‘কোথাও কেউ নেই’ এর বদি আর নেই
বিনিয়োগবার্তা ডেস্ক, ঢাকা: আব্দুল কাদের। এদেশের সাংস্কৃতিক জগতে তার কোনো শত্রু নেই। সদা হাসিমুখের এই মানুষটি সবাইকে খুব সহজেই আপন করে নিতেন। কর্পোরেট দুনিয়ার কর্মকর্তা হলেও তার ভেতরটা ছিল অভিনয়ের প্রতি ভীষণ আকুতিভরা। ফেসবুক দুনিয়ায় তার মৃত্যু সংবাদ বিভ্রান্তির পর সত্যিই উনি চলে গেলেন। ‘কোথাও কেউ নেই’-এর বদি চরিত্র বা ইত্যাদির মামা হিসেবে সামাজিক মেসেজ দেওয়া মানুষ হিসেবে তিনি আজীবন দর্শকদের ভালোবাসার জায়গায় থেকে যাবেন। তাকে নিয়ে কিছু কাছের মানুষের শ্রদ্ধাস্মরণ গ্রন্থিত হলো আজ—
সুবর্ণা মুস্তাফা
খবরটা শুনে মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এ বছর অনেক কাছের মানুষকে হারালাম। কাদের ভাইয়ের সঙ্গে কত শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে, তা বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৮৬ সালে ফরীদি (অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি) আর আমি ভারত যাচ্ছিলাম। সেই যাত্রার ফ্লাইট ছিল পরদিন। আগের দিন দরজায় নক পড়ল। দরজা খুলে দেখি কাদের ভাই দাঁড়িয়ে আছেন ক্যামেরা হাতে নিয়ে। তিনি সেটা আমাদের দিয়ে বললেন, ‘ভারত যাবা, সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখবা আর ছবি তুলবা।’ এই হলো কাদের ভাই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের তখন কোনো ক্যামেরা ছিল না। কাদের ভাই কেমন করে সেটা জানতে পেরেছিলেন আজো আমি সেটা জানতে পারিনি। জীবনের দারুণ এক স্মৃতি হয়ে রইলো এই ঘটনা। আমরা সবাই আপনাকে ভালোবাসি কাদের ভাই।
লুত্ফর রহমান জর্জ
কাদের ভাই প্রথমত আমার সিনিয়র ভাই। আমি তাকে ৩৫ বছর ধরে চিনি। থিয়েটারে কাজ করতে গিয়ে পরিচয়। পরে যখন টিভিতে গেলাম, আমার প্রথম টেলিভিশন নাটকেও তিনি আমার সঙ্গে ছিলেন। তাকে নিয়ে বলে শেষ করা যাবে না। কাদের ভাইয়ের মতো মানুষ যেখানে থাকেন সেখানে সকাল-সন্ধ্যা আনন্দ খেলা করে। তার সঙ্গে থাকলেই হেসে খেলে দিন চলে যেত। বড় ভাই-ছোট ভাই তো ছিলামই আমরা, বন্ধুত্বও ছিল আমাদের। তার মধ্যে বড়ভাই সুলভ আচরণ দেখতাম না কখনো। মিশতেন মন খুলে। আগলে রাখতেন দায়িত্ব নিয়ে। আমার ক্যারিয়ার শুরুর দিনগুলোতে কাদের ভাই অনেককিছু শিখিয়েছেন। যখন যেখানে দেখা হতো আগেই কথা বলতেন। কান্না পাচ্ছে খুব, তার মতো মানুষ এত কষ্ট পেয়ে গেলেন শেষ দিনগুলোতে। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসীব করুন। আমরা একটি নাটকে অভিনয় করে আজীবন সেই নাটকের চরিত্র হয়ে রইলাম। বাকের ভাই, বদি আর মজনু। দু’জন রইলাম, বদি চলে গেলেন। একটা আবেগের শূন্যতা এখানে ভর করছে। কাদের ভাই ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের জনপ্রিয়তা খুব উপভোগ করেছেন। আমরা সবাই করেছি। নাটকটি এত দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পর চরিত্রগুলো সব মানুষের মুখে মুখে চলে এলো। দারুণ উত্তেজনা নিয়ে, মনোযোগ নিয়ে কাজ করেছি। বাকের ভাই ও মজনুর নামে মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছিল বদি। বদি চরিত্রে অভিনয় করে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি কাদের ভাইকে। তবে সবই মজার অভিজ্ঞতা হিসেবে উপভোগ করেছেন তিনি। সহজ-সাদামাটা মানুষ ছিলেন। মনে আছে নাটকটি শেষপর্বে হঠাৎ করে দেখি কাদের ভাইয়ের দাঁড়ি বড়। আগের দৃশ্যে দাঁড়ি আরো কম ছিল। পরের দৃশ্যে দাঁড়ি বড়। আমি বললাম, আপনার দাঁড়ি বোধহয় বড় হয়ে গেছে। দেখেন তো। উনি ফিসফিস করে বললেন, ‘জর্জ প্লিজ, আর আলাপ করো না এ নিয়ে। যদি এটা এখন কাউকে বলো তাহলে আমার মাইর একটাও বাইরে পড়বে না। সিনটা শেষ করতে দাও দাঁড়ি রেখে।’ এমনই মজার মানুষ ছিলেন তিনি। এরপর কাদের ভাইয়ের সঙ্গে অনেক নাটক করেছি। ২০-৩০ টিরও বেশি। ভাবীও ছিলেন অনেক নাটকে। সম্পর্কে উনি আমার বেয়াই হন। আমার খালাতো ভাইয়ের স্ত্রীর খালাতো ভাই ছিলেন কাদের ভাই। তাকে নিয়ে আমার স্মৃতির শেষ নেই।
শ্রাবন্তী
বছরজুড়েই প্রিয়জনদের মৃত্যুর খবর শুনতে হলো। কিছুদিন আগে আমার মা চলে গেলেন। আজ কাদের মামা। আমি ওনাকে মামা বলে ডাকতাম। আমার অভিভাবক ছিলেন। ১২ বছর ধরে অভিনয়ে নেই। অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ বন্ধ। কিন্তু কাদের মামা যোগাযোগ রাখতেন। অভিভাবকের মতো খোঁজ নিতেন। তার কাছে সবসময়ই আদর-স্নেহ পেয়েছি। মামা ও মামী দু’জনই আমাকে খুব আদর করেছেন সবসময়। তার মৃত্যুটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অভিভাবক হারিয়ে ফেলার বেদনা দিচ্ছে।
মামা কোনো কাজ হাতে নিলে আমাকে কল দিয়ে জানতে চাইতেন আমি কাজটি করছি কি-না। যদি এমন হতো দু’জনই একটি নাটকে কাজ করছি, তবে উনি খুব খুশি হতেন। মামা কখনো শুটিং ইউনিটের খাবার খেতেন না। বাসা থেকে নিয়ে আসতেন। যখনই আমি সেটে থাকতাম উনি বলতেন, ‘এই মেয়ে এদিকে আয়, ভাত খাবো।’ এই যে স্নেহটা, কোনোদিন ভোলার নয়।
মামার সঙ্গে সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছে। আসলে এই মুহূর্তে সব এলোমেলো লাগছে। তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার মানুষ। সবসময় নিজের চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করতেন। সেটের লোকদের সঙ্গে ডিসকাস করতেন ঠিকমতো চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে পারছেন কি-না। ভীষণ প্রাণবন্ত আর মনোযোগী একজন অভিনেতা ছিলেন মামা। পর্দায় আমরা যে আব্দুল কাদেরকে দেখতাম সবসময় হাসাচ্ছেন, দুষ্টুমির সংলাপ দিচ্ছেন, বাস্তব মানুষটা এ রকম ছিলেন না। নিপাট ভদ্রলোক, পরিপাটি, শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষ ছিলেন। দোয়া করি কাদের মামাকে যেন আল্লাহ বেহেস্ত দান করেন।
আফজাল শরীফ
ভাল্লাগতাছে না, এ কষ্ট সহ্য করার মতো না। ২০টি বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। সে আমার আপনের চেয়েও আপন একজন। নিয়মিত যোগাযোগ হতো যে অল্প ক’জনের সঙ্গে তাদের একজন ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি। শেষপর্ব, ইত্যাদির। আমার সংলাপ ছিল, ‘আমি না জেনে-বুঝে খারাপ করেই যাই, আর তুমি আমারে বাঁচায়া দাও মামা।’ তার সংলাপ ছিল, ‘ভাইগ্না, আমি বারবার বাঁচাই সত্য, কিন্তু কতদিন এভাবে বাঁচাতে পারবো?’ দু’জনের এই সংলাপগুলো আজ বারবার মনে পড়ছে। চলে যাওয়াটা একটু তাড়াতাড়িই হয়ে গেল।
(ডিএফই/২৭ ডিসেম্বর ২০২০)