দারিদ্র্য দূরীকরণে নোবেলজয়ী ত্রয়ী অর্থনীতবিদই এখন বিতর্কিত

মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

ড: মিহির কুমার রায়: বিগত ৫ই জানুয়ারি বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদে ২১তম এবং নতুন বছর ২০২৩ সালের প্রথম অধিবেশনে ভাষণ দেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। রাষ্ট্রপতি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদের ২০২৩ সালের প্রথম অধিবেশনে ভাষণ দেয়ার সুযোগ পাওয়ায় তিনি পরম করুণাময় আল্লাহ’র কাছে শোকরিয়া আদায় করেন এবং স্পীকার, সকল সংসদ সদস্য এবং প্রিয় দেশবাসীকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান। এথানে উল্লেখ্য যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ সময় আগামী এপ্রিলের মাঝামাঝি বিধায় এটিই তার শেষ বিদায়ি ভাষন বলে বিবেচিত। মো. আবদুল হামিদ ১লা জানুয়ারি, ১৯৪৪ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগন্জ মহকুমার হাওর বেষ্ঠিত মিঠামইনে (কামালপুর গ্রাম) জন্ম গ্রহন করেন এবং ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইটনা-মিঠামইন সংসদীয় আসনে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে পাকিস্থান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর তার বাকি রাজনৈতিক জীবনে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মো. আবদুল হামিদ বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কর্তৃক প্রদত্ত ৩০ মিনিটের ভাষনে বর্তমান সময়ের সার্বিক কর্মকান্ড তুলে ধরে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন সমগ্র বিশ্বই পার করছে  এক কঠিন সময় এবং ২০২২ সাল আমাদের জন্য ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং বছর। সরকার করোনা মহামারি সফলভাবে মোকাবিলা করে অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও রাশিযা-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের এ অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করেছে। তারপরও ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ১৪ শতাংশ বেড়ে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২১-২২ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সামগ্রিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতিবাচক। মাথাপিছু জাতীয় আয় পূর্ববর্তী অর্থবছর থেকে ২৩৩ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার আটশ চব্বিশ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০.৯৭ বিলিয়ন ডলার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৩.৪ বিলিয়ন ডলারে।

করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যকর বাস্তবায়নের ফলে দেশের অর্থনীতিতে গতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। সরকার ঘোষিত ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার কৃষি, গার্মেন্টসসহ ২৮টি  প্রণোদনা প্যাকেজের সরাসরি উপকারভোগী প্রায় ৭ কোটি ৩২ লাখ ব্যক্তি ও প্রায় ২ লাখ প্রতিষ্ঠান। সরকার কর্তৃক  কৃষি উৎপাদনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিগত অর্থবছরে মোট ১৫ হাজার ১৭২ দশমিক সাত নয় কোটি টাকা ভর্তুকি এবং ৩৯ হাজার কোটি টাকা সরল সুদে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বিশেষ প্রণোদনার আওতায় কৃষকদের মধ্যে ৫০০ কোটি টাকার বীজ, সার এবং কীটনাশক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। হর্টিকালচার, মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে পর্যাপ্ত ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮৭ হাজারের অধিক সুবিধাভোগীর অনুকূলে স্বল্প সুদে প্রায় ২ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় মাছ ধরা বন্ধকালীন ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২ লাখ ৪৫ হাজারের অধিক জেলে পরিবারকে প্রায় ৯৬ হাজার ৫৫০ মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য ভিজিএফ হিসেবে প্রদান করা হয়েছে, পাশাপাশি ৮ লাখের অধিক মৎস্য চাষি/খামারিকে প্রায় ৯০৩ কোটি টাকা নগদ এবং উৎপাদন উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বস্ত্র ও পাট খাতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ, পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ১ দশমিকএক-তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তৈরি পোশাক খাত থেকে ৪২.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও ঢাকাই মসলিন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সরকার ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’-স্লোগান নিয়ে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির' আওতায় ৫০ লাখ ১০ হাজারের অধিক নিম্ন আয়ের পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি চাল এবং ২৪ টাকা দরে ৫ কেজি আটা বিতরণ করছে। খোলা বাজারে খাদ্য বিক্রয় (ওএমএস) চালু আছে দেশের সব উল্লেখযোগ্য হাট-বাজারে। এছাড়া সরকার টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে সয়াবিন তেল, চিনি ও মসুর ডাল সরবরাহ করছে। এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও একজন দিনমজুরের বেতন দিনে কমপক্ষে ৭০০ টাকা। একই সঙ্গে বেড়েছে জাতীয় উৎপাদন। বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সত্বেও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত রয়েছে এবং বর্তমানে দেশে খাদ্য শস্য মজুতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬.১৪ লাখ মেট্রিক টন, যা সন্তোষজনক। এছাড়াও এবারে দেশব্যাপী আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন জোরদার করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে প্রতি বছর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির বাজেট বৃদ্ধি করা হচ্ছে; যার পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। বর্তমানে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫৭ লাখ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত নারী ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তির উপকারভোগীর সংখ্যা ১ লাখ এবং প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ জন। বিগত অর্থবছরে ভিজিডি চক্রে সারা দেশে ১০ লাখ ৪০ হাজার উপকারভোগীকে প্রতি মাসে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির উপকারভোগী ১২ লাখ ৫৪ হাজার জনকে মাসিক ৮০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়েছে। সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে দেশের সব নাগরিকের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দেশের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে জাতি এগিয়ে যাক ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ার পথে।

২০২১-২২ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক দুই পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সামগ্রিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতিবাচক। মাথাপিছু জাতীয় আয় পূর্ববর্তী অর্থবছর থেকে ২৩৩ মার্কিন ডলার বেড়ে দুই হাজার আটশ চব্বিশ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আগের অর্থবছরেরতুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানিআয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’, এ লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫২৫টি পরিবারের প্রায় ৩৫ লাখ গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসন করা হযেছে। পাশাপাশি জাতির সূর্য সন্তান অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা/বীরাঙ্গনা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধা/প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মুজিব বর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ত্রিশ হাজার বাসস্থান ‘বীর নিবাস’ দেওয়া হচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতি ও  ঐতিহ্যকে বিশ্বে পরিচিতির লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তথ্যপ্রবাহ ও  সৃজনশীলতার ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সরকার আইন, বিধি ও নীতিমালা প্রণয়ন করছে। সরকার কর্তৃক  সংবাদকর্মীদের কল্যাণার্থে সাংবাদিক ও সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১০ কোটি টাকা অনুদান প্রদান করা হয়েছে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ  মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’-এ নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে  কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারকরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রম বাজার সম্প্রসারণে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম এ দেশে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস এবং তাদের সব প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু মহান জাতীয় সংসদ। আপনারা জন প্রতিনিধি, তাই জনস্বার্থকে  সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। দেশের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে জাতি এগিয়ে যাক ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ার পথে। 

রাষ্ট্রপতির  এই বক্তব্য পর্যালোচনায় উঠে আসে দেশ প্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধর প্রতিশ্রদ্ধা ও সরকারের কর্মকান্ডে মানবকলাণের বর্হিপ্রকাশ। সরকারের প্রচেষ্ঠায় দেশ আজ মধ্য আয়ের পথে রয়েছে বিশ্বের কাছে একটি রোল মডেল হয়ে রইল ও আগামিতেও থাকবে। বিভিন্ন সমাবর্তনে চেন্সেলর হিসাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভাষন একটি কিংবদন্তি হয়ে রইল। এই ক্ষনজন্মা মহাপুরুশ যুগে যুগে বাংলাদেশে আসুক এই কামনা রইল।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, সাভার, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)