ঈদ সামনে রেখে নরসিংদীর জামদানি পল্লী তাঁতীদের ব্যস্ত সময়

মো : শাহাদাৎ হোসেন রাজু, নরসিংদী:  এখন রমজান মাস আর কয়েক দিন বাদেই মুসমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল ফিতর । পবিত্র ঈদ-উল ফিতরকে সামনে রেখে নির্ঘুম ব্যস্ত সময় পার করছেন নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার দৌলতপুর জামদানি পল্লীর তাঁতীরা। ঈদের আর মাত্র কয়েক দিন বাকী তাই সময় যতই  ঘনিয়ে আসছে, ততই ব্যস্ততা বাড়ছে জামদানি পল্লীতে। আর এখানকার তৈরি জামদানি সরবরাহ করা হচ্ছে রাজধানী ঢাকার অভিজাত বিপণী বিতানগুলোয়। অধিক মজুরির আশায় দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন জামদানি শাড়ী তৈরির তাঁতীরা।

জানা যায়, দৌলতপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে জামদানি শাড়ি তৈরির কাজ শিখে ১৯৮৮ সালে নিজ উদ্যোগে দৌলতপুরে একটি জামদানি তাঁত স্থাপন করে শুরু করেন শাড়ি তৈরির কাজ। চাহিদা থাকায় ও লাভজনক হওয়ায় পরিবারের অন্যদের যুক্ত করেন জামদানি তৈরির কাজে। তাকে অনুস্মরণ করে অনেকে নিজ নিজ বাড়িতে স্থাপন করেন এ তাঁত । এভাবে দৌলতপুর ইউনিয়নে প্রসার হতে থাকে জামদানি শাড়ি তৈরির কার্যক্রম।

সোমবার সরেজমিনে দৌলতপুর গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে দৌলতপুর গ্রামের জামদানি পল্লীতে প্রায় অর্ধশতাধিক তাঁতে দুই শতাধিক পরিবার জামদানি শাড়ি তৈরির কাজে জড়িত।

এখানকার জামদানি কারিগরদের বেশিরভাগই কমবয়সী হলেও শাড়ি তৈরিতে বেশ দক্ষ তারা। সুতার গুণগত মান ও ডিজাইন ভেদে বিভিন্ন দামের শাড়ি তৈরি করে থাকেন এখানকার কারিগররা। প্রতিটি জামদানি শাড়ি ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা মূল্যের মাঝে তৈরি করা হয়। এক সঙ্গে দু’জন তাঁতী কাজ করে প্রতিটি শাড়ি তৈরি করতে ১৫ দিন থেকে এক মাস সময় লাগে। এতে তাদের মজুরি খরচ পরে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।

প্রতি বছর ঈদ মৌসুমে ব্যস্ততা বাড়ে এখানকার জামদানি কারিগরদের। চলতি বছর ঈদকে ঘিরে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দিনরাত জামদানি তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন এখানকার জামদানি তাঁতীরা। পাশাপাশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন জামদানি পল্লীর নারীরাও।

জামদানি শিল্পীরা জানান, এ জামদানি শাড়ী এ সময় রাজা-বাদশাহ কিংবা জমিদার পরিবারের নারীরা পড়তেন। আর এখন পরেন ধনী ও অভিজাত রমণীরা। এ রমণীরা অনেকেই জানেন না তাদের পরিধেয় এই শাড়িটির ভাঁজে-ভাঁজে রয়েছে কত দুঃখ, বেদনা আর বঞ্চনার ইতিহাস। প্রতিটি সুতার ফাঁকে-ফাঁকে রয়েছে শিল্পীদের ঘাম, কষ্ট, বেদনার কাহিনী। তবুও এই অসহায়-অশিক্ষিত দরিদ্র তাঁতীদের জীবনের কথা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শাড়িগুলো তৈরি করে তাদের পরিবারের ভাগ্যে এক চিলতে সস্তা শাড়িও জোটে না। তারা দিনের পর দিন স্বপ্ন দেখে এই তাঁত শিল্প একদিন সমৃদ্ধ হবে। তাদের নিত্যদিনের অভাব-অনটন দূর হবে। কিন্তু সুখী জীবনের প্রত্যাশার প্রহর তাদের আর শেষ হয় না। স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝে বিরাট পার্থক্য, এদের স্বপ্ন যেন স্বপ্নই থেকে যাবে।

জামদানি শাড়ির কারিগর ফারুক মিয়া বলেন, নিজ বাড়িতে বসে স্বাধীনভাবে শাড়ি তৈরির কাজ করা যায় বলে জামদানি শাড়ি তৈরিতে অনেকে আগ্রহী। জামদানি পল্লীতে কাজ শেখারও সুযোগ রয়েছে। তাই অনেক বেকার যুবকরা কাজ শিখে এখানেই শাড়ি তৈরির কাজে যোগ দিচ্ছে। এতে এলাকার বেকার সমস্যা কমেছে।

অপর এক কারিগর লিটন মিয়া বলেন, ‘বর্তমান বাজারে এই কাজ করে যে মজুরি পাওয়া যায়, তা খুব একটা বেশি নয়। তাঁত মালিকদের তেমন পুঁজি না থাকায় এবং সূতা ও রঙের দাম বেশি হওয়ার কারণে আমাদের মজুরি কম।’ কিন্তু আমাদের লাভ একটাই ছায়াতে বসে বসে কাজ করা যায়। যে কোন সময় নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করা যায়।

তাঁত মালিক দুলাল মিয়া বলেন, ‘আমরা পুঁজির অভাবে চাহিদা অনুযায়ী শাড়ি তৈরি করতে পারি না। এরপরও পাইকারী ব্যবসায়ীদের ও ব্যক্তিগতভাবে সৌখিন ক্রেতাদের অর্ডার পাওয়ায় ব্যবসা টিকে আছে। স্বল্প সুদে প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা পাওয়া গেলে স্থানীয়ভাবে বেকার সমস্যা সমাধানসহ এ শিল্পের প্রসার ঘটানো যাবে। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাদের ঋণ দিতে নানা অজুহাত দেখিয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করে।’

দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাদিউল ইসলাম বলেন,‘এই জামদানি পল্লী নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। আমাদের ঐতিহ্যবাহী এ জামদানি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় ঋণ সহযোগিতার বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের উন্নয়ন সমন্বয় সভায় একাধিকবার আলোচনা হয়েছে।’

নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজর প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ঐতিহ্যবাহি এ জামদানী শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার প্রদান করা হবে।

মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ বলেন, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই শিল্পটি এখন হুমকির সম্মুখীন। জামদানি শিল্পের কল্যাণে সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই করা যায়নি। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রায়ত্ব তফসিলী ব্যাংকের মাধ্যমে সহজশর্তে ঋণ সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় একটি বাড়ী একটি খামার, বিআরটি সহ সরকারী বিভিন্ন খাত তাদের সহায়তা অব্যহত থাকবে। সেই সাথে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকারী সকল ধরণের সহয়তার প্রয়াস ব্যক্ত করেন তিনি।

(এসএইচআর/এসএএম/ ২২ মে ২০১৮)


Comment As:

Comment (0)