প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী
বেসরকারি খাতের জন্য আগামী বাজেট হবে উৎসাহব্যঞ্জক
নিজস্ব প্রতিবেদক: অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘দেশের বেসরকারি খাতের জন্য আগামী বাজেট হবে উৎসাহব্যঞ্জক।’
রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রোববার এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং দৈনিক সমকাল ও চ্যানেল ২৪ যৌথভাবে এর আয়োজন করে। এতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আগামী বাজেটের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
‘প্রাক-বাজেট আলোচনা: প্রেক্ষিত বেসরকারি খাত’ শীর্ষক এ আলোচনায় অংশ নিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘দেশের বেসরকারি খাত অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগামী বাজেটে তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো বিবেচনা করা হবে।’
আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি বাজার পর্যবেক্ষণে এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শিগগিরই এর সুফল আসবে। এছাড়া আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কার, দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নির্ধারণ, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, পণ্যের বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ সম্পদের সুষম ব্যবহার প্রভৃতি বিষয় আগামী বাজেটে প্রাধান্য পাবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের উন্নয়নে যার যার অবস্থান থেকে অবদান রাখা যায়। দায়িত্ব পালন করা যায়। ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য নয়, সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিধারা অব্যাহত রাখতে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে করজাল সম্প্রসারণ এবং কর ব্যবস্থাপনার সহজীকরণ করা আবশ্যক। এছাড়া একটি টেকসই আর্থিক খাতের জন্য বেশকিছু আইন ও নীতি সংস্কারের পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমানো, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, রিজার্ভের ঘাটতি কমানো, ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি ও তারল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি।’
শিল্প খাতে সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতের ওপরও জোর দেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি। শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারে উৎপাদন বৃদ্ধি ও রফতানি আয় বাড়াতে পণ্য, সেবা ও বাজার বহুমুখীকরণের তাগিদ দেন তিনি। আহ্বান জানান শিল্প খাতে কমপ্লায়েন্স, সম্ভাবনাময় পণ্য ও বাজার সম্পর্কিত গবেষণা এবং উদ্ভাবনী কার্যক্রমে নীতি ও প্রণোদনা সহায়তার।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ এমপি বলেন, ‘একটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা নিয়ে গেল একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। বাংলাদেশ ব্যাংক তা জানে না। ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরে তদন্ত করে এ ঘটনা বের করেছে। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতায়ন ঘাটতির কারণে এসব হচ্ছে।’
যারা ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বাইরে চলে গেলেন এবং বিনিয়োগ করলেন না, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে; সে প্রশ্ন তোলেন এ কে আজাদ। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে এখন ১৪ শতাংশ গুনতে হচ্ছে। বাড়তি সুদের কারণে অনেকে খেলাপি হয়ে পড়বেন; এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ৫ শতাংশ অতিরিক্ত সুদের দায়িত্ব এখন কে নেবে? এর জন্য ব্যবসায়ীদের তো কোনো প্রস্তুতি ছিল না।’
ডলার সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডলারের সরকারি দর ১১০ টাকা। অথচ আমদানিতে কিনতে হচ্ছে ১২৪ টাকা দরে। এদিকে শুল্ক কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন করছে ১২৪ টাকা ধরে। সরকারি অন্যান্য সংস্থা ডলারের দর ১১০ টাকা ধরে হিসাব করছে।’
অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকর্ষণে দীর্ঘমেয়াদি নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে।’ রাজস্ব কাঠামোর সংস্কার ও সহজীকরণ এবং শিল্প খাতে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতের ওপর জোর দেন তিনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘আমরা কর জিডিপির অপবাদ দ্রুত দূর করতে চাই। সরকারকে কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও করভার লাঘবের মধ্যে সমন্বয় করতে হয়। এরই মধ্যে কর প্রদানের প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০২০ সালে ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতার সংখ্যা ছিল ২১ লাখ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ সংখ্যা ৩৭ লাখে উন্নীত হয়েছে। কর আহরণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সহযোগিতা দেয়াই এনবিআরের মূল লক্ষ্য।’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে বেসরকারি খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। তাই আমাদের উদ্যোক্তাদের বিকাশে সর্বাত্মক নীতি সহায়তা অব্যাহত থাকবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনয়ন এবং খেলাপি ঋণ হ্রাস প্রভৃতি বিষয়ের ওপর অধিক জোর দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলী জওহর রিজভী বলেন, ‘আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পলিসি দিয়ে দেশ চলবে না।’ নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বন্ডের আওতায় থাকার পরও কেন রিটার্ন দাখিল করতে হবে? এটা থেকে আমরা রেহাই চাই।’ ইটিবিএল হোল্ডিংস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘অটোমেশন জরুরি, কিন্তু এনবিআর সেটা এখনো করতে পারেনি। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম বলেন, ‘মার্জার নিয়ে এনবিআরের বাজেটে এবার একটা কিছু থাকতে হবে।’
আলোচনা অনুষ্ঠানের চারটি সেশনে নির্ধারিত আলোচনায় অংশ নেন ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের হেড অব ট্যাক্সেশন সাঈদ আহমেদ খান, শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আরিফ খান, শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহামুদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এম মাশরুর রিয়াজ, কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম, এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন, আইসিএবির সিইও শুভাশীষ বোস প্রমুখ।
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//