। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব থেকে  মানব জাতি, জীব বৈচিত্র ও পরিবেশ রক্ষার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছর বিশ্বের কোনো না কোনো শহরে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন, যা বিশ্বব্যাপী কপ  নামে পরিচিত। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরও জাতিসংঘ আয়োজন করেছে জলবায়ু সম্মেলনের ২৭তম আসর। বহু আন্তর্জাতিক সংকটের মীমাংসার ইতিহাস যে ভেন্যুতে  (মিসরের উপকূলীয় সবুজ শহর শার্ম আল-শেখের রেড সি রিসোর্ট), সেখানেই এবারের জলবায়ু সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, সম্মেলনটি জলবায়ু পরিবর্তনের  ওপর জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি) চুক্তি গ্রহণের ত্রিশতম বছরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় উবষর ডেলিভারি ফর পিপল ফর প্লানেট এবং মূল আলোচনার বিষয়বস্তু অভিযোজন, অর্থায়ন, টেকসই জ্বালানি, নেট জিরো, লস অ্যান্ড ড্যামেজ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা। এছাড়া গত কপ সম্মেলনগুলোর সফলতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়েও আলোচনা চলছে।

এবার মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত  সম্মেলনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অ্যান্ডোরার প্রধানমন্ত্রী হাভিয়ের এস্ফট জ্যামোরা রয়েছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান ও প্রতিনিধিরা ছাডাও এই সম্মেলনে উপস্থিত আছেন পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের মেয়র,  সাংবাদিক, সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, জলবায়ু কর্মীসহ অনেকে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রী, পরিবেশ, বন ও জলবাযু পরিবর্তন মন্ত্রণালয-সম্পর্কিত  স্থাযী কমিটির সভাপতি, একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও উপমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যয়ের একটি প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করছেন। এ ছাড়া গত কপ সম্মেলনগুলোর সফলতা ও  ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ জলবায়ু পরিবর্তন বিষযক আরও অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মোট ২৭টি অধিবেশনের মধ্যে প্রথম দুই দিন বিশ্ব নেতাদের বৈঠকের জন্য বরাদ্দ ছিল।

বাংলাদেশসহ জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্থ দেশসমূহ মনে করে কপ-২৭ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বাঁচা-মরার মুহূর্ত। ২৭তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৭) জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সোচ্চার ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম-সিভিএফ’-এর সভাপতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন  মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের সামনে ৪টি দাবি তুলে ধরেছিলেন যা ছিল খুবই সময়োপযোগী। কিন্তু বিশ্বনেতাদের এই প্রস্তাবের প্রতি মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়নি। তারপরও কপ ২৭ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল প্যারিস চুক্তি, গ্লাসগো সম্মেলনে যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলোর সফল বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে প্রকৃতিতে যে ঋতু বৈচিত্র্র তা লোপ পাচ্ছে, এক ঋতুর সঙ্গে আরেক ঋতুর যে পার্থক্য তা মুছে যাচ্ছে, আর্দ্রতা কমে আসার পাশাপাশি তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়ছে, দেশে অসময়ে অনাবৃষ্টি, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়সহ অতি গরম আবহাওয়া তৈরি হচ্ছে, ফলে বাংলাদেশের অনেক এলাকা প্লাবিত হতে পারে, ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে উপকূলীয় এলাকা এবং সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারসহ অন্যান্য এলাকা, ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের পরিবেশ বিরোধী নানারকম ক্রিয়াকলাপের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বায়ু মন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, মিথেন, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি ‘গ্রিন হাউস’ গ্যাসের উপস্থিতি বাড়িয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশের কী করা উচিত, বিশ্বের কী করা উচিত এ বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকে সহায়তার জন্য প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ যা অত্যন্ত তথ্যবহুল, বিজ্ঞানভিত্তিক একটি পরিকল্পনা, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে যেতে হবে।

জলবায়ু সম্মেলনে পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারে পাঁচটি ইস্যু তুলে ধরে সম্মেলনের পর্যালোচনা করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান যেমন: এক - বৈশ্বিক উষ্ণতা: কপ-২৭ এর  অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ সম্মেলনে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে নির্দিষ্ট  সীমারেখা টানা হলেও মিসরে এমন কোন প্রতিশ্রুতি দেখা যায়নি; দুই: ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কেভিন অ্যান্ডারসন দাবি করেন, গ্লাসগো সম্মেলনের পর পৃথিবীতে আরো ৪০  বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসৃত হয়েছে; তিন- ক্ষতিপূরণ: জলবায়ুজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্থ দরিদ্র দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি কপ-২৭  সম্মেলনে আলোচনার অন্যতম ইতিবাচক দিক। শিল্পোন্নত দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ গড়েছে,  জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটিয়েছে যার ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছে অনুন্নত দেশগুলোয়। সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশে ২০৩০ সাল নাগাদ ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতি গুরুত্ব  আরোপ করা হয়েছে; চার-প্রাণ-প্রকৃতি: বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ভয়াবহ প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। হাজার হাজার প্রজাতি এখন বিলুপ্তির হুমকিতে। মেরু অঞ্চলের ভল্লুক  থেকে শুরু “করে সামুদ্রিক প্রবাল অবধি ছড়িয়েছে নেতিবাচক প্রভাব। আগামী মাসে মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিত হবে কপ-১৫ জীববৈচিত্র্য সম্মেলন। সেখানকার আলোচ্য বিষয় এটি। হয়তো এ জন্যই মিসরে এই আলোচনা খুব বেশি প্রাধান্য পায়নি; পাঁচ- জীবাশ্ম জ্বালানি: জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে আনার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে কপ-২৭ সম্মেলনে। জলবায়ু সংকটের পেছনে প্রধান নিয়ামক তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির দহন। ফলে উষ্ণায়নের মাত্রা কমাতে এ সব উপকরণের ব্যবহার সীমিত করতে হবে। এখনই উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ আসছে সব দিক থেকে। ছয়- অভিযোজন: উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্টি নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার কথা ওঠে সম্মেলনে। বন্যা, খরা ও  সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সম্ভাব্য হারে কমিয়ে আনতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, উপকূলবর্তী নিচু ভূমির জনপদকে উঁচু ভূমিতে স্থানান্তরিত করে  ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমানো যায়। নতুন পৃথিবীতে বসবাসের জন্য ক্ষতিপূরণ তহবিলকে দ্বিগুণ করারও প্রস্তাবনা এসেছে। অবশ্য ভবিষ্যতের কথা ভেবে, বিজ্ঞানীরাও এই  তহবিলকে যথেষ্ট মনে করেছেন না।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির মুখে আছে মিসর ও বাংলাদেশসহ বহু দেশ। জাতিসংঘ বলছে, ভূ-রাজনীতির কারণে জ্বালানি, খাদ্য ও পানির সংকটে আছে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর ওপর জোর দিয়েছে সংস্থাটি। এবারো ক্ষতিপূরণ আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আধুনিক প্রযুক্তি পাওয়ার দাবি জানাচ্ছে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলো। এবার যেহেতু বেশি দেশ সম্মেলনে অংশ নিয়েছে, তাই সংকট সমাধানে ভালো কিছুর প্রত্যাশা বাংলাদেশের। বরাবরের মতো এবারো জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর বিপুল ক্ষতি আর হুমকিতে থাকার বিষয়টি জোরালোভাবেই সম্মেলনে উঠে এসেছে। ইমপ্লিমেন্টেশন যেহেতু এবারের জলবায়ু সম্মেলনের মূল বিষয় তাই এ সম্মেলনে ‘ফুড সিকিউরিটির’ ওপর একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় যেখানে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু সহনশীল  কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আরো বেশি পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ‘জাস্ট ট্রানজিশন’-এর ওপর আরো একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় যেখানে জলবায়ু নেতারা এবং স্টেকহোল্ডাররা জাস্ট ট্রানজিশনের উপায় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন যাতে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক ক্লাইমেট অ্যাকশন মানুষ ও  পৃথিবীর রক্ষা নিশ্চিত করে। এছাড়া বিশ্ব নেতারা ‘ইনোভেটিভ ফাইন্যান্স ফর ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। এতে বিশ্ব  নেতৃত্ব ও স্টেকহোল্ডাররা জলবায়ু ঝুঁকি রোধে সরকারি ও বেসরকারি উভয় উৎসের অর্থের সুষ্ঠু এবং পরিকল্পিত ব্যবহারের জন্য একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য  মত প্রকাশ করেন।

জলবায়ু সম্মেলনের তৃতীয় দিনে বিশ্বের উন্নত দেশের কার্বন নিঃসরণকারী কোম্পানিগুলোকে অ্যাকাউন্টেবল করার বিষয় এবং বিশ্বের উন্নয়নশীল ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ক্লিন এনার্জিতে স্থানান্তরের জন্য বিশ্বের উন্নত ও কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর আর্থিকভাবে এবং প্রযুক্তিগতভাবে সহযোগিতার বিষয়গুলো আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। এমন অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করে আলাদা তহবিল গঠন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে খাদ্য  উৎপাদনে টেকনোলজির ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রসারণে উন্নত রাষ্ট্রের সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রোধকল্পে সরকারি ও বেসরকারি উভয় উৎসের অর্থের সুষ্ঠু এবং পরিকল্পিত ব্যবহারের জন্য ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে বের হয়ে আসতে পারে। এবারের সম্মেলনে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা  স্টারজিয়ন কপ২৭ সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজের আওতাধীন ক্ষতিপূরণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার প্রদানের অঙ্গীকার  করেন, পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিশেল মার্টিন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার প্রদানের  অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করেন। এছাড়া অস্ট্রিয়ার জলবায়ু মন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে ৫০ মিলিয়ন ডলার প্রদানের অঙ্গীকার করেন। চতুর্থ দিনে জার্মানি এবং বেলজিয়ামসহ বিশ্বের আরো কিছু সংখ্যক ধনী দেশ এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য  করার জন্য তহবিল প্রদান করবে। এর মধ্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে জার্মানি, স্কটল্যান্ড, বেলজিয়াম, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ভি-টোয়েন্টি গ্রুপ ৫৮টি উন্নয়নশীল দেশকে কিছু অর্থ সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার করেন। জার্মানি ও বেলজিয়াম জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি ফিরিয়ে আনতে ১৭০ মিলিয়ন ইউরো এবং ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

জলবায়ু সম্মেলনের চতুর্থ দিনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে তিনটি ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম ইভেন্টে সাউথ এশিয়ান দেশগুলোর মন্ত্রীদের সঙ্গে একটি  বৈঠক বা সাক্ষাত্কার অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো এবং তা থেকে উত্তরণে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানান এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কী পরিমাণ অর্থ সহায়তা লাগবে সে বিষয়ে আলোচনা করেন; দ্বিতীয় অধিবেশনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ সম্পর্কিত সাউথ এশিয়ান দেশগুলোর প্রস্তাবিত প্রজেক্ট  নিয়ে আলোচনা করা হয়। সন্ধ্যার অধিবেশনে ন্যাশনাল এডাপটেশন প্লান অর্থাৎ বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কী কী কাজ হবে এবং এর জন্য প্রস্তাবিত অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার নিয়ে সেমিনারে অংশ নেন বাংলাদেশের  তথ্যমন্ত্রীসহ বিশ্বের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন।

সেমিনারে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে মোট জ্বালানির ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়ার জন্য  কাজ করছে বাংলাদেশ। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায়বিচার এবং ঋণ উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে এশিয়ান পিপলস মুভমেন্টস নামে একটি মানববন্ধন হয়েছিল। এ মানববন্ধনে লেডি নেকপিল বলেন, ‘জলবায়ুর অর্থায়ন ছাড়া আর কোনো বিচার নেই’। অন্যদিকে  সম্মেলনের স্পিকার বলেন, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বেশি সক্ষম হচ্ছে এবং জলবায়ু সংকট  মোকাবেলায় ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। অন্যদিকে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের কক্ষগুলোয় জলবায়ু সম্পর্কিত আলোচনাগুলো যেমন  গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার পাশাপাশি সম্মেলনের বাইরে অনেক সংগঠন জলবায়ুর ন্যায্যতা, ক্ষয়ক্ষতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার এবং জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের যে দাবি উঠিয়েছে তাও  সমান গুরুত্বপূর্ণ।

জলবায়ু সম্মেলনের পঞ্চম দিনে মূলত জলবায়ু বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় এবং তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে চিন্তা-ভাবনা, তাদের এক্ষেত্রে  সফলতার গল্প ও দাবিগুলো শোনার জন্য প্যানেল আলোচনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি), জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি)সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে জলবায়ু বিজ্ঞানের ওপর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এসব রিপোর্টের ফল এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার তার ওপর বিশদ আলোচনা হয়। এছাড়া গবেষক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ভবিষ্যতেও  বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করতে পারে এবং জলবায়ু বিজ্ঞানভিত্তিক রিপোর্টগুলো ভবিষ্যতেও যাতে প্রকাশ অব্যাহত রাখা যায় তার ওপর আলোচনা হয়। একই  সঙ্গে জলবায়ু সম্মেলনে যুব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরুতে ইউএনএফসিসিসির অফিসিয়াল ফোরাম ইয়াঙ্গু বিশ্বের ১৪৯টি দেশের তরুণদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রস্তাবিত দাবিগুলো ১৫টি বিষয়বস্তুর আলোকে সম্মেলনে তুলে ধরেন। এছাড়া একই দিনে যুবক এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের নিয়ে ‘পাসিং দ্য  বাটন’ শিরোনামে আয়োজিত প্রথম দুটি গোলটেবিল বৈঠকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অংশগ্রহণকারী যুব জলবায়ুকর্মী এবং অনুশীলনকারীরা অ্যাডাপটেশন,  রেজিলিয়েন্স এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে বিশদ আলোচনাক রেন।

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের জলসম্পদ এবং অবকাঠামোর ক্ষতির বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য পায়। এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের ক্ষয়ক্ষতি এবং এ থেকে উত্তরণে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান বাস্তবায়নে ২৩০ বিলিয়ন ডলার দাবি করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ধনী দেশ, বেসরকারি সংস্থাসহ সবাইকে অর্থ তহবিল জোগাতে এগিয়ে আসতে হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা। সম্মেলনের ষষ্ঠ দিনকে জাতিসংঘ, কপ২৭-এর ডি-কার্বনাইজেশন দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেছে। এ দিনে মূলত বিভিন্ন সেক্টর থেকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর বিষয়ে আলোচনা করা হয়। পাওয়ার সেক্টর, সড়ক পরিবহন, স্টিল শিল্প, হাইড্রোজেন জ্বালানি এবং কৃষি এ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আগামী ১২ মাসের মধ্যে অর্থাৎ কপ২৮-এর আগে কার্বনমুক্তকরণকে গতিশীল করতে ২৫টি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে একটি অ্যাকশন প্লান তৈরি করা হয়েছে। প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০৪০ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণ পরিবহন হতে দূষণ রোধ করার জন্য ২০৪০ সালের মধ্যে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সার কৃষি উৎপাদনের অপরিহার্য একটি উপাদান, কিন্তু কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও বর্জ্য থেকে প্রচুর নাইট্রাস অক্সাইড উৎপাদন হয়।  খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ অবক্ষয় রোধে আমাদের কৃষিখাতে প্রভূত গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডগুলি পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে কপ২৭-এর  এজেন্ডা বাস্তবায়নে জি-সেভেনে গঠিত ইউরোপিয়ান কমিশন, ভারত, মিসর, মরক্কোসহ অন্যান্য দেশ, নেতৃত্ব স্থানীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং সরকারি মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিল্প খাতে অর্থায়ন এবং নতুন উদ্যোগ গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। সম্মেলনের সপ্তম দিনকে অভিযোজন এবং কৃষি দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং মূলত অভিযোজন ও  কৃষির ওপর মোট ১২টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম অধিবেশনে কপ২৭-এর উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এ উদ্যোগে লক্ষ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের  কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে কৃষি এবং খাদ্যের জন্য আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয় অধিবেশনে মাল্টি স্টেকহোল্ডার ও মাল্টি সেক্টরাল  উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ উদ্যোগটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানব স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ঝুঁকি কমাবে। অন্যদিকে ক্লাইমেট রেসপন্স ফর সাস্টেইনিং পিস  উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন আরো কীভাবে বাড়ানো যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোয় খরা এবং বন্যার  ক্ষতি কমানোর জন্য পূর্বাভাস প্রদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও তথ্য বিশ্লেষণ বৃদ্ধি, জলবায়ু স্মার্ট-কৃষি এবং এক্ষেত্রে বেসরকারি ও বহুজাতিক মোবাইল  কোম্পানিগুলো কীভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বর্তমান খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির অবস্থা, কীভাবে ‘কোরোনিভিয়া জয়েন ওয়ার্ক অন এগ্রিকালচার’ বাস্তবায়ন করা যায় তার ওপর বিশেষ আলোচনা করা হয়। 

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় শার্ম আল শেখে চলমান জলবায়ু সম্মেলনে পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যথা: ১. যে সকল দেশ বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে তাদেরকে তাদের নিজস্ব কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিমান বৃদ্ধি করতে হবে; ২. প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী, উন্নত দেশগুলোর প্রতি বছর ১০০  বিলিয়ন ডলার টাকা দেওযার কথা ছিল যা আর আগামীতে নয়, এখনই চায় বাংলাদেশ, আর সেই টাকার ৫০ শতাংশ অভিযোজনে এবং ৫০ শতাংশ প্রশমন কার্যক্রমে ব্যয় করতে হবে; ৩. লস এন্ড ডেমেজের জন্য বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ চায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট এই ক্ষতিপূরণের অর্থ উন্নত দেশগুলোকে তাদের বাজেট থেকে শেয়ার করতে হবে; ৪. বাংলাদেশ সবুজ জ্বালানিতে যেতে চায় যার জন্য অর্থ ও প্রযুক্তি দরকার, বাংলাদেশ চায় উন্নত দেশ এই প্রযুক্তির জন্য টাকা দিবে, যাতে বাংলাদেশ ৪০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি  থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে; ৫. পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে, ভবিষ্যত প্রজম্মকে বাঁচাতে হলে সকল দেশকে মিলে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ উন্নত  দেশগুলোর প্রতি জলবায়ু অভিযোজনের অর্থায়ন দ্বিগুণ করার আহ্বান জানিয়েছে জলবায়ু সম্মেলনের হাই-লেভেল সেগমেন্টে রাষ্ট্রীয় স্টেটমেন্টে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের  নেতা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী। তিনি বলেন চলমান জলবায়ু সম্মেলনকে সফল করতে হলে চলতি বছর থেকেই ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১০০  বিলিয়ন ডলার সরবাহ নিশ্চিত করতে হবে, সেই সঙ্গে জলবায়ু অর্থায়নের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। ২০২৫ সাল পরবর্তী জলবায়ু অর্থায়নের জন্য নিশ্চিত করতে হবে নিউ কালেকটিভ কোয়ানটিফাই গোলের অগ্রগতি।  

সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায় যে অর্থায়নের বিষয়টি এই সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি যা খেকে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//
 


Comment As:

Comment (0)