মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোকে জনপ্রিয় করতে প্রচার-প্রচারণা জরুরী: এমরান হাসান

‘বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে মিউচ্যুয়াল ফান্ড অত্যন্ত জনপ্রিয় বিনিয়োগের জায়গা। কিন্তু আমাদের এখানে এটি এখনো সেইভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। একসময় দেশের সবচেয়ে বড় মিউচ্যুয়াল ফান্ড ম্যানেজ করতো আইসিবি। কিন্তু এখন অনেক মিউচ্যুয়াল ফান্ড বাজারে তালিকাভূক্ত হয়েছে। কিন্তু এসব ফান্ড নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তেমন আগ্রহ নেই। আর মিউচ্যুয়াল ফান্ড নিয়ে প্রচার-প্রচারণাও কম। এসব ফান্ডের ট্রাস্ট্রিদের উচিত প্রচারে অধিক গুরুত্ব দেওয়া। এসব ফান্ডের সবদিক নিয়ে বিনিয়োগকারীদের ধারণা দেওয়া উচিত। আর এসব করা উচিত লংটাইম টার্গেট নিয়ে। তাহলেই এ খাতে সুফল আসবে।’

একান্ত আলোচনায় একথাগুলো বলছিলেন শান্তা এ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)  মো: এমরান হাসান পাঠকদের উদ্দেশে এ সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।

বিনিয়োগবার্তা: পুঁজিবাজারের সমসাময়িক অবস্থা সম্পর্কে বলুন।

ইমরান হাসান: দেশের পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা আগের চেয়ে বেশ ভাল। সদ্যসমাপ্ত ২০১৭ সালটিতে এ বাজার অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থানে ছিল। গত সাত বছর অর্থাৎ ২০১০ সালের পর থেকে সমাপ্ত বছরে বা ২০১৭ সালে বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি রিটার্ন পেয়েছেন। কোনো সিঙ্গেল ইয়ারে এত পরিমান রিটার্ন বিগত কয়েক বছরে আসেনি। বিশেষ করে ২০১৬ সালের মে মাসের পর থেকে আমরা দেখেছি কয়েকটি স্বাভাবিক প্রফিট টেকিং ছাড়া বাজারের সূচক-লেনদেনের পর্যায়ক্রমিক উত্থান; যা একটানা বছরের শেষ অবদি চলে। বছর শেষে সূচকের রিটার্ন হয় ২৪ শতাংশ।

আকর্ষনীয় রিটার্ন ও স্থিতিশীল অবস্থার জন্য অনেক বিনিয়োগকারী এখন বাজারে আসার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সেই সাথে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও বাজারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

অবশ্য গত নভেম্বরের শেষ দিক থেকে আমরা বাজারে একটি নিম্নমুখি প্রবণতা লক্ষ্য করছি। তারল্য সংকট এর অন্যতম কারন বলে আমার কাছে মনে হয়। এফডিআর রেট এরও একটি উর্ধ্বমুখি প্রবনতা আমরা ওই সময় দেখেছি। এফডিআর রেট বৃদ্ধি পেলে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে যায়।আর এরফলে বিনিয়োগের একটি বড় অংক এফডিআর এ চলে যায়। আবার মার্কিন ডলারের দাম উর্ধ্বমুখি থাকলেও টাকার তারল্য সংকট দেখা দেয়। তবে এখন বিনিয়োগকারীদের মানি মার্কেটের প্রতি নজর রাখা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

বিনিয়োগবার্তা: ২০১৮ সাল পুঁজিবাজারের জন্য কেমন হবে বলে আপনি মনে করছেন?

ইমরান হাসান: বাজারের সার্বিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। রেগুলেটরি বডিও এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম ও সতর্ক। অনেক লিস্টেড কোম্পানিই এখন তাদের প্রাইস আর্নিংস কল করে থাকে। যা থেকে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিগুলো সম্পর্কে অনেক ধারনা নিতে পারেন। আমরা এ বছরে কোম্পানিগুলোর ভাল গ্রোথ ও আনিংস দেখতে পাচ্ছি। বাজারের বিনিয়োগকারীরা এখন বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে সচেতন হয়ে উঠছেন।

২০১৮ সালে বিনিয়োগকারীদেরকে আগের বছরগুলো থেকে অধিক সতর্ক থাকতে হবে বলে আমার কাছে মনে হয়। তারল্য সংকট, ডলারের দর, প্রাইভেট সেক্টর ক্রেডিট গ্রোথ- এসব বিষয়ে সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। সেই সাথে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশও ভালো বাজারের জন্য প্রয়োজন। জেনে বুঝে ভাল মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ারে বিনিয়োগ করলে অবশ্যই ভাল রিটার্ন পাওয়া যাবে। সবমিলিয়ে বাজার নিয়ে এখন সবপক্ষই আশাবাদী। এসব দিক বিবেচনায়ই সামনে বাজার আরও ভাল হবে বলে ধারনা করছি।

বিনিয়োগবার্তা: মিউচ্যুয়াল ফা্ন্ডগুলো আমাদের বাজারে কেন জনপ্রিয় হচ্ছে না

 

ইমরান হাসান: বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে মিউচ্যুয়াল ফান্ড অত্যন্ত জনপ্রিয় বিনিয়োগের মাধ্যম। কিন্তু আমাদের এখানে এটি এখনো সেই অবস্থানে আসেনি। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোকে জনপ্রিয় করতে এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোকে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও সততার পরিচয় দিতে হবে।

 

আর মিউচ্যুয়াল ফান্ড নিয়ে আমাদের এখানে প্রচার প্রচারণাও কম। ভারতে এসোসিয়েশন অব মিউচ্যুয়াল ফান্ড ফান্ডগুলোতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার প্রচারণা করে থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে ওই ধরনের কোনো কর্মকান্ড এখনো আমরা দেখছি না। এসব ফান্ডের ট্রাস্ট্রিদের উচিত প্রচারে অধিক গুরুত্ব দেওয়া। ফান্ডের সবদিক নিয়ে বিনিয়োগকারীদের ধারণা দেওয়া। আর এসব করা উচিত লংটাইম টার্গেট নিয়ে। এছাড়া এগুলোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ফান্ডগুলোর ট্রাস্টিদের উচিত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা। তাহলেই এ খাতে সুফল আসবে।

বিনিয়োগবার্তা: এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর কার্যপরিধি বাড়াতে কী কী করণীয় রয়েছে?

ইমরান হাসান: এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর মূল কাজগুলো হলো মিউচ্যুয়াল ফান্ড ঘিরে। তাই এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোকে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানানোটাই এই মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার। দেশব্যাপি শক্তিশালী সেলস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাও জরুরী; যেন একজন বিনিয়োগকারী চাইলে সহজেই যেকোনো মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন।

আর একটি বিষয় হলো- আমাদের এখানে সংশ্লিষ্ট জ্ঞান আহরণ ছাড়াই অনেক ব্যক্তি নিজেই নিজের সম্পদ ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। অনেকের আবার যথেষ্ঠ জ্ঞান থাকলেও সময়ের অভাবে নিজের সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ করতে পারেন না। দীর্ঘমেয়াদে ভালো মুনাফা ও সঠিকভাবে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রনের জন্য তাদের উচিত দক্ষ এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে ফান্ড ম্যানেজ করা। এছাড়া এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ফান্ড ম্যানেজমেন্ট ও ক্যাপিটাল মার্কেট এ্যাডভাইজারি করারও সুযোগ রয়েছে। আর এসব বাস্তবায়ণ হলে এই খাতে ভাল ফলাফল আসবে বলে আমার ধারণা।

বিনিয়োগবার্তা: শান্তা এ্যাসেট ম্যানেজমেন্টকে আপনি কোন অবস্থানে নিয়ে যেতে চান?

ইমরান হাসান: দেখুন, যেকোন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষরা চান তার প্রতিষ্ঠিানটি ভাল অবস্থানে থাকুক। আমিও তেমনি চাই। এদেশে এখনো এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। এরইমধ্যে আমরা বিভিন্ন পক্ষের সাথে সুসমন্বয় করে কাজ করতে চেষ্ঠা করছি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ কোম্পানির কার্যপরিধি বাড়াতে নিরলস চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে শান্তা এ্যাসেট ম্যানেজমেন্টকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবো। তবে এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।আর সংশ্লিষ্ট সকলেরর সহযোগিতায় আমি শান্তা এ্যাসেট ম্যানেজমেন্টকে দেশের প্রথম সারির দক্ষ ও সৎ কোম্পানিতে পরিণত করতে চাই।

বিনিয়োগবার্তা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত ‘বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম’ পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কি ধরনের ভূমিকা রাখছে?

ইমরান হাসান: দেশের পুঁজিবাজারের বিকাশে ‘বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এদেশের মানুষ পুঁজিবাজার নিয়ে খুব বেশি জ্ঞাত নয়। এনিয়ে সব ধরনের মানুষের মধ্যে তেমন একটা আগ্রহও নেই।বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম মানুষের মধ্যে এ বাজার নিয়ে আগ্রহ তৈরী করছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হলে শিক্ষা ও সচেতনতা জরুরী। ফিনান্সিয়াল লিটারেসির মাধ্যমে মানুষ এই শিক্ষা নিতে পারছে। আগামী দিনের বাজারে এই শিক্ষার প্রতিফলন ঘটবে বলে আমি দৃঢভাবে বিশ্বাস করি। এরফলে বিনিয়োগকারীরা আর প্রতারিত হবেন না। তারা নিজেরাই বিচার-বিশ্লেষণ করে ভাল মৌলভিত্তির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবেন। এসব বিবেচনায় এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখা খুবই জরুরী।

বিনিয়োগবার্তা: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

ইমরান হাসান: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে আমার একটিই কথা; আর সেটি হলো- এ বাজারে বিনিয়োগের আগে সঠিক জ্ঞান আহরণ করুন। বর্তমানে বিএসইসির নির্দেশনায় ডিএসই-সিএসইসহ সব ব্রোকারেজ হাউজ ও বাজারের ট্রেকহোল্ডাররা বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহন করুন। নিজের শেয়ার নিজে কিনুন-জেনে বুঝে তবেই কিনুন।

প্রসঙ্গত, ইমরান হাসানের পৈত্রিক ভূমি যশোরে। কিন্তু তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজধানীর ধানমন্ডিতে। ধানমন্ডি গভমেন্ট বয়েজ হাই স্কুল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেছেন তিনি। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর মেঘনা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজে যোগদান করেন। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। এরপর এশিয়ার টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনারসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হিসাবে যোগদান করেন। এরপর শান্তা এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সিইও হিসাবে যোগদান করেন তিনি। দেশের কর্পোরেট জগতে তার একযুগেরও অধিক সময়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

 

(এমআইআর/এসএএম/ ২৫ জানুয়ারি ২০১৮)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


Comment As:

Comment (0)