সেনজেন ভিসা আবেদনে কেন উল্টোরথে ভিএফএস গ্লোবাল বাংলাদেশ: করণীয় কী?
মোহাম্মদ আতিকুর রহমান:
নিম্নলিখিত আর্টিকেলটি পড়ার আগে চলুন জেনে নেই ভিএফএস গ্লোবাল কি এবং তারা কী করে?
ভিএফএস গ্লোবাল পূর্বে 'ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সার্ভিসেস গ্লোবাল' নামে পরিচিত, একটি কোম্পানি যা এই পদ্ধতিতে সহায়তা করে ভিসার জন্য অনুরোধ করে এবং সারাবিশ্বের সরকার এবং কূটনৈতিক মিশনের জন্য পাসপোর্ট সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। কোম্পানিটি ২০০১ সালে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জুবিন কারকারিয়ার হাতে প্রতিষ্ঠিত সুইস ভ্রমণ সংস্থা কুওনির মধ্যে একটি প্রকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৬ সালে কুওনি স্টকহোমে অবস্থিত একটি বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ সংস্থা ইকিউটি অংশীদার দ্বারা কেনা হয়েছিল। সেই সময়ে কুওনির তিনটি ব্যবসায়িক ইউনিট ছিল, যার মধ্যে ভিএফএস গ্লোবাল ছিল, যেটি বিশ্বব্যাপি সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে।
ভিএফএস গ্লোবাল বিশ্বব্যাপী ৬৭টি দেশের জন্য কাজ করে এবং এসব দেশে সংস্থাটির ১৪৭টি আবেদন কেন্দ্র এবং অফিস রয়েছে। ২০০১ সাল থেকে তারা ২৫৭ মিলিয়নেরও বেশি অ্যাপ্লিকেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। ভিএফএস গ্লোবালের সদর দফতর দুবাই, (সংযুক্ত আরব আমিরাত) এবং এটি মূলত একটি সুইস কোম্পানি (EQT এর অংশ, স্টকহোমে সদর দফতর একটি প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্ম)। ভিএফএস গ্লোবালের বেশিরভাগ শেয়ারের মালিকানা বিনিয়োগ সংস্থা ব্ল্যাকস্টোনের।
ভিএফএস গ্লোবাল আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, পূর্ব ইউরোপ এবং ভারতে ডাচ সরকারের জন্য একটি বহিরাগত পরিষেবা প্রদানকারী হিসাবে কাজ করে। এছাড়া শেনজেন ভিসা পরিষেবা, ক্যারিবিয়ান ভিসা পরিষেবা, জাতীয় দীর্ঘস্থায়ী ভিসা, ডাচ ভ্রমণ নথি এবং নাগরিক একীকরণ প্রক্রিয়ার বিধানের জন্য VFS গ্লোবাল কাজ করে আসছে।
শেনজেন ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভিএফএস গ্লোবালের কার্যক্রম
ভিএফএস গ্লোবাল শেনজেন দেশসহ অনেক দেশের জন্য ভিসা এবং কনস্যুলার পরিষেবা প্রদানে বিশেষজ্ঞ।
শেনজেন ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ায় ভিএফএস গ্লোবালের ভূমিকা নিম্নরূপ:
তথ্য-বিধান: ভিএফএস গ্লোবাল বিভিন্ন দেশের জন্য শেনজেন ভিসার জন্য আবেদন করার জন্য ভিসার প্রয়োজনীয়তা, ডকুমেন্টেশন এবং পদ্ধতির তথ্য প্রদান করে। এ তথ্য সাধারণত তাদের ওয়েবসাইটে এবং তাদের গ্রাহক পরিষেবার মাধ্যমে পাওয়া যায়।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম: VFS Global একটি অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম পরিচালনা করে যা আবেদনকারীদের VFS গ্লোবাল অ্যাপ্লিকেশন কেন্দ্রে বা একটি দূতাবাস/কনস্যুলেটে তাদের ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার জন্য একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে দেয়।
আবেদনকারীরা একটি VFS গ্লোবাল অ্যাপ্লিকেশন কেন্দ্রে তাদের Schengen ভিসার আবেদন জমা দিতে পারেন। VFS Global প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করে, সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থিত আছে কিনা তা পরীক্ষা করে এবং দূতাবাস বা কনস্যুলেটের পক্ষ থেকে ভিসা ফি গ্রহণ করে।
বায়োমেট্রিক ডেটা: ভিএফএস গ্লোবাল আবেদনকারীর বায়োমেট্রিক ডেটা (আঙুলের ছাপ এবং ছবি) সংগ্রহ করে, যদি প্রয়োজন হয় এবং আবেদনের নথিগুলিসহ উপযুক্ত দূতাবাস বা কনস্যুলেটে পাঠায়।
অনুরোধ প্রক্রিয়াকরণ: ভিএফএস গ্লোবাল আবেদনকারী এবং দূতাবাস/কনস্যুলেটের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে এবং আবেদনটি পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দূতাবাস বা কনস্যুলেটে ফরোয়ার্ড করে।
পাসপোর্ট ফেরত: দূতাবাস বা কনস্যুলেট ভিসার আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে, ভিএফএস গ্লোবাল ভিসাসহ পাসপোর্ট (যদি অনুমোদিত হয়) বা একটি ব্যাখ্যামূলক চিঠি (যদি প্রত্যাখ্যান করা হয়) আবেদনকারীকে ফেরত দেবে। আবেদনকারীরা তাদের পাসপোর্ট ভিএফএস গ্লোবাল সেন্টার থেকে সংগ্রহ করতে পারেন বা কুরিয়ারের মাধ্যমে ডেলিভারি করা বেছে নিতে পারেন।
এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ভিসা আবেদনের সিদ্ধান্তের উপর ভিএফএস গ্লোবালের কোনও প্রভাব নেই। এ সিদ্ধান্তটি একচেটিয়াভাবে প্রাসঙ্গিক শেনজেন দেশের দূতাবাস বা কনস্যুলেট দ্বারা নেওয়া হয়।
কিন্তু বিশ্বব্যাপি সুনামের সাথে কাজ করে আসলেও বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। সংস্থাটি বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় সবধরনের পরিষেবা দিতে চায় না বলে ভুক্তভুগি গ্রাহকদের সূত্রে জানা যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- কেন তারা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটি করছে? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কি কোনোকিছুই করার নাই?
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি যে, সেনজেন কান্ট্রিগুলোর অধিকাংশ এম্বাসি ভারতে অবস্থিত। আর বিগত সময়গুলোতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনসহ নানাবিধ কারণে ভারতের ভিসা পেতে লম্বা সময়ের অপেক্ষা এবং ভিসা না দেওয়ার অঘোষিত সিদ্ধান্তের কারণে ইউরোপগামী শ্রমিক -পর্যটকদের নানা হয়রানীর স্বীকার হতে হচ্ছে। আবার মোটা অঙ্কের টেবিলমানি দিয়ে ভারতীয় ভিসা নেয়ার অভিযোগও অহরহই পাওয়া যাচ্ছে।
দীর্ঘসময় ধরে এমন সমস্যা বিধ্যমান থাকলেও বাংলাদেশ সরকার রহস্যজনক কারণে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
নতুন অন্তবর্তী সরকার শুরুতে এ বিষয়ে দু/একটি আলোচনা করলেও এখনো সমস্যাটির কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আর তাতে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপসহ অনান্য দেশে কাজ করতে আগ্রহী শ্রমিক বা পর্যটকদের জন্য নানা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
ভিএফএস গ্লোবালকে বাংলাদেশের আইনের আওতায় বিচারের মুখোমুখি করার সম্ভাব্য আইনি ভিত্তি
১. কনজিউমার রাইটস প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ২০০৯ (The Consumer Rights Protection Act, 2009)
ভিএফএস যেহেতু বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে ফি আদায় করে “সেবা” দিচ্ছে, এটি এ আইনের আওতায় “সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান”হিসেবে গণ্য হয়।
প্রযোজ্য ধারা:
• ধারা ৪৪: প্রতারণা বা মানহীন সেবা প্রদান করলে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• ধারা ৪৫-৪৮: গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা, অতিরিক্ত মূল্য আদায় বা তথ্য গোপনের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
দায়ী কে:
বাংলাদেশে ভিএফএস গ্লোবালের স্থানীয় প্রতিনিধি বা দেশীয় ফ্র্যাঞ্চাইজির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যেতে পারে।
২. পেনাল কোড, ১৮৬০ (ফৌজদারি দণ্ডবিধি)
যদি প্রতারণা, জালিয়াতি, বা জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করে থাকে, তাহলে ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় মামলা করা যায়।
প্রযোজ্য ধারা:
• ধারা ৪০৫ (Criminal Breach of Trust)
• ধারা ৪১৭ (Cheating)
• ধারা ৪২০ (Cheating and Dishonest Inducement)
• ধারা ৪৬৮ (Forgery for the Purpose of Cheating)
৩. বাংলাদেশে নিবন্ধন সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা
ভিএফএস গ্লোবাল যদি বাংলাদেশে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়, তাহলে:
• The Companies Act, 1994 এবং
• Foreign Private Investment (Promotion and Protection) Act, 1980
এই আইনগুলোর আওতায় তাদের কার্যক্রম নিরীক্ষা ও লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া যায়।
পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা:
• বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA)
• বাংলাদেশ ব্যাংক (যদি বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন হয়)
• জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
৪. চুক্তি আইন (Contract Act, 1872)
ভিএফএস গ্লোবাল যদি তাদের ওয়েবসাইটে বা ফর্মে মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকে বা ভিসা সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের মামলা দায়ের করা যেতে পারে
বিচারের পথে বাধা কোথায়?
• ভিএফএস গ্লোবাল সরাসরি কোনো ভিসা অনুমোদন দেয় না; তারা “প্রক্রিয়াকরণ এজেন্ট” হিসেবে কাজ করে। ফলে তারা দোষ চাপিয়ে দেয় দূতাবাস বা কনস্যুলেটের উপর।
• আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চুক্তির আওতায় (যেমন: VFS ও পর্তুগাল দূতাবাসের MoU) অনেক কিছু গোপন থাকে।
কীভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়?
১. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের
২. হাইকোর্টে রিট পিটিশন – জনস্বার্থে (public interest litigation – PIL)
৩. মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে আবেদন
৪. ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর মাধ্যমে গণচাপ
৫. সাংবাদিকতা ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার – Transparency International, Amnesty ইত্যাদির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপন
লেখক: প্রবাসী উদ্যোক্তা।
বিনিয়োগবার্তা/হীরা/শামীম//