Governor REPO Rate Inflation

সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে গভর্নরের বৈঠক

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার ১০ শতাংশে উন্নীত করার আভাস

ডেস্ক রিপোর্ট: উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দুই বছর ধরে নীতি সুদহার (রেপো রেট) বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও এর প্রভাব দেখা যায়নি মূল্যস্ফীতিতে, বরং জুলেইয়ে এই হার গিয়ে ঠেকে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর নীতি সুদহার ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর আভাস দিয়েছেন। দেশের সবক’টি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে বুধবার বৈঠকে গভর্নর এ ইঙ্গিত দেন।

আহসান এইচ মনসুর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করেন। ব্যাংক নির্বাহীদের তিনি গতকাল জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার আরো বাড়ানো হবে। এ হার ১০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করা হতে পারে। তবে ডলারের বিনিময় হার যাতে ১২০ টাকার বেশি না হয়, সে বিষয়ে তিনি ব্যাংক নির্বাহীদের সতর্ক করেছেন। এছাড়া কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এসএমই খাতে বিনিয়োগ ও ক্লাস্টার বাড়ানো, এক্ষেত্রে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের ব্যবহার নিশ্চিত, ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে ট্রেজারি বিল-বন্ড ও সুকুক বিক্রি, খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনগত প্রক্রিয়া জোরদারকরণ, অবলোপন বাড়ানোসহ সুশাসন নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য গভর্নর ব্যাংক নির্বাহীদের নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

ব্যাংক এমডিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে গভর্নর গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, অনিয়ম-দুর্নীতিতে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর উন্নয়নে পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আগামীতে ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আসবে। সরকার সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের আমানতকারীদের পাশে আছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মতো টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে দেবে না। তারা অন্য ব্যাংক থেকে টাকা আমানত নিতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে গ্যারান্টি দেবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোয় যারা টাকা জমা রেখেছেন, তাদের কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে।

তিন মাস পরপর দেশের সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠক হয়। ‘ব্যাংকার্স সভা’ নামের এ বৈঠক গতকাল বেলা ২টায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেয়া একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জানান, গভর্নর পদে আহসান এইচ মনসুরের দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংক নির্বাহীদের সঙ্গে এটি প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল। এ কারণে ব্যাংক খাতের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গভর্নর নীতি সুদহার আরো বাড়ানোর আভাস দিয়েছেন।

দেশের ব্যাংকগুলো এখন ১৪-১৫ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করছে। নীতি সুদহার ১০ শতাংশে উন্নীত করা হলে ঋণের সুদহার বেড়ে ১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। এক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডসহ সব ধরনের ঋণের সুদহারই বাড়ানো হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদ ২০ শতাংশ নির্ধারণ হয়েছিল। বৈঠকে এ সুদসীমা তুলে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

ঘুস ও কালো টাকার দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থাহীনতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কয়েক মাস ধরেই দেশে নগদ টাকার প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। গত ২৩ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ১৬ হাজার ১১০ কোটি টাকা। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকার্স সভায় জানান, মানুষের হাতে থাকা অর্থ ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। গত কয়েক দিনে জমা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা ব্যাংকে ফিরে আসতে পারে। বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহ কমে এলে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। 

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট পূরণে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ঘোষণা রয়েছে। যদিও এ পরিমাণ ঋণ দেয়ার সক্ষমতা ব্যাংক খাতের নেই। গতকালের সভায় এ বিষয়টিও আলোচনায় আসে। গভর্নর বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন অযোগ্য। সংশোধিত বাজেটে এটির আকার কমিয়ে আনা হবে। আমি সরকারকে বলেছি, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ১ লাখ কোটি টাকার নিচে নামিয়ে আনতে হবে। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া কমালে বেসরকারি খাত উপকৃত হবে।’

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বাধীন আইএফআইসি ব্যাংকের পর্ষদও গতকাল ভেঙে দেয়া হয়। আরো পাঁচ-ছয়টি ব্যাংকের পর্ষদ দ্রুতই ভেঙে দেয়া হতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে বলেন, ‘বেশকিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আসবে। এসব ব্যাংকে নিরীক্ষা করা হবে। এরপর সেগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এসব ব্যাংক পুনর্গঠন করে একা চলবে, নাকি কারো সঙ্গে একীভূত হবে, সে সিদ্ধান্তও নেয়া হবে। ছোট ব্যাংক হলে অবসায়নও হতে পারে। ইসলামী ব্যাংকের অর্ধেক টাকা নাই হয়ে গেছে। এসব ব্যাংক মেরামত করতে এক-দুই বছর সময় লাগবে।’

পর্ষদ ভেঙে দেয়া বেশির ভাগ ব্যাংকই তারল্য সংকটে ভুগছে। আতঙ্কিত গ্রাহক আমানত তুলে নিতে ব্যাংকগুলোয় ভিড় করছেন। যদিও চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিধ্বস্ত এসব ব্যাংকের বিষয়েও গতকালের ব্যাংকার্স সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে গভর্নর বলেন, ‘ব্যাংক খাত থেকে বিভিন্নভাবে বড় ধরনের অর্থ পাচার হয়ে গেছে। মূলত সাত-আটটি ব্যাংক থেকে এ অর্থ বের হয়েছে। ফলে সেগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মতো আর টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে দেবে না। তাতে ২ লাখ কোটি টাকা ছাপাতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম সবকিছু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যাবে।’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সাত-আটটি ব্যাংকে সমস্যা থাকলেও পুরো ব্যাংকিং কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে আমরা সীমিত আকারে টাকা দেয়ার চেষ্টা করছি।’

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের বড় গন্তব্য যুক্তরাজ্য, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব অর্থ ফেরাতে চেষ্টা করে যাচ্ছি, দেখা যাক কী হয়। বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সামনে আরো আলোচনা হবে। আমরা অর্থ ফেরত আনতে ও কারিগরি সহায়তা দিতে তাদের আহ্বান জানিয়েছি। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা জব্দের জন্য বলছি। কেবল যুক্তরাজ্যেই একজনের ৫০০-৬০০ বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। আরো অনেকের এমন সম্পদ রয়েছে।’ বড় ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে দেশে থাকা তাদের সম্পদ জব্দের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন গভর্নর।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)