‘বিশ্বায়নের বাস্তবতায় শিকড়ের সন্ধান’ প্রতিপাদ্যে ছায়ানটের বর্ষবরণ
প্রতিবেদক, বিনিয়োগবার্তা, ঢাকা: নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান স্পন্দিত হয়ে উঠেছিল অগণিত উৎসুকচিত্ত ও আনন্দিত প্রাণের মহাসমারোহে। আজ শনিবার ভোরে বাংলা বর্ষবরণের কেন্দ্রবিন্দু রমনা উদ্যানের বটমূলে ছিল ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান।
বরাবরের মতো এবারও ভোর সোয়া ছয়টার দিকে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয়। আয়োজন শেষ হয় সকাল সাড়ে আটটার দিকে।
ছায়ানটের বর্ষবরণের এবারের বিষয় ‘বিশ্বায়নের বাস্তবতায় শিকড়ের সন্ধান’। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, সামাজিক অনাচারের বিপরীতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মশক্তির জাগরণ ঘটাতে এমন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ হয়েছে। তাই তাদের বর্ষবরণের গানে, কবিতায় বিশ্বায়নের বাস্তবতায় শিকড়ের সন্ধান করে ছায়ানটের শিল্পীরা। এতে বাঙালি জাতিকে নতুন করে জেগে ওঠার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ছায়ানটের আয়োজনে শামিল হতে ভোরেই রমনার বটমূলে নানা শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষের সমাগম ঘটে। তাদের পরনে ছিল রঙিন পোশাক। তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ জানান দিচ্ছিল যে তারা এই উৎসবে একাত্ম।
রমনার এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা যায়। রমনায় প্রবেশের ক্ষেত্রে করা হয় তল্লাশি।
ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন কথন পর্বের পর রীতি অনুযায়ী জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ছায়ানটের প্রভাতি আয়োজন।
কথন পর্বে সন্জীদা খাতুন বলেন, ‘যে মাটি আমাদের পায়ের তলায় আশ্রয়, জন্মের শুভক্ষণে সেই মাটিতেই ভূমিষ্ঠ হয়েছি আমরা। জন্মসূত্রে এ মাটি আমাদের একান্ত আপন। সে মাটির বুকে শিকড়ের মতো পা ডুবিয়ে মাটি-মাতাকে জানব আমরা। এমন স্বভাবসম্মত প্রক্রিয়ায় বেড়ে ওঠে আত্মপরিচয়ের প্রত্যয়ী, আর প্রতিষ্ফিত হব আমরা বাংলাভূমির সর্বজন। আবার মাটির রসে পুষ্ট হয়ে আকাশের দিকেও হাত বাড়াব আমরা। আলো আর বাতাসের তেজ আর স্নিগ্ধতা সর্ব অঙ্গে মেখে আমাদের সত্তা সঞ্জীবিত হয়ে উজ্জ্বলতর হবে।’
সন্জীদা খাতুন বলেন, ‘মাটি আর আলো-বাতাসের রস-সম্পদ সব মিলে আমাদের করে তুলবে পূর্ণাঙ্গ মানুষ। এভাবে শাশ্বত মানব হওয়ার পথের অভিযাত্রা সফল হবে। বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস, পাহাড়-সমতল-প্রান্তর, নদী-সমুদ্র বৃক্ষ লতা, ফুল, ফল,পাখপাখালি আমাদের পরম প্রিয়। প্রিয় এ দেশের সকল মানুষ। পরস্পর সংবদ্ধ থেকে আমরা বিশ্বকেও যোগ করে নেব আমাদের সঙ্গে।’
ছায়ানটের সভাপতি বলেন, ‘শিকড়ের মাটিতে দৃঢ়বদ্ধ থেকে বিশ্বায়নের ফলে পাওয়া সত্য-সুন্দরকে আত্মগত করে ঋদ্ধ হব আমরা। বিশ্বায়ন আজ আমাদের কাছে বাস্তব সত্য। এ শব্দ নিন্দা অর্থে উচ্চারণ করছি না। বিশ্বের সংগীতে-সাহিত্যে, শিল্পকলায়-দর্শনে-বিজ্ঞানে যে মহান অর্জন, তার স্বাদ নেব আমরা। আত্মস্থ করতে হবে সকল মানবিক অন্তর সম্পদ। সেই সত্য সুন্দর সমৃদ্ধ করবে আমাদের। দেশীয় মানসের সঙ্গে বিশ্বের মানসের সহজ যোগেই আসবে মানবকল্যাণ।’
এর আগে বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের ক্ষণে মর্তুজা কবিরের বাঁশিতে রাগ আহীর ভাঁয়রো পরিবেশনার মধ্যে শুরু হয় মূল আয়োজন।
একক সংগীত পর্বে অভয়া দত্ত পরিবেশন করেন ‘শুভ প্রভাতে পূর্ব গগনে’, সুমা রাণী রায় শোনান ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি’, খায়রুল আনাম শাকিল শোনান ‘জাগো অরুণ ভৈরব’, সত্যম কুমার দেবনাথ গেয়েছেন ‘প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারি প্রাণে’, সেঁজুতি বড়ুয়া শোনান ‘তোমার হাতের রাখী খানি’। তাঁদের গানের মধ্যেই চলতে থাকে ছায়ানটের শিশু ও বড়দের দলের সম্মেলক গানের পরিবেশনা।
পরে সুস্মিতা দেবনাথ শুচি শোনান ‘আজি গাও মহাগীত’, মাহমুদুল হাসান শোনান ‘গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ঐ’, লাইসা আহমেদ শোনান ‘জল বলে চল’, শামীমা নাজনীন গাইলেন ‘পৃথিবীজোড়া গান’।
পরে সেমন্তী মঞ্জরি গেয়ে শোনান ‘মালা হতে খসে পরা’, এ টি এম জাহাঙ্গীর শোনান ‘তোমার দ্বারে কেন আসি’, শামীমা পারভিন শিমু গাইলেন ‘শ্যামল বরণ বাংলা মায়ের’, মঈদুল ইসলাম গাইলেন ‘ধূলি পিঙ্গল জটাজুল মেলে’, নুসরাত জাহান রুনা শোনান ‘ও আমার বাংলাদেশের মাটি’ গানগুলো।
মো. খায়রুল ইসলাম গেয়েছেন ‘শিরনি খাওয়ার লোভ যার আছে’, আবুল কালাম আজাদ শোনান ‘জীবন আমার ধন্য যে হয়’, গানগুলো।
সম্মেলক গান পর্বে ছায়ানটের ‘বড়দের দল’ পরিবেশন করে ‘পূর্ব গগন ভাগে দীপ্ত হইল সুপ্রভাত’, ‘ওই পোহাইল তিমিররাতি’, ‘শুভ সমুজ্জ্বল হে চির নির্মল’, ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন’, ‘ও আমার দরদি আগে জানলে’ গানগুলো।
‘ছোটদের দল’ পরিবেশন করে ‘প্রভাত বীণা তব বাজে’, ‘আজি নূতন রতনে’, ‘মেঘ বিহীন খর বৈশাখে’, ‘এল এল রে বৈশাখী ঝড়’, ‘বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে’ গানগুলো।
পরে আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ পরিবেশন করেন হুমায়ুন আজাদের ‘শুভেচ্ছা’ কবিতাটি।
প্রভাতি আয়োজনের একেবারে শেষ অংশে ছোট ও বড়দের দল যৌথভাবে পরিবেশন করে ‘ওরে আইল বৈশাখ নয়া সাজে’ গানটি।
(এএইচএন/ ১৪ই এপ্রিল, ২০১৮ )