কোরবানির পশুর বাজার ব্যবস্থাপনা ও ঈদের অর্থনীতি

পরিবর্তনের হাওয়ায় গাসিক নির্বাচন কি বার্তা দিয়ে গেল

ড: মিহির কুমার রায়: গাজীপুরে প্রমাণ হলো গনতান্ত্রিক সরকারের অধিনে থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। ফলাফলে দেখা যায় গাজীপুর সিটি করপোরেশন (গাসিক) নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবেই জিতে গেলেন টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে লড়া মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকার প্রতি জনসমর্থনের দিক থেকে গাজীপুরকে বলা হয় দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ। কিন্তু রাজনীতির ত্রিসীমানায় না থাকা একজন গৃহবধূ জায়েদা খাতুন তা ভুল প্রমাণ করলেন। ঘোষিত ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, তিনি পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। অর্থাৎ নৌকার প্রার্থী টেবিল ঘড়ির প্রার্থীর কাছে ১৬ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরেছেন। জায়েদা খাতুনের বিজয়কে অপ্রত্যাশিত বলার সময় আমার স্মরণে আছে, তাঁর হয়ে প্রকৃতপক্ষে মাঠে লড়াই করেছেন তাঁরই পুত্র – আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত গাজীপুর সিটির সাবেক মেযর জাহাঙ্গীর আলম। গাজীপুরের বিশেষত তরুণ ও শ্রমজীবী ভোটারদের মধ্যে জাহাঙ্গীরের একটা শক্ত সমর্থক গোষ্ঠী আছে এবং এবারের ভোটের ফল নির্ধারণে তাদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বয়স তেমন বেশি না হলেও জাহাঙ্গীর গাজীপুর মহানগর ঘোষিত হওয়ার আগে থেকেই সেখানকার আওয়ামী লীগে নিজস্ব একটা বলয় তৈরি করতে সক্ষম হন। যার ওপর ভর করে ২০১৩ সালের প্রথম গাসিক নির্বাচনে তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করেই তৎকালীন দলীয় মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। বলা হয়ে থাকে, সে নির্বাচনে পোড়খাওয়া ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা হওয়া সত্ত্বেও আজমত উল্লা যে বিএনপি প্রার্থী আবদুল মান্নানের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান, তার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর পক্ষে জাহাঙ্গীরের কাজ না করা। সম্ভবত ভোটের মাঠে জাহাঙ্গীরের এই গুরুত্ব অনুধাবন করেই দলীয় হাইকমান্ড ২০১৮ সালের গাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে তাঁকে বেছে নেয় এবং তিনিও বেশ ভালো মার্জিনে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র হন। 

নির্বাচনের ফল বের হওয়ার পর টেবিল ঘড়ির বিজয়কে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক, তিনি যে জয়ী হতে পারেন – এ কথা কিন্তু কেউই জোর গলায় অন্তত নির্বাচনের আগের দিনও বলতে পারেননি। এটাও মনে রাখা দরকার, টেবিল ঘড়ির লোকেরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেননি; একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন; এমনকি নির্বাচনের দিনও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে বেশিরভাগ কেন্দ্রে এ প্রতীকের কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি। এদিক থেকে জায়েদা খাতুনের বিজয়কে নীরব বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। টেবিল ঘড়ির বিজয়ের কারণ যাই হোক, গাসিক নির্বাচনে ভোটাররা যে তাঁদের মনের ভাব স্পষ্ট করে বলতে পেরেছেন – এ কথা এখন বলাই যায়। দিনভর যাঁরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁরাও বলেছেন, কোথাও কোনো অনিয়ম তাঁদের চোখে পড়েনি। কোনো প্রার্থীও উল্লেখযোগ্য কোনো অনিয়মের অভিযোগ তোলেননি। অথচ কয়েক বছর আগেও এ চিত্র দেখা যায়নি। তা হলে এ জায়েদা খাতুন কে এ নিয়ে নানানজনের মনে কৌতুহল দেখা যায়। জায়েদা খাতুন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা, একই সঙ্গে তিনি গাজীপুর সিটির নির্বাচিত প্রথম নারী মেয়র ও দেশের দ্বিতীয় নারী মেয়র। জানা যায়, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে হারিয়ে গাজীপুর সিটির তৃতীয় মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী জায়েদা। জায়েদা খাতুনের ছেলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন এ নগরীর দ্বিতীয় মেয়র। স্থানীয়রা বলছেন, এলাকায় জনদরদি হিসেবে পরিচিত জায়েদা খাতুন, শিক্ষার্থীসহ গরিব-দুঃখী মানুষকে বরাবরই আর্থিক সহায়তা করেন, একই সঙ্গে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানেও সহায়তা করেন তিনি। সেই সুবাদে অধিকাংশ নারী ভোট কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন। গাজীপুর সিটির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের হাতিমারা স্কুল অ্যান্ড কলেজে পুরুষ কেন্দ্রে নৌকা ১ হাজার ৪০ ভোট পেয়েছে, ঘড়ি পেয়েছে ১ হাজার ৩ ভোট। নারীদের দুই কেন্দ্রেই জয়ী জায়েদা। করোনাকালে তার ছেলের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া শ্রমিকরা বাস করেন, এমন এলাকায়ও একচেটিয়া ভোট পেয়েছে ঘড়ি। টঙ্গীর এরশাদ নগরে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের বাস, এই এলাকার ১০টি ভোটকেন্দ্রের ৮টিতে জয় পেয়েছে ঘড়ি, বাকি দুটির একটিতে ১৪ ভোটে এবং আরেকটি ৩০ ভোটের স্বল্প ব্যবধানে জয় পায় নৌকা।

নির্বাচনের ফল বের হওয়ার পর টেবিল ঘড়ির বিজয়কে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক, তিনি যে জয়ী হতে পারেন– এ কথা কিন্তু কেউই জোর গলায় অন্তত নির্বাচনের আগের দিনও বলতে পারেননি। এটাও মনে রাখা দরকার, টেবিল ঘড়ির লোকেরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেননি; একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন; এমনকি নির্বাচনের দিনও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে বেশিরভাগ কেন্দ্রে এ প্রতীকের কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি। এদিক থেকে জায়েদা খাতুনের বিজয়কে নীরব বিপ্ল¬বের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। জায়েদা খাতুনের বর্তমান বয়স ৬১, পেশায় একজন গৃহীনি, ছেলের হাত ধরেই এ্খন গাজীপুরের নগর পিতা যা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না, আসলে জয় হয়েছে জাহাঙ্গীরেরই যা বুঝতে কারো বাকি নেই। এঁই হলো রাজনীতির খেলা। বিএনপি নির্বাচন করলে অনায়াসেই জিতে যেত, কারন আওয়ামীলিগ দ্বিধা বিভক্ত, ভোট আজমত ও জাহাঙ্গীরের মধ্যে ভাগাভাগি হলে বিএনপিকে কে ঠেকলায়।

টেবিল ঘড়ির বিজয়ের কারণ যাই হোক, গাসিক নির্বাচনে ভোটাররা যে তাঁদের মনের ভাব স্পষ্ট করে বলতে পেরেছেন– এ কথা এখন বলাই যায়। দিনভর যাঁরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁরাও বলেছেন, কোথাও কোনো অনিয়ম তাঁদের চোখে পড়েনি। কোনো প্রার্থীও উল্লেখযোগ্য কোনো অনিয়মের অভিযোগ তোলেননি। অথচ কয়েক বছর ধরে স্থানীয় তো বটেই, জাতীয় নির্বাচনেও সহিংসতা প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল, জাল ভোট শুধু নয়; বহু ধরনের জালিয়াতি এসব নির্বাচনের সাধারণ দৃশ্য হয়ে পড়েছিল। এদিক থেকে গাসিক নির্বাচনে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা গেল। এ দৃশ্য যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আন্তরিক প্রয়াসেরই ফল, তা না বললেই নয়। নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করেনি– এ কথা বলাই যায়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আপাত দুর্বল প্রার্থীও যে সবল হয়ে ওঠে– এ নির্বাচনে তা দেখা গেল এবং এর কৃতিত্বও নির্বাচন কমিশনেরই প্রাপ্য। আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে শাসক দলের মেয়র প্রার্থীকে ঢাকায় ডেকে এনে সতর্ক করা এবং একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা ভোটের পরিবেশ সম্পর্কে ভোটারদের একভাবে আশ্বস্ত করেছে। ভোটের দিনে সব কয়টি কেন্দ্র কড়া নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসে তারা। ঢাকায় বসে তা মনিটর করার জন্য সব কেন্দ্রে গোপন ক্যামেরা লাগানো হয়। শুধু তাই নয়; গোপন ক্যামেরায় অনিয়ম ধরা পড়ায় দু’জন কাউন্সিলর প্রার্থীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দও করা হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি জাহাঙ্গীর আনুগত্যের কথা হয়েছে বারবার। তাঁর মা মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরও একই কথা বলেছেন। এই কৌশলের কারণে আওয়ামী লীগবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হননি তিনি। তাই দলটির কর্মী-সমর্থকদের ভোট পেয়েছেন তাঁর মা। দলটির স্থানীয় নেতাদের অনেকেই ছিলেন জাহাঙ্গীরের পক্ষে, নৌকার ব্যাজ পরলেও গোপনে অনেকে কাজ করেছেন ঘড়ির পক্ষে, আওয়ামী লীগের গাজীপুর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যরাই এ কথা বলেছেন। তারপর গাজীপুরের নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন তার ছেলে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের অভিপ্রায় ব্যাক্ত করেছেন। এখন দেখা যাক সময়ই বলে দেবে বিষয়টি কি দাড়ায়। তবে অনেক দিন পর  গাজীপুরে সেই ভোটখরা কালের অবসান ঘটল। ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৩ জন ভোটারের মধ্যে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৫০ জন ভোট দিয়েছেন, তার মানে ৪৮.৭৫ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে গেছেন, দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুরের ৪৮০টি কেন্দ্রে ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিই ছিল গাজীপুর নির্বাচনের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে বলেই ভোটাররা কেন্দ্রে ছুটে এসেছেন। তার মানে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আমরা যতই ধ্বংস করি, ভোট দেয়ার আকাঙ্খা মানুষের ফুরিয়ে যায়নি। সুযোগ পেলেই তারা তাদের প্রতিনিধি বেছে নিতে ভুল করবে না। তবে গাজীপুরের প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি নির্বাচনকে যে মানে উন্নীত করেছে, তা ‘সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব’ এই ধারণা ছড়িয়ে দিতে হলে গাজীপুরের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে সর্বত্র। আমার ধারণা, এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও লাভ হবে না। এ ক্ষেত্রে প্রার্থী ও দলকে দায়িত্ব নিতে হবে, ভোটারদের কেন্দ্রে আসার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে হবে, ভোটারদের কেন্দ্রে আসার অভ্যাস গড়ে উঠলে নির্বাচনী ব্যবস্থার যে অধঃপতন তা অনেকটাই রোধ করা যাবে।  এবং গনতন্ত্র আবার ফিরে আসবো এই বাংলায়।

লেখক: অধ্যাপক, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)