চলতি মূলধন সংকটে লুব-রেফ, নীতি সহায়তার অনুরোধ
নিজস্ব প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি লুব-রেফ (বাংলাদেশ) ব্যবসায়িক মলূধন ঘাটতিতে পড়েছে। ঘাটতি পূরণে কোনো ব্যাংক থেকেই ঋণ নিতে পারছে না কোম্পানিটি।
ইতোমধ্যে কোম্পানিটির সব স্থায়ী সম্পদ বন্ধক রেখে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নীতিগত সহায়তা চেয়েছে লুব-রেফ।
সম্প্রতি কমিশনের কাছে চিঠি পাঠিয়ে সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে নীতি সহায়তা চেয়েছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, উদ্যোক্তা এবং আইপিওর মাধ্যমে বর্তমানে কোম্পানির ইক্যুইটি শেয়ারের পরিমাণ ১৪৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। কোম্পানির দীর্ঘ এবং স্বল্পমেয়াদী ঋণ আছে যথাক্রমে ৫২ কোটি ৯৭ লাখ এবং ৭৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। এই দায় পরিশোধ করতে কোম্পানির কমপক্ষে ১৪০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক মূলধন প্রয়োজন, যেখানে কোম্পানির এখন অর্থায়ন এবং অর্থায়ন ছাড়া উভয়ভাবেই ৭০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক মূলধন আছে। যা ২০২২ সালের বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০২৩ সালের বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে, কাঁচামাল বাবদ ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না।
করোনা মহামারি চলাকালে কোম্পানির মোটরগাড়ি খাতের বাজার চাহিদা বন্ধ হয়েছিল। সে সময় শিল্প খাতের কার্যক্রমও খুব খারাপ অবস্থায় ছিল। ফলে, কোম্পানির ব্যবসায়িক মূলধনের অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে সে সময় সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোম্পানিকে অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মূলধন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কোম্পানিটি শুধু ১০ কোটি টাকার মধ্যে থাকা ঋণের সুদের হারে ছাড় দিয়েছে। ফলে, কোম্পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে, কোম্পানি যখন মহামারি-পরবর্তী সময়ে পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করছে, তখন ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পুরো পেট্রোলিয়াম খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে, যুদ্ধের আগের পরিস্থিতির তুলনায় কাঁচামালের দাম দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে গেছে। একই সময়ে মালামালের দামও বেড়েছে বহুগুণ। তাই, কোম্পানির ব্যবসায়িক মূলধন এক-তৃতীয়াংশে হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, এখন উৎপাদন চলমান রাখার জন্য কোম্পানির ব্যবসায়িক মূলধনের সীমা অবিলম্বে বৃদ্ধি করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অতিরিক্ত জামানত ছাড়া অর্থ দেবে না বলে জানিয়েছে। কোম্পানি জামানত দিতে অক্ষম। কারণ, তারা ইতোমধ্যেই কোম্পানির সব স্থায়ী সম্পদ ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখেছে। এছাড়া, আইপিওর ৩৭ কোটি টাকা ২০২২ সালের ২৩ জুন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড থেকে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডে ট্রান্সফার করা হয়। এর পর ব্যাংকটি কোম্পানির নতুন প্রস্তাবের প্রতি কঠোর হয়েছে বলে জানানো হয়।
সমস্ত অসুবিধার পরেও কোম্পানি ২০২১ সালের সমাপ্ত বছরে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে উল্লেখ করে কোম্পানির এমডি জানান, কোম্পানি আশা করছে, এই বছর এবং পরের বছরেও একই রকম লভ্যাংশ দেবে, যদি কোম্পানি প্রকল্পগুলো ঠিকঠাকভাবে চালাতে পারে। এদিকে, আইপিও অর্থ থেকে ব্যাংকের কিছুটা দায় পরিশোধের পরে নতুন প্রকল্পের সাইট উন্নয়নে কোম্পানির কাছে প্রাথমিকগণ প্রস্তাবের (আইপিও) অর্থের ২০ কোটি এবং ৩৭ কোটি টাকা যথাক্রমে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং অগ্রণী ব্যাংকে আছে। উল্লিখিত আইপও অর্থ এলসি মার্জিনের জন্য একটি বিশেষ অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে, যা বিএমআরই প্রকল্পের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানির বিপরীতে খুবই নামমাত্র টাকা। উল্লিখিত ব্যাংক দুটি প্রতিশ্রুত সিন্ডিকেট ঋণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং দুই বছরের জন্য কোম্পানির ঋণ প্রস্তাব বাতিল করেছে।
এদিকে, কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বে বর্তমান অস্থিতিশীলতার কারণে অর্থনীতির মন্দার প্রভাব কোম্পানি ওপর পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, অগ্রণী ব্যাংকে প্রস্তাবিত একটি সিন্ডিকেটেড ঋণ প্রক্রিয়াধীন আছে। তারপরও কোম্পানির বিএমআরই প্রকল্প শেষ হতে দেরি হবে। এই সময়ের মধ্যে অবশ্যই শুধু কোম্পানিকেই নয়, কর্মচারী এবং তাদের পরিবারকেও রক্ষা করতে হবে এবং অনেক শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ বজায় রাখতে হবে। তাই, এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কোম্পানিটির বিএসইসির নীতিগত সহায়তা চেয়েছে।
জানতে চাইলে লুব-রেফের (বাংলাদেশ) প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মোহাম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কোনো সহয়োগিতা নেই। প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই এলসি বন্ধ করে দিয়েছে। তবে, এখন আবার কিছু কিছু এলসি খোলা হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ মার্জিনে। আগে যেটা করা হতো ৫ থেকে ১০ শতাংশ মার্জিনে। তাও ব্যাংক সুযোগ বুঝে করে এবং তাদেরকে আবার ২০০ শতাংশও মার্জিন দিতে হয়। এখন শতাংশের হার বৃদ্ধি পাওয়ার পরও আমাদেরকে টার্গেট পূরণ করতে হচ্ছে। না হলে আমরা আবার বকেয়ায় পরে যাব বা খেলাপি হয়ে যাব। যে কারণে আমাদের ব্যবসায়িক মূলধন কমে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যে প্রকল্প করার কথা ছিল, সেখানে ব্যাংক আর বড় আকারে যেতে চাইছে না। তাই, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছোট আকারে সেটা করব। আর এদিকে, প্রকল্পের জন্য নেয়া আইপিও অর্থের একটা অংশ আছে, যেটাকে স্বল্প সময়ের জন্য ব্যবসায়িক মূলধন হিসেবে ব্যবহার করতে পারি কি না, সে বিষয়ে নীতি সহায়তা চেয়েছি।
প্রসঙ্গত, কোম্পানিটি ২০২১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ২৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১৪৫ কোটি ২৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৭০ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের, ২২ দশমিক ২০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে।
বিনিয়োগবার্তা/এমআর/এসএএম//