সংসদীয় কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন
রেলওয়েকে লোকসান থেকে বের করে আনতে একগুচ্ছ প্রস্তাবনা
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকসান কমাতে সংসদীয় কমিটিতে দেয়া দুটি প্রতিবেদনে ভাড়া বাড়ানোসহ বেশকিছু প্রস্তাব ও সুপারিশ তুলে ধরেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে সড়ক, নৌ ও আকাশপথের সঙ্গে সমন্বয় করে যৌক্তিকভাবে ভাড়া নির্ধারণের বিষয়েও জোর দেয়া হয়েছে। রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের করা প্রতিবেদনে ট্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণসহ আয় বাড়াতে তুলে ধরা হয়েছে একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সুপারিশের ভিত্তিতেই প্রতিবেদনটি তৈরি করে মন্ত্রণালয়। একই সুপারিশের ভিত্তিতে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের করা প্রতিবেদনে ট্রেন ও আসন সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। রেলের ঘাটতি পূরণে বেশকিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ভাড়া বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে অভিমত তাদের। ট্রেন পরিচালনায় খরচের বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। আছে আর্থসামাজিক ও পারিপার্শ্বিক বিষয়েও বিবেচনায় নেয়ার সুপারিশ। এক্ষেত্রে অবশ্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হতে পারে। ট্রেন পরিচালনার সুবিধা বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধির সুপারিশে বলা হয়েছে, সব মূল পথকে ডাবল করা হলে সেকশনাল ক্যাপাসিটি বাড়বে। এতে অধিকসংখ্যক ট্রেন পরিচালনা করেও আয় বাড়ানো সম্ভব। কারণ দেশে ট্রেনের রয়েছে প্রচুর চাহিদা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-জয়দেবপুর সেকশনটি সবচেয়ে জটিল। এখানে প্রায় ২৫টি স্বীকৃত ও ২০টি অস্বীকৃত এলসি (লেভেল ক্রসিং) গেট রয়েছে। এ কারণে পথটিতে ট্রেনের গতি প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ৩০ কিলোমিটার। তাই সেখানকার লাইন আন্ডারগ্রাউন্ড কিংবা কভার বা ওপেন এবং এলসি গেটের রোড অংশ ব্রিজের মতো করলে ট্রেনের গতি কমপক্ষে ৮০ কিলোমিটার করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে বাড়বে সেকশনাল ক্যাপাসিটিও। অধিক ট্রেন পরিচালনা করে বাড়ানো যাবে রেলের আয়। অন্যদিকে সড়কপথ খোলা রাখা যাবে ২৪ ঘণ্টা, যা ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আবার ঢাকা স্টেশনের দুদিকের লাইন খোলাও জরুরি, যাতে দুদিক দিয়েই ট্রেন সান্টিং (ইঞ্জিন ও বগির স্থান পরিবর্তন) করা যায়। এতে ট্রেন স্থাপন, ওয়াশপিট সুবিধা দ্রুত করা সম্ভব হবে। ফলে ট্রেনের সময়ানুবর্তিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং বাড়বে আয়।
প্রতিবেদনেট্রেনে অধিকসংখ্যক কোচ সংযোজন করে আয় বাড়ানো সম্ভব বলেও মত প্রকাশ করা হয়েছে। সুপারিশ করা হয়েছে চাহিদানুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ রুটে ট্রেন সংখ্যা বাড়ানোর। ব্যক্তিস্বার্থে অগুরুত্বপূর্ণ রুটে ট্রেন পরিচালনা পরিহারের কথাও বলা হয়েছে।
পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা বাড়ানোর সুপারিশ করে প্রতিবেদনে জানানো হয়, একটি পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা করলে খরচের তিন গুণ আয় হয়। অন্যদিকে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনায় খরচ তুলে আনাই কঠিন। তাই পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক লোকোমাস্টার বা ট্রেনচালক, লোকোমোটিভ সরবরাহ নিশ্চিতের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিভিন্ন উৎসবে বিশেষ করে দুই ঈদে যাত্রীর চাপ অনেক বেড়ে যায়। সেই চাপ সামলাতে গিয়ে ট্রেনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অর্থাৎ ধারণক্ষমতার চেয়ে অধিকসংখ্যক যাত্রী পরিবহন করায় তখন কোচগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে, যা লোকসানের অন্যতম কারণ। এক্ষেত্রে বিমানের সিস্টেমে অর্থাৎ চাহিদা বাড়লে ভাড়া বাড়ানো এবং চাহিদা কম থাকলে কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে রেল মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে। সেই সঙ্গে ভারতীয় রেলওয়ের উদাহরণ টেনে কিছু টিকিট রিজার্ভ রাখার কথাও বলা হয়েছে, যাতে যাত্রীরা জরুরি প্রয়োজনে ট্রেন ভ্রমণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে অবশ্য বেশি ভাড়া দিয়ে সেই টিকিট কিনতে হবে। এতে রেলের আয়ও বাড়বে।
বাংলাদেশের রেল ব্যবস্থাপনা দুর্বল বা সেকেলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্থাটি চলছে একেবারেই গতানুগতিকভাবে। তাই এ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন জরুরি। যদিও রেলের সংস্কারকাজে বিভিন্ন সময় নানা প্রকল্প নেয়া হয়। কিন্তু পরে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। এখন আর নতুন কোনো সংস্কার প্রকল্প না নিয়ে বরং ভারতীয় রেলওয়ের মতো অবিকল ব্যবস্থাপনা চালু করা গেলে বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন সম্ভব বলে প্রতিবেদনটির মাধ্যমে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। কেননা প্রতিবেশী দেশটির আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট প্রায় বাংলাদেশের মতোই। তাই ভারতের রেলওয়ের ‘উন্নত’ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা যেতে পারে। জনবল কাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমেও আয় বাড়ানোর কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
দেশের প্রতিটি রেল স্টেশনকে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র বা বিজনেস হাব করা সম্ভব উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে স্টেশনগুলো বহুতল ভবন করা যেতে পারে। যেখানে ট্রেনের অপারেশনাল প্রয়োজনের বাইরের অংশে মার্কেট কিংবা বিজনেস সেন্টার খুলে বাড়তি আয় নিশ্চিত করা সম্ভব। অনেক দেশই এ ব্যবস্থা অবলম্বন করছে। ট্রেন, স্টেশন ও রেলভূমিতে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচারের সুবিধা দিয়েও প্রচুর আয় করা যেতে পারে। জাপান রেলওয়ের প্রায় ১৭ শতাংশ আয়ই বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে আসে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রেলভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও আয় বাড়ানোর কথা। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ শহরে রেলভূমিতে প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে (পিপিপি) বহুতল মার্কেট, বাণিজ্য কেন্দ্র, আবাসিক হোটেল, পর্যটন এলাকা ইত্যাদি স্থাপনের মাধ্যমে প্রচুর আয় করা সম্ভব।
এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, রেলের আয় বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে। এজন্য সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//