Copy Right

লাভবান হবে গানের সব পক্ষ

বিনিয়োগবার্তা ডেস্ক, ঢাকা: আশি ও নব্বই—এই দুই দশককে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের গানের বাজারের সবচেয়ে রমরমা যুগ। বছরজুড়েই প্রকাশ হতো নতুন নতুন গানের অ্যালবাম। সে সময় এককালীন কিছু টাকা দিয়ে গানের চিরস্থায়ী মালিক হওয়ার অলিখিত নিয়ম চালু ছিল। চলচ্চিত্রের গানেও ছিল প্রযোজকের স্থায়ী অধিকার। দেখা যেত, প্রযোজকেরা শিল্পীদের অ্যালবামের গানগুলো নিজের মতো করে নানা উপায়ে বারবার বাজারে ছাড়ছেন।

জমিজমার মতো মেধাস্বত্বও যে একধরনের সম্পত্তি, এই সম্পত্তি রক্ষার জন্য যে নিবন্ধন প্রয়োজন আর শিল্পকর্মের স্রষ্টা বা উদ্ভাবক তাঁর জীবনকাল ও মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত এর মালিকানা দাবি করতে পারেন - এসব বিষয়ে একটা সময় পর্যন্ত খুবই উদাসীন ছিল শিল্পীসমাজ। গান প্রকাশে ডিজিটাল মাধ্যম যত শক্তিশালী হতে থাকে, তত আস্তে আস্তে এসব বিষয়ে সচেতন হতে থাকেন শিল্পীরা। ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডির আমলে প্রকাশিত অ্যালবামের গান অনুমতি ছাড়াই ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। 

গীতিকার ও সুরকারেরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। শিল্পীরা বলতে থাকেন, রয়্যালটি দিচ্ছে না প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। একপর্যায়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অডিও প্রযোজকের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করতে বাধ্য হন শিল্পীরা। তাঁদের করা মামলায় অডিও প্রযোজকের কারাবরণের মতো ঘটনাও ঘটেছে। ঘটেছে আরও নানা অপ্রীতিকর ঘটনা।

এই যখন অবস্থা, তখন কপিরাইট অফিসের নতুন একটি সিদ্ধান্ত গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের মধ্যে স্বস্তি এনেছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী পুরোনো গানের ক্ষেত্রে গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সমান হারে রয়্যালটি পাবে।

গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পীরা এটিকে যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে দেখছেন। দেশের গান প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও কপিরাইট বোর্ডের এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছে।
কপিরাইট নিবন্ধন কর্মকর্তা জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে এক দশক আগে ইউটিউবে গান প্রকাশ শুরু হয়। দিনকে দিন তা বাড়তে থাকে। 

তখনই গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পীরা আপত্তি তোলেন, এক মাধ্যমে চুক্তি করে অন্য সব মাধ্যমে ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁদের সৃষ্টিকর্ম। বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় সংগীতের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলা হয়। তবে নতুন গানের ক্ষেত্রে চুক্তিতে যেভাবে উল্লেখ থাকবে, রয়্যালটি সেভাবেই হবে। আর নতুন গানের ক্ষেত্রে কেউ যদি চুক্তি না করেন, তাহলে পুরোনো নিয়মই সবাইকে মেনে চলতে হবে।

মেধাস্বত্ব নিয়ে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীরা দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে এলেও ২০১৯ সালে প্রথম এটি আমলে নেয় বাংলাদেশ কপিরাইট বোর্ড। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতার বিরুদ্ধে মনির খান, এস ডি রুবেল, নাসির, সেলিম চৌধুরী প্রমুখ আট শিল্পী অভিযোগ করেন, তাঁরা শুধু ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডির ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি। তারপরও ডিজিটাল মিডিয়ায় তাঁদের গান নিয়ে ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর সংগীতাকে নোটিশ করে কপিরাইট বোর্ড। যাবতীয় কাগজপত্র দেখার পর কপিরাইট নিবন্ধন কর্মকর্তা জাফর রাজা দেখতে পান, শিল্পীদের অভিযোগই সত্যি। এরপর উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্দোবস্ত হয় বলে জানান তিনি।

জাফর রাজার যুক্তি ছিল, যেহেতু পুরোনো গান, নতুন করে কেন বিনিয়োগ করা হয়নি এবং এসব ডিজিটাল মাধ্যম যেহেতু নতুন আয়ের রাস্তা, তাই একটা গানের আয় থেকে গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সমান হারে পাবেন। উপস্থিত শিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও একবাক্যে এ প্রস্তাব মেনে নেন। এরপর গানের রয়্যালটি নিয়ে গীতিকবি সংঘ, মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটি, সিঙ্গার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলও একাধিকবার কপিরাইট বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে।

সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের মহাসচিব কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘সংগঠিত হতে পারিনি বলেই আমরা এত বছর বঞ্চিত হয়েছি। যখনই সংগঠিত হতে চেয়েছি, আশপাশ থেকে শুনেছি, কী হবে, কোনো লাভ নেই। আবারও প্রমাণিত হলো, কোনো একটা যৌক্তিক বিষয়ে একত্র হয়ে চাইতে পারলে কেউই বঞ্চিত করতে পারে না। সংগীতাঙ্গনে এক দশকের বেশি সময়ের দাবি এবং অমীমাংসিত একটা সমস্যার সমাধান হলো।’

মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটির সভাপতি ও সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের মহাসচিব নকীব খান বলেন, ‘এই প্রক্রিয়াতে অনেকের লাভ হবে। সবাই সুন্দর একটা সিস্টেমের মধ্য থাকবেন। এটা যৌক্তিক হয়েছে বলে মনে করি।’

গীতিকবি সংঘের সাধারণ সম্পাদক (যুগ্ম) আসিফ ইকবাল কপিরাইট অফিসের এ সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী আখ্যায়িত করে বলেন, গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীরা সারা জীবন বঞ্চিত হয়ে আসছিলেন। এ ঘটনায় বঞ্চনার জায়গায় একটা প্রাপ্তির সম্ভাবনা যোগ হয়েছে।

কপিরাইট বোর্ডের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব শেখ শাহেদ আলী বলেন, ইন্ডাস্ট্রি যদি একত্র হয়ে কাজ করে, সবার জন্যই মঙ্গলজনক। মামলা–মোকদ্দমা ও নানা অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ করতেও অনেকে ভয় পান। সবার আন্তরিকতায় একটা সুন্দর উদাহরণ তৈরি হোক। 

(ডিএফই/০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১)


Comment As:

Comment (0)