ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
আর্থিক খাতে এত অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি পৃথিবীর আর কোথাও হয়নি
নিজস্ব প্রতিবেদক: অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আর্থিক খাতে এত বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে সেটা বাইরে থেকে কল্পনাও করা যাবে না। এত অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি পৃথিবীর আর কোথাও হয়নি।’ তবে এই ক্ষত সারিয়ে তুলতে সময় লাগবে উল্লেখ করে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশের মানুষের কর্মদক্ষতা অতুলনীয়। এই দক্ষতা দিয়ে আগামীতে দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। অর্থনীতির এই অবস্থায় উচ্চ সুদে বিদেশ থেকে ঋণ নেবে না অন্তর্বর্তী সরকার। আপাতত আমরা স্বল্পমেয়াদি কিছু সংস্কারে জোর দিয়েছি। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার করতে হবে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারকে।’
শনিবার (১৬ নভেম্বর) আর্থিক খাতে সংস্কার বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ‘পলিসি ডায়ালগ অন ফাইন্যান্সিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক রিফর্মস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সৈয়দ ফরহাত আনোয়ারের সভাপতিত্বে আয়োজিত আলোচনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার ফারজানা লালারুখ ও ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এত বিশৃঙ্খলার পরও দেশের যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে তাতে কৃষকদের বড় ভূমিকা আছে। কৃষি বিজ্ঞানীদেরও অবদান অনেক। বৈদেশিক মুদ্রার নিট আয় করছে প্রবাসী বাংলাদেশীরা। বিগত সরকারের অনেক ভুল পলিসি উত্তরাধিকার সূত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে টানতে হচ্ছে। সেগুলো সংস্কার করতে সময় লাগবে। সব সংস্কার আমরা করে যেতে পারব না। আমরা হয়ত জরুরি কিছু প্রাথমিক সংস্কার করব। বাকি সংস্কার রাজনৈতিক সরকার করবে। বাংলাদেশের মানুষের যে দক্ষতা তা দিয়ে সংস্কার সম্ভব।’
মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। মূল্যস্ফীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছু ক্রটি আছে। বগুড়া থেকে কারওয়ান বাজার আসতে ১৭ জায়গায় টাকা দিতে হয়। কিছু জায়গায় মধ্যস্বত্ত্বভোগী দরকার হলেও কেউ কেউ কিছু না করেই কেবল ফুটপাথে দাঁড়িয়ে চাঁদাবাজি করছে। যে কারণে আমি চেয়েছিলাম কিছু ডিলার পরিবর্তন করতে। তবে পরিবর্তন করলে আরেক গ্রুপ এসে নাকি চাঁদাবাজি শুরু করবে। এটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন? তবে এদের সংখ্যা কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
রাজস্ব খাতের পলিসি আর প্রয়োগ আলাদা করার ইঙ্গিত দেন অন্তর্বর্তী সরকারের এ উপদেষ্টা। বলেন, ‘বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই রয়েছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অনেক প্রকল্প করা হয়েছে, ফিজিবিলিটি টেস্ট করা হয়নি। শুধু প্রবৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে রিজার্ভ বাড়ছে, রফতানি বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কম রয়েছে। অর্থনীতিতে শুধু উন্নয়ন দেখানোর যে প্রবণতা, সেই উন্নয়ন কৌশল পরিবর্তন করতে হবে।’
দেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘ভবিষ্যতে কেউ টাকা পাচার করলে সে প্রাইভেট কিংবা পাবলিক যেই সেক্টরই হোক ধরা পড়বে। কেউ লুটপাট করলে শাস্তি পেতেই হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান রাত ৯টা পর্যন্ত একটা অনুমোদন দেওয়ার জন্য বসে থাকে সেই প্রতিষ্ঠান কেমন চলতে পারে ভাবুন। এখন রিজার্ভ থেকে এক টাকাও বিক্রি না করে বাংলাদেশ ব্যাংক আগের বকেয়া পরিশোধ করছে। অথচ আগের গভর্নর ৪২ বিলিয়ন থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে দিলেন। এভাবে রিজার্ভ নিঃশেষ করে এখন মহা আনন্দে কোথায় আছেন জানি না। আমি তিন সরকারের সময়ে গভর্নরের দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়েছি। তখন সবাই ফেরেশতা ছিল না। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। এখন তা আড়াই লাখ কোটি টাকা। এই খেলাপি কেন, কাদের জন্য বেড়েছে সেটা সবার জানা।’ ব্যাংক খাত ও শেয়ারবাজারের অবস্থা নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘ব্যাংক খাত, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, শেয়ারবাজারে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। তবে সংস্কার করতে গেলে কিছু ব্যথা সইতে হবে। অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। চিন্তা করেন ব্যাংকগুলোকে কীভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। সবকিছু সংস্কারের জন্য সময় প্রয়োজন।’
ভারতের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আদানির সঙ্গে হওয়া বিদ্যুৎচুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আদানির বিষয়ে কোনো করই দেয়া হয়নি। তাদের টাকা দেয়ার জন্যে সময় নেয়া হয়েছে।’
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//