মিহির

নতুন মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসমূহ

ড: মিহির কুমার রায়: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অভিঘাতে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি, তারল্য সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে লাগাম টানাসহ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খাদ্য সংকটের আশঙ্কা - এসব বহুমুখী চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রেখে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাছাড়াও মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজার ও সুদ হারের নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য, খেলাপি ঋণ কমানো ও সুশাসন নিশ্চিত করার কথাও এ ঘোষনায় রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, রেপো সুদ হার আগের চেয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৬ শতাংশে পুন:নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে রেপো তথা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে  বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নেয়া ধারের বিপরীতে সুদ দিতে হবে ৬ শতাংশ হারে। 

অর্থনীতিবিদগন বলছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে, চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে বেশিরভাগ দেশ সুদ হার বাড়িয়েছে, তবে বাংলাদেশে এখনও ৯ শতাংশ সুদ হারের সীমা অপরিবর্তিত আছে, যে কারণে মুদ্রানীতির কার্যকারিতা অনেকাংশে কমে গেছে, এর মধ্যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় টাকার হাতবদল কমেছে। এ পরিস্থিতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও বাজারে তারল্য বাড়াতে সরকারের ঋণ চাহিদার বেশিরভাগই দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিয়েছে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা, আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণ কমিয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। ফলে প্রথম সরকারের নিট ঋণ বেড়েছে মাত্র ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া সিএমএসএমই, রপ্তানি উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও কারখানা সবুজায়নে ৪৫ হাজার কোটি টাকার চারটি পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাইরে প্রতিদিনই রেপো, বিশেষ তারল্য সহায়তাসহ নানা উপায়ে ব্যাংকগুলোকে প্রচুর ধার দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ৯ শতাংশ সুদ হারের সীমা তুলে দেওয়ার বিষয়ে এখনও কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়নি, অন্যদিকে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমায় গত অক্টোবরের তুলনায় গত নভেম্বরে ব্যাংক খাতের আমানত ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি কমেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের একই মাসের তুলনায় গত ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ, আর গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যেখানে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয় ৫.৬০ শতাংশ পরে সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৫০ শতাংশ, আবার মূল বাজেটে ৭.২০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা  হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে যদিও বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, প্রবৃদ্ধি ৫.২০  শতাংশের মধ্যে থাকবে। রেপোর সুদ হার বাড়ানো হলেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশেই ধরে রেখেছে বাংলাদেশ  ব্যাংক। তবে ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে এ সুদ হার সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতদিন মৌখিকভাবে ভোক্তা ঋণের সুদ হার অতিরিক্ত ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমতি ছিল। ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার পরিবর্তিত না হলেও ব্যাংক  আমানতের সুদ হারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের নির্দেশনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন থেকে ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রাহকদের সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য  সংকট চলছে, বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক নিজেদের নির্ধারিত সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে। এ ব্যাপারে  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য হলো বাজারে অর্থ প্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করেছে, এসব তহবিলের সুদ হার দেড় থেকে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ, কর্তৃপক্ষ মনে করে ব্যাংকগুলো কৃষি, সিএসএমই,  রফতানিমুখী শিল্পসহ উৎপাদনমুখী বিভিন্ন শিল্পের জন্য গঠিত তহবিল থেকে অর্থ নিক যার মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ ও  কর্মসংস্থান বাড়বে, সুদ হার বাড়ানোর কারণে ব্যাংকগুলো রেপো থেকে ধার নেয়ায় নিরুৎসাহিত হবে,  ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাড়ানো হলে দেশের রফতানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এ কারণে এখনই ঋণের সর্বোচ্চ  সুদের ক্যাপ তুলে নেয়া হবে না বিধায় ধীরে ধীরে ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সংকটের চাপের মধ্যেও নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের  প্রথমার্ধে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত এ লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ১  শতাংশ প্রাক্কলন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও দেশে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি এখন ৮ শতাংশের ঘরে। সরকারি  ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনে নেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করা  হয়েছে বলে মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। ইতিহাস সৃষ্টি করা এ আমদানি দায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যকে নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাপক কড়াকড়ি সত্ত্বেও প্রত্যাশা অনুযায়ী আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে  (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২২) আমদানি ব্যয় হয়েছে ৪১.২ বিলিয়ন ডলার, এ হিসেবে আমদানি ব্যয় কমেছে মাত্র ২.২ শতাংশ। অর্থবছর শেষে আমদানি ব্যয় ৮০.২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেটি হলে চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০.৬ শতাংশ, অর্থবছর শেষে এ প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশে নামবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে মুদ্রানীতিতে আভাস দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থবছর শেষে এ ঘাটতি ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে থামবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধারাবাহিকভাবে পতন হচ্ছে। ৮ জানুয়ারি রিজার্ভের গ্রস পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২.৫১ বিলিয়ন ডলার। তবে চলতি অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মুদ্রানীতি বিশ্লেষনে দেখা যায় যে এবার সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অনুসরণ করা হয়েছে, যা কিছুটা সংকোচনমুখী। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। এসব নীতি হারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য প্রবাহ আর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে বাজেটে  ঘোষিত সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপযুক্ত আর্থিক পরিবেশ তৈরি হয়, আবার বাজারে পণ্যমূল্যও সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়। সরকার বাজেটে যে নীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচী ঠিক করে, তা বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক আর্থিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখাই মুদ্রানীতির লক্ষ্য। এমনভাবে এই নীতি সাজানো হয় যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে বছরের পুরো সময়টায় বাজারে অর্থপ্রবাহ ও আঙ্গিক কেমন হবে, তাও মুদ্রানীতিতে ঠিক করে দেয়া হয়। প্রস্তাবিত মুদ্রানীতিতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন এনে খেলাপি ঋণের অংক কমানোর বিষয়টি উল্লেখ হয়নি এবং দীর্ঘ মেয়াদে সবার জন্য এক অংকের সুদ নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল। এ ছাড়াও প্রস্তাবিত মুদ্রানীতিতে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহকে উৎসাহিত করার কোন প্রণোদনা দেখা যায় না। তার অর্থ এই দাড়ায় যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার গতানুগতিক ধারা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না যার জন্য নীতিগত  গবেষণার (Policy research) প্রয়োজন। কারণ কেবলমাত্র নীতি ঘোষনাই যথেষ্ট নয়, তার  সফল বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে তার উৎকর্ষতা। মুদ্রানীতির প্রবাহ চিত্রে (Star flow of monetary polcy) বলা হয়েছে অর্থ সরবরাহ (Money supply) অর্থাৎ ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থ সঠিক সময়ে সঠিক পরিমানে সঠিক  স্থানে পৌছে দেয়া যা সার্বিক উৎপাদন, আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে যার সাথে যুক্ত আছে  সুদের হারে (internal rate), মুদ্রাস্ফীতি (inflation), প্রবৃদ্ধি (growth) ও মুদ্রার বিনিয়োগ হার (Exchange rate)। এইগুলোর বাহিরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এই ধরনের প্রবাহ চিত্রগুলো বাস্তবায়ন (Enforcement) এর অগ্রগতি নিয়ে কোন প্রকার মূল্যায়ন এই মুদ্রানীতির দলিলে পাওয়া যায় না। এরি মধ্যে  বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন আসছে মুদ্রানীতির বাস্তবায়নেও খেলাপি ঋণ বাধা অথচ দেখা যাচ্ছে  বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবাহ আগের তুলনায় বেড়েছে তবে এই ঋণ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা কিংবা এই ঋণের টাকা দেশের  বাহিরে চলে যাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখার বিষয়। তবে এবারকার মুদ্রানীতি সতর্কতা, ঋণের মান ও মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে  রাখার দিকে তবে ঋণের ব্যবহার খাতে উৎপাদনশীল বহুমূখীভাবে দেশের সর্বত্র যেন ছড়িয়ে পড়ে সে ব্যাপারে  কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্কতার নীতি অবলম্বন করছে বলে প্রতীয়মান। তবে মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য যদি হয় অর্থ সরবরাহ তা নিয়ন্ত্রনে  যে হাতিয়ারগুলো (instruments) রয়েছে তার মধ্যে গুনগত হাতিয়ার (qaulitive instruments) যেমন নৈতিকভাবে প্ররোচিত করা, রেশনিং, প্রচারনা, ইত্যাদি কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে তেমন  কোন আলোচনা মুদ্রানীতিতে দেখা যায় না। অথচ গুনগত দিক বিবেচনায় এগুলোর বড়ই প্রয়োজন এবং খেলাপি ঋণের ছোবল  থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করার জন্য মানবিক আচরনে পরিবর্তন জরুরি যদিও বিষয়টি রাজনৈতিক।
 
তবে মুদ্রানীতির শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারী ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে যা বর্তমানে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। শুধু তাই নয় এ খাতে অনৈতিক (Unethical) কাজগুলো সার্বিক অর্জনকে কুলষিত করছে যা অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অর্থ মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত বিরোধী দলীয় এক পার্লামেন্ট সদস্যের প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন ব্যাংকিং খাতে যা ঘটছে তা পুকুর চুরি নয় সাগর চুরি এবং আইন করেও এই খাতের  দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সুশাসনের বিষয়টি আর্থিক খাতে সফলভাবে প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার ব্যাপারে তফসীল ব্যাংকগুলোর আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আনতে নজরদারি  (monitoring) বাড়ানো পূর্বেকার মত অব্যাহত রাখে তবে মুদ্রানীতির বাস্তবায়নের হার অনেকাংশে বাড়বে।  তাছাড়াও এই খাতকে গতিময় করতে শুধু অর্থঋণ আদালতই যথেষ্ট নয় বরংচ বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে মামলাগুলোর  দ্রুত নিস্পত্তি করতে হবে। হিসাব অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন খাতে আনুষ্ঠানিক আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থের  যোগ না হয় তা দেশের জি.ডি.পি. এর প্রায় তিন শতাংশের সমান। সাধারণভাবে তত্ত্ব (theory) বলছে  দুর্নীতি বিনিয়োগের গতি কমিয়ে দেয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (growth) স্থিমিত করে, পণ্য মূল্যকে  প্রভাবিত করে এবং সর্বপরি সুশাসনকে বাধাগ্রস্থ করে। কাজেই এই  সকল সমস্যাগুলো সমাধান করে মুদ্রানীতির বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। তাহলেই দেশের কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণে দ্বৈত পদ্ধতি রয়েছে যেমন সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য অর্থ মন্ত্রনালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং সব বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশী ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় যা সঠিক নয়। আর্থিক খাতের সংস্কার ও তাকে পুনরুজ্জীবিত করা (ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজার) এবং আর্থিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যাংকগুলোর ভূমিকার ক্ষেত্রে আর্থিক বহির্ভূত উদ্যোগ ও অধিক উদ্ভাবনমূলক আর্থিক পণ্য যেমন তহবিল, উপাদান, বিপণনযোগ্য সিকিউরিটিজকে কার্যকর করে তোলার সময় এসেছে ও এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাপনারও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সর্বশেষ অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে কভিড-১৯-এর প্রভাবের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিদ্যমান অসমতা দূর করা উচিত, যা শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেয়ার ফলে তৈরি হয়েছে। তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা, কৃষক এবং প্রান্তিক জনগণের অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বৃদ্ধির জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য,সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)