লন্ডনে বাংলাদেশী মৌসুমী ফল ও সবজীর ব্যাপক চাহিদা
লন্ডন (যুক্তরাজ্য) থেকে শামীম আল মাসুদ: যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সবজী ও মৌসুমী ফলের ব্যাপক চাহিদা দেখা দিয়েছে। ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ এ বাজারে বাংলাদেশের আম, কাঠাল, লিচু, লটকন, আনারসসহ নানা ফল ব্যাপকভাবে সমাদৃত। একইভাবে দেশে উৎপাদিত সবজী যেমন: ফুলকপি, বাধাকপি, টমাটো, লেবু, কাঁচামরিচ, ধনেপাতাসহ অনান্য সবজীর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। যথাযত প্রক্রিয়ায় কেমিক্যালমুক্ত ভাল মানের ফল ও সবজী রপ্তানী করে যুক্তরাজ্য থেকে প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে বাংলাদেশ।
লন্ডনের বিভিন্ন সুপার মার্কেট পরিদর্শনে এমন সম্ভাবনার চিত্র উঠে এসেছে।
সরেজমিনে সেন্ট্রাল লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপলে গিয়ে দেখা যায়, এখানকার অধিকাংশ গ্রোসারিজ শপগুলোতে অনান্য দেশের সবজী-ফলের পাশাপাশি বাংলাদেশি কৃষি পণ্যও সাজিয়ে রাখা রয়েছে। লন্ডনের এ অঞ্চলটিতে বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের বসবাস সবেচেয়ে বেশি। তাই দেশীয় পণ্যের চাহিদাও এখানে বেশি। ডিসপ্লে করার পর মূহুর্তেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এসব পণ্য। বাঙ্গালীদের পাশাপাশি অনান্য দেশের মানুষও এসব পণ্য কিনতে হুরমুর খেয়ে পড়ছে। আর চাহিদা বেশি থাকায় পণ্যগুলোর দাম পাওয়া যাচ্ছে বেশ।
এ অঞ্চলের বিভিন্ন সুপার শপ ঘুরে দেখা গেছে, কাঠালের মূল্য প্রতিকেজি ৬-৮ পাউন্ড দরে বিক্রি হচ্ছে। এ হিসেবে পাঁচ কেজি ওজনের একটি কাঠালের মূল্য ৪০ পাউন্ড। প্রতি পাউন্ড ১১৫ টাকা হিসেবে ৫ কেজি ওজনের একেকটি কাঠালের মূল্য দাড়ায় ৪ হাজার ৬০০ টাকা। আর রাজশাহী অঞ্চলের দুই কেজি ওজনের প্রতিবক্স হিমসাগড় আম ১২-১৪ পাউন্ডে বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে লিচু, লটকনসহ অনান্য ফল বেশ লাভে বিক্রি করা হচ্ছে দোকানগুলোতে।
এদিকে প্রতিকেজি কাঁচামরিচ ২৪-২৫ পাউন্ডে বিক্রি হয়। প্রতি পিচ ফুলকপি/বাধাকপি এখানে এক-দেড় পাউন্ডে বিক্রি করা হয়। আবার প্রতিকেজি বেগুন ৪-৫ পাউন্ডে বিক্রি করা হয়। এছাড়া প্রতি পিচ কলন্বো লেবু ২-৩ পাউন্ডে বিক্রি করা হয়, যেখানে বাংলদেশে প্রতি হালি (৪ পিচ) ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এগুলো এখানে নিয়ে আসা হয়। এখানে বাংলাদেশি কৃষি পণ্য সরবরাহের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বড় বড় সুপার শপের সাপ্লাই চেইনগুলোতে বাংলাদেশি পণ্য সরবরাহের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
এনফিল্ড টাউনের আসদা সুপার শপের বিক্রয় কর্মী নিকোলি জানান, এখানে মাঝে মাঝেই গ্রাহকরা বাংলাদেশে উৎপাদিত সবজীর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সরবারহের পর্যাপ্ততা না থাকায় তাদের পক্ষে তা গ্রাহককে দেওয়া সম্ভব হয় না।
হোয়াইটচ্যাপলের অন্যতম বৃহত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হাট-বাজার সুপার শপের বিক্রয়কর্মী সাইফুল ইসলাম জানান, এখানে বাংলাদেশি সবজী ও ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরবরাহের পর্যাপ্ততা নেই। যথাযত মাধ্যমে পরিবহন খরচ কমিয়ে বাংলাদেশ থেকে কেমিক্যালমুক্ত সবজী ও ফল রপ্তানী করে এখানকার বাজার দখল করতে পারে বাংলাদেশ।
ইয়োরোপেজেস ডট কো ডট ইউকে‘র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য প্রতি বছর ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন পাউন্ডের ফলমূল ও সবজী আমদানী করে থাকে। যার প্রায় ৪৬ শতাংশই আসে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমান সবজী ও ফল আসে ফ্রাঞ্চ, জার্মানী, স্পেন, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ইটালী থেকে। এছাড়া ব্রাজিল, পেরু, কেনিয়া, উগান্ডা ও পাকিস্তান থেকে আসে নানা জাতের ফলমূল। এ তালিকায় বাংলাদেশের নামও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। তবে বাংলাদেশ থেকে কি পরিমান সবজী ও ফলমূল আসে তা তুলে ধরা হয়নি।
যুক্তরাজ্যের দ্য ডিপার্টমেন্ট অব এ্যানভায়রনমেন্ট, ফুড এন্ড রুরাল এ্যাফেয়ার্স (ডেফরা) এর এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশটিতে যে পরিমান সবজী ও ফলমূল আমদানী করা হয় তার মধ্যে স্পেন থেকে ১৯ শতাংশ, নেদারল্যান্ড থেকে ১১ শতাংশ, ৫ শতাংশ সাউথ আফ্রিকা, আর বাকিগুলো অনান্য দেশ থেকে আমদানী করা হয়।
জানতে চাইলে ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিবিসিসিআই)‘র প্রেসিডেন্ট বশির আহমেদ বিনিয়োগবার্তা‘কে বলেন, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৭ লক্ষাধিক বাংলাদেশির বসবাস। তাদের কাছে বাংলাদেশি পণ্য অন্যতম পছন্দের জিনিস। এছাড়া স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় অনান্য জাতির কাছেও এসব পণ্যের কদর বেশ। এ বাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত সবজী ও মৌসুমী ফলের বাজার দখলের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। তবে তা অবশ্যই কেমিক্যালমুক্ত হতে হবে।
তিনি বলেন, পণ্য পরিবহনে বিমান বা কার্গো ভাড়াসহ আনুসঙ্গিক খরচ অনেক বেশি। আর এ কারনে আমদানীকারকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যথাযত ব্যবস্থা গ্রহণ করে যদি পরিবহন খরচ কমানো এবং কেমিক্যালমুক্ত কৃষিপণ্য এখানে আনা যায়, তাহলে যুক্তরাজ্যের এ বাজারটি থেকে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
তিনি জানান, পণ্য পরিবহনে খরচ কমানো এবং কেমিক্যালমুক্ত ফলমূল ও সবজী আমদানীর লক্ষ্যে আমরা সরকারের কৃষি মন্ত্রনালয় ও বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। তারা বিষয়টি নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছে বলে আমাদেরকে জানিয়েছেন। আশা করছি, অচিরেই যুক্তরাজ্যে আরও অধিক পরিমানে সবজী ও মৌসুমী ফল আমদানীর পথ প্রশস্ত হবে।
ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বারের এই প্রেসিডেন্ট বলেন, আসলে দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি পোশাক বা আরএমজি রপ্তানীর ওপর আমাদের দেশিক বাণিজ্য নির্ভরশীল। এ খাতটিতে এখন প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। ফলে এখন সময় এসেছে বিজনেস ডাইভারসিফিকেশন নিয়ে ভাবার। আর আগামীতে আমরা এগ্রিকালচার ও আইটি সেক্টরকে ব্যাপক সম্ভাবনাময় সেক্টর হিসাবে দেখছি। আমরা বিবিসিসিআইর পক্ষ থেকে গত দুই বছর ধরে এগ্রিকালচার সেক্টর ও আইটি নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে কৃষিপণ্যের ব্যাপক চাহিদা পূরনে এগিয়ে আসতে পারে বাংলাদেশ।
বশির আহমেদ বলেন, কৃষিপণ্যগুলো বাংলাদেশ থেকে যেমন আমদানী করা যেতে পারে, তেমনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে জমি লীজ নিয়ে এবং বাংলাদেশ থেকে দক্ষ লোকবল আমদানী করেও এখানে চাষাবাদ করা যেতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পেরিশেবল প্রোডাক্টগুলোকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা হলে এখানকার বাজার দখলে আনার দারুন সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের সাথে বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সরকার ও এক্সপোর্টারদের জন্য আমরা অনেক গবেষণাভিত্তিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে আসছি। এতে সরকার ও ব্যবসায়িরা অনেক উপকৃত হচ্ছেন। যেমন: বাংলাদেশের সরকার ও উদ্যোক্তাদের আগে গ্লোবাল গ্যাপ প্রসেসটা সম্বন্ধে বেশি জানা ছিল না, আমরা এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। কৃষকরা যাতে গ্লোবাল গ্যাপের আন্ডারে এগ্রিকালচার প্রসেস, সেইফ ফুড প্রসেস বা ডেফরা প্রসেস সম্পর্কে ধারনা নিয়ে তাদের পণ্য উতপাদন ও বাজারজাত করতে পারে-সে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। যুক্তরাজ্যের রেগুলেটরি অবলিগেশনকে প্রাধান্য দিয়ে যদি আমরা আমাদের পেরিশেবল প্রোডাক্ট, ফ্রুটস, ভেজিটেবল প্রডিউস করি তাহলে আমাদের জন্য এখানকার বাজার দখলে নেওয়া খুব সহজ হবে। এই সেইফ ফুডটাকে এখানে সুপারমার্কেট চেইনগুলোতে আমরা প্রবেশ করতে পারবো এবং একটা বড় বাজার আমাদের দখলে চলে আসবে। এসব বিষয়ে সরকারকে আমরা আমাদের সুপারিশমালা দিয়েছি। এছাড়া বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সার্বিক বাণিজ্য-বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি নিয়ে আরও গভীরভাবে কাজ চলছে।
জানতে চাইলে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ট্রেড এন্ড কমার্স শাখার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা না প্রকাশ না করার শর্তে বিনিয়োগবার্তাকে বলেন, যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশি কৃষিপণ্য রপ্তানী বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনকেদিন ধরেই আলাপ আলোচনা চলছে। কিভাবে এখানে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে খরচ আরও কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়েও কাজ চলছে।
তিনি বলেন, গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে আমরা কেন শুধু একটি প্রোডাক্ট নিয়ে বসে থাকবো। এখানে অনান্য পণ্য ও সেবা নিয়েও কাজের সুযোগ রয়েছে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি কৃষি পণ্য রপ্তানী করেও এখান থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//