আরিফুল ইসলাম

আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের সংকট ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ 

আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: একবিংশ শতাব্দীতে, ক্রমবর্ধমান বিশ্ব অর্থনীতির সম্প্রসারণ এবং চীনের উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বিধায়, ভারত মহাসাগর অঞ্চলে একটি (ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয়) জোট গঠনের তাগিদ অনুভব করে মার্কিন মুল্লুক। ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব প্রসারিত এবং সুসংহত করার ধ্যান ধারনা হতে যুক্তরাষ্ট ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর নিয়ে গঠিত ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল গঠনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ওবামা সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে আলাদাভাবে অভিনিবিষ্ট হতে শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ঘোষণা আসে ‘Rebalancing to Asia’ নামে একটি প্রকল্প। ওবামা সরকারের পরবর্তী ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর কিছু সংস্কার করে প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয় ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। মাঝে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়েছে কোয়াড, আনজুস, অকাস নামীয় বেশ কয়েকটি সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির ঘোষিত প্রধান লক্ষ্য নির্ধারন করা হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটিকে অবাধ ও মুক্ত, সংযুক্ত, সমৃদ্ধ, সুরক্ষিত এবং স্থিতিস্থাপক করে তোলা। তাই ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর নিয়ে গঠিত ইন্দো-প্যাসেফিক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পূর্বের ধারাবাহিকতায় বাইডেন ক্ষমতায় এসে গত ফেব্রুয়ারিতে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ২০২২ প্রকাশ করেন।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, চীনকে ঠেকানো, দ্বিতীয়ত, এ অঞ্চলে তাদের বাণিজ্য এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, এ সুবিশাল অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর মিত্রদের দিয়ে তাদের আধিপাত্য বিস্তার করা। দক্ষিণ চীন সাগরের তীর ঘেঁষে রয়েছে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, ফিলিপিন, ইন্দোনেশিয়া ও তাইওয়ান। ভারত মহাসাগরের উত্তরে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণে অ্যান্টার্কটিকা, পূর্বে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা দ্বীপ ও অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে আরব উপদ্বীপ ও আফ্রিকা। মহাসাগরটির সীমান্ত জুড়ে রয়েছে এশিয়ার ১২টি এবং আফ্রিকার ১৫টি দেশ। দেশগুলোর অধিকাংশই বিশ্ব রাজনীতিতে অধিকতর প্রাসঙ্গিক এবং এদের মধ্যকার সর্ম্পক প্রতিনিয়ত বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করে চলছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি সাগর ও মহাসাগর:-আরব সাগর, লোহিত সাগর, বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর ভারত মহাসাগর কেন্দ্রিক অঞ্চলে অবস্থিত।

জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী, বেসলাইন থেকে টেরিটোরিয়াল সমুদ্র ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ। টেরিটোরিয়াল সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলোর এখতিয়ার এবং নিয়ন্ত্রণাধীনে খাকে। এই অধিকারগুলি কেবল দৃশ্যমান পৃথিবীর পৃষ্ঠ নয় বরং সমুদ্রের তল,  ভূপৃষ্ঠ এবং এমনকি বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত প্রসারিত। এছাড়াও ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অঞ্চলকে বলা হয়  ‘এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন’ (ইইজেড)। এই অঞ্চলে যে কোনো দেশ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ,  জলজ প্রাণী বা মৎস্য আহরণ ইত্যাদি স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণায় এই অঞ্চলের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের তথ্য রয়েছে বলে মনে করা হয়। তাদের তথ্যমতে ১১ বিলিয়ন গ্যালন তেল ও ১৯০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ থাকতে পারে। তবে চীনের গবেষণা অনুযায়ী এই অঞ্চলে প্রায় ১২৫ বিলিয়ন গ্যালন তেল ও ৫০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এত এত সম্পদের এরিয়ায় বর্তমান  পরাশক্তি এবং এর মিত্ররা  নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করবে না তা চিন্তার অতীত। চীন যেহেতু এই অঞ্চল ঘিরে এবং এই অঞ্চলের উপর নিজের একটা আধিপত্য বিস্তার করতে চায়,  সেক্ষেত্রে ভারত সহ অন্যন্য প্রতিদ্বন্ধীরা তা ঠেকাতে বিকল্প ব্যবস্থায় আগাবে তা সহজেই অনুমেয়। মূলতঃ হচ্ছে ব্যবসা এবং বাণিজ্য। ব্যবসা বাণিজ্যে একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করার যাবতীয় টেকনিকই হলো  বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট এবং উপজোট। এখানে থাকে ট্যারিফ-ননট্যারিফ এবং মোড়লদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়াদি। এখন এই জোট উপজোটে যে  যত বেশী স্টেইকহোল্ডারকে যুক্ত করতে পারবে সে ততবেশী সুবিধা নিতে পারবে এবং শক্তিশালী হবে বা হচ্ছে। জোট গঠনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক বাণিজ্যের পরিমান,  আঞ্চলিক গুরুত্ব, ভৌগলিক অবস্থান এবং ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখে। যেমন চীন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বাণিজ্যিক সহযোগী, যুক্তরাষ্ট্রের বহুবিধ শিল্প কাঁচামালের জন্য চীনের উপর নির্ভরশীল এবং উৎপাদন শিল্পের প্রাথমিক আর মাধ্যমিক পর্যায়ের পণ্যের জন্যও যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর নির্ভর করে থাকে। পাশাপাশি, চীনের খ্রিস্টান মিশনারিজগুলোর সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক ও ধর্মীয় অঙ্গনের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বিপুল চীনা অভিবাসী। বিশ্বায়নের এই যুগে এক রাষ্ট্র যেমন আরেক রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল, যুক্তরাষ্ট্রেরও বহুমাত্রিক নির্ভরতা আছে চীনের উপর। এই নির্ভরতাগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা। বাস্তবতা ভূগোল আর কূটনৈতিক নিয়ামকগুলোর জন্যও। ফলে, যেখানে সম্ভব যুক্তরাষ্ট্র সেখানে চীনের সাথে সহযোগিতা করবে, চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখবে। অন্যদিকে বর্তমান ভৌগলিক ও আর্ন্তজাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় ভারত ও যুক্তরাষ্টের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ শতক যেমন ছিল আমেরিকার তেমনি একুশ শতক নিজেদের করে নিতে চায় চীন। সে লক্ষ্যে চীনের উদ্যেগে গঠিত হচ্ছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, সংক্ষেপে বিআরআই। একুশ শতাব্দী চীনা শতাব্দী হবে কিনা, তা নির্ভর করছে চীনের মাধ্যমে এই বৈশ্বিক বাণিজ্য অবকাঠামো নির্মাণে সফলতার ওপর। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এক হয়েছে চীন ঘোষিত এই প্রকল্পে। বিষয়গুলো হলোঃ সর্বোচ্চ সংখ্যক দেশ, বৃহৎ অর্থায়ন ও বড় জনসমষ্টি। বলা হচ্ছে, এটিই হতে যাচ্ছে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রকল্প। ৬৮টি দেশ, ৬০ শতাংশ বিশ্ব জনসংখ্যা এবং ৪০ শতাংশ উৎপাদন নিয়ে এই নয়া রেশম পথ রচনা করছে এশীয় আদলের নতুন বিশ্বায়ন। অন্যদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত ইউরোপকে পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্র এর ‘মার্শাল প্ল্যান’ তাদের এনে দিয়েছিল পৃথিবীর শীর্ষ শক্তির স্বীকৃতি। সে সুবাদেই আমেরিকা গর্ব করে বলে বিশ শতক হলো আমেরিকান শতক। কিন্তু মার্শাল প্ল্যান ছিল কেবল ইউরোপের বিষয়, আর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, ইউরোপ ও আফ্রিকাকে ধারণ করলেও এর আওতায় আসবে সারা পৃথিবীর বাণিজ্য। এই প্রকল্পের তাত্বিক দিক এবং ভবিষ্যতের বাণিজ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে চীন ঘোষিত বিআরআইতে স্বাক্ষর করেছে।

ফলে এখন গুরুত্বর্পূণ হয়ে উঠেছে কোন জোট বা কারা মূলতঃ শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারবে এই অঞ্চলে; বিআরআই না আইপিএস। চীন শক্তিশালী হলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতের মাথা ব্যাথার কারন হতে পারে। কারন তখন চীন সামরিক এবং বাণিজ্যিকভাবে  মোড়লীপনা করবে এই অঞ্চলে, যা আসলে উল্লেখিত রাষ্ট সমূহ সম্পূর্ণরূপে বিরোধিতা করবে; এটাই স্বাভাবিক। ফলে বিরোধী রাষ্টসমূহ মূলতঃ সংঘবদ্ধ হবে যুক্তরাষ্টের নিয়ন্ত্রনাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে। যেখানে মূলতঃ নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যই প্রধানতম এজেন্ডা হবে। ইন্দো-প্যাসিফিকে আমেরিকার যেমন প্রবল আগ্রহ আছে,  তেমনি ভারত-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশেরই আছে নিজস্ব স্বার্থ।
 
‘‘আর এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েই এখানকার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে অভিন্ন নিরাপত্তা কৌশল তৈরি করতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র’’  বলে মনে করেন অনেক আর্ন্তজাতিক বিষয়ক গবেষকগণ। বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরই নামের যে মহা-পরিকল্পনা নিয়ে চীন বিভিন্ন দেশে প্রভাব বিস্তার করছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি হচ্ছে মূলত তার পাল্টা পরিকল্পনা,  এটি চীনকে প্রতিরোধের একটি কৌশল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান ও কৌশলগত ভূমিকাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত কেন এই পরিকল্পনার অংশ তার তিনটি কারণ এখানে উল্লেখ করা যায়, প্রথমত,  ভারত আঞ্চলিক নিরাপত্তা  ইস্যুগুলোতে আরো প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে চায়। আগেকার এশিয়া-প্যাসিফিক সহযোগিতার মূল বিষয়  ছিল অর্থনীতি; এতে ভারতের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। দ্বিতীয়ত, ভারত চায় দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব হ্রাস করতে। তৃতীয়ত, মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে অংশগ্রহণের ফলে ভারতের পক্ষে এশিয়া-প্যাসিফিকে আরো ভালোভাবে একীভূত হতে সহায়ক হবে। আঞ্চলিক ভূমিকা বিশ্ব কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় নয়া দিল্লি দর্শকের ভূমিকায় থাকতে চায় না। ভারতের মনে করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগ,  ফলে এই অঞ্চলে একীভূত হওয়া নয়াদিল্লির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ইস্যু। অবশ্য নয়াদিল্লিও ওয়াশিংটনের মধ্যে কিছুটা মত পার্থক্যও বিদ্যমান রয়েছে, যা ভারতীয় বিভিন্ন কূটনৈতিক ব্যক্তি এবং অর্থনীতিবিদের লেখনীতে অনুমেয়। ভারত কিন্তু জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো মার্কিন মিত্র নয়। একারণে ভারত মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির বিষয়ে কিছুটা কৌশলী অবস্থানে আছে। তবে চীনের উত্থান ও চীন-প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে হুমকি মনে করে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি উন্নয়ন কেন্দ্রিক কিন্তু আক্রমণাত্মক নয়। ফলে ভারত সব সময়  নিরাপত্তা ও বাণিজ্য বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাটিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে বলে মনে করা হয়। মধ্য শক্তি হিসেবে অস্ট্রেলিয়া নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্টের দিকে ঝুঁকে রয়েছে।

স্বাধীনতার পর হতে গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোটামুটি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে আসছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই প্রথম বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থানে আছে,  যেখানে ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, অস্বস্তিকর একটি দ্বন্ধে তাদের জড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এই দ্বন্ধের মূলেই আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলোর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি। বাংলাদেশ চীন ঘোষিত বিআরআইতে আগ্রহ থাকায় চীন ঘনিষ্ট মনে করে ভারতেরও এই বিষয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে  কিছুটা অস্বত্বি আছে বলে মনে করা হয়। আবার চীন বাংলাদেশকে কোয়াডের সদস্য হওয়ার বিষয়ে সর্তকবানী দিয়েছে। কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন,  “এই কোয়াড গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সদস্য দেশগুলো বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশকে তাদের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়াবার আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ চীনের দিক থেকে এ নিয়ে সতর্ক বাণী পেয়ে আসছে। কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি চীন এবং চীন বিরোধী জোটের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে,  এরই মধ্যে বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশকে দেশের ভেতরের এবং বাইরের নানা চাপ মোকাবেলা করে এখানে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে। কাজটি বেশ কঠিন।” 

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষনা করেছে। যাতে রয়েছে;  বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিকে তার ‘ভিশন ২০৪১’ বাস্তবায়ন তথা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি আধুনিক, জ্ঞান-ভিত্তিক,  উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বৈশ্বিক জিডিপিতে সামষ্টিক অংশ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অগ্রগণ্য অবস্থান,  জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সামগ্রিক কার্যক্রম এবং প্রযুক্তি খাতে গতিশীল বিকাশ বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থনীতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত কল্পে একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশ তাই এই অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট সবার সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি অবাধ,  উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিকের ধারণা বাস্তবায়নের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।

বাংলাদেশে ঘোষিত মৌলিক নীতিমালার মধ্যে রয়েছে; 
ক. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূল মন্ত্র ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’। খ. বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল নীতিসমূহ, যথা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা,  আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য অবিরাম প্রয়াস অব্যাহত রাখা।
গ. সমুদ্র আইন সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ বা আনক্লস, ১৯৮২-সহ প্রযোজ্য জাতিসংঘ চুক্তিসমূহ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন সমূহ মেনে চলা।
ঘ. টেকসই উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা,  মানবিক কার্যক্রম এবং মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে গঠনমূলক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা। মৌলিক নীতি মালার আলোকে বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখায় ১৫টি অভিলক্ষ প্রণয়ন করেছে।

যখন কোনো অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রকে ঘিরে বৃহৎ রাষ্টসমূহের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়,  তখন সেটি একই সঙ্গে দেশটির জন্য আশীর্বাদও হতে পারে আবার অভিশাপ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। এই প্রতিযোগিতার সুযোগে দর কষাকষি করে নিজের স্বার্থ আদায়ের সুযোগ যেমন থাকে,  তেমনি বৃহৎ শক্তির টানা-হেঁচড়ার মাঝখানে পড়ে অনেক রাষ্ট্রে সংঘাত এবং বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার সম্ভাবনাও থাকে। ফলাফল নির্ভর করে একটি দেশের বিচক্ষণ কূটনীতি,  বুদ্ধিদৃপ্ত এবং সময়পযোগী সিদ্ধান্ত, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সর্বপরি জাতীয় নেতৃত্বের স্বদেশ প্রেমের উপর। চীন ঘোষিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ,  সংক্ষেপে বিআরআই এই শতকের সর্ববৃহৎ প্রকল্প যা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বানিজ্যিকভাবে প্রভুত লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক বিআরআই নিয়ে ১৫৯ পৃষ্ঠার একটি রির্পোট প্রকাশ করেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে  ‘‘বিআরআই প্রকল্প কারণে পরিবহন বাণিজ্য সম্প্রসারণ বৃদ্ধি পাবে, বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে পারে এবং বাণিজ্য খরচ কমিয়ে দারিদ্র্য হ্রাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবুও,  কিছু দেশের জন্য, নতুন অবকাঠামো ব্যয় লাভের চেয়ে বেশি হতে পারে (বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ১৭)।’’ 

চীন বাংলাদেশের বৃহৎ উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক অংশীদার। আমাদের আমদানীর প্রায় ২৬%  চীনের সাথে সংগঠিত হয়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট আমাদের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক/অর্থনীতির জন্য এক গুরু্ত্বপূর্ণ  অংশীদার। বাংলাদেশের তৈরি পোষাক সহ রপ্তানী খাতে বৃহৎ পার্টনার হলো যুক্তরাষ্ট্র। রোহিংঙ্গা ইস্যূসহ নানাবিধ সমসাময়িক আর্ন্তজাতিক এবং আভ্যন্তরীন সমস্যা সমাধানের জন্য উভয় যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা আমাদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন। এছাড়া হাল সময়ে চীন গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিসিয়েটিভ  নামে নতুন একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম গঠনের চেষ্টায় রয়েছে।  ফোরামে বাংলাদেশকে অন্তর্ভূক্ত রেখে কার্যক্রম চালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে চীন। ফোরামের একটি খসড়া রুপরেখাও বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্য কেন্দ্রিক আলোচনায় বঙ্গোপসাগরের পরিচিতি ছিল  ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্যাক ওয়াটার’ (নিস্তরঙ্গ আন্তর্জাতিক জলরাশি)  হিসেবে। তবে সে নিস্তরঙ্গতা কাটিয়ে বঙ্গোপসাগর এখন হয়ে উঠেছে বিশ্ববাণিজ্যের সবচেয়ে সক্রিয় জলপথগুলোর একটি। বিআরআই এবং আইপিএস দুইটি জোটই আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে বাংলাদেশ এখানে একটা ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে।  এই পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থ রক্ষা করে এবং একইসাথে সকল পক্ষের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা বাংলাদেশের সামনে বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং দূরদৃষ্টি সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে; তবে এটি হবে আমাদের ভবিষ্যৎ ভূ-অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনীতির জন্য একটি বিশাল অর্জন।

লেখক: উপ-পরিচালক, বেপজা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)