এবার সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে বেসিক ব্যাংক
নিজস্ব প্রতিবেদক: বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে সরকারি রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিনের বৈঠকে বেসিক ব্যাংককে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে মার্জার-অ্যাকুইজিশন নিয়ে অনেক আলোচনাই হচ্ছে। আমরাও এর বাইরে নই। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিকল্পগুলো নিয়ে আমরা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করছি। নির্দিষ্ট কোনো দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে আমি জ্ঞাত নই। তবে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে যদি কোনো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়, সেক্ষেত্রে সিটি ব্যাংক প্রস্তুত রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সিটি ব্যাংক দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংক। আমাদের ব্যাংকের পর্ষদে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) অংশগ্রহণ রয়েছে। আবার পুঁজিবাজারেও সিটি ব্যাংক তালিকাভুক্ত। দুর্বল কোনো ব্যাংক একীভূত করতে হলে আমাদের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অনুমোদন নিতে হবে।’
দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিটি ব্যাংকের অবস্থান সামনের সারিতে। ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডার ইকুইটি এখন ৩ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকটিতে গ্রাহকদের ৩৯ হাজার ২৫৯ কোটি টাকার আমানত জমা ছিল। একই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণস্থিতি ছিল ৩৯ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সিটি ব্যাংক এখন ৫৬ হাজার ৪৯২ কোটি টাকার সম্পদ ও দায়যুক্ত ব্যাংক।
সিটি ব্যাংক ২০২৩ সালে ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। এর মধ্যে ৬৩৮ কোটি টাকা নিট মুনাফায় নিতে পেরেছে ব্যাংকটি। গত ৩১ ডিসেম্বর শেষে সিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তবে একই সময়ে ২ হাজার ৬১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছিল সিটি। ১৯৮৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংকটির শাখা রয়েছে ১৩৩টি। বর্তমানে ব্যাংকটিতে ৪ হাজার ৮৬৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। ব্যাংকটির গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ।
দেশের ব্যাংক খাতে মার্জার-অ্যাকুইজিশন নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে ছয় মাস ধরেই। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে ৪৫-এ নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত মাসে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চুক্তি করে পদ্মা ব্যাংক। এরপর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার এ তালিকায় সিটি ও বেসিক ব্যাংকের নাম যুক্ত হলো। চলতি মাসের মধ্যেই আরো পাঁচ-সাতটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত হওয়ার ঘোষণা আসতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দেয়ার জন্য প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে কোনো আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই জানানো হবে।’
সিটির সঙ্গে একীভূত হতে যাওয়া বেসিক ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ২০১৩ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসান দিয়ে যাচ্ছে সরকারি খাতের ব্যাংকটি। দশ বছরে বেসিকের ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি ব্যাংকটি। সেটি হলে এ লোকসানের পরিমাণ আরো বড় হবে।
যদিও একসময় বেসিক ব্যাংক পরিচিতি পেয়েছিল সরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভালো ও লাভজনক উদাহরণ হিসেবে। বৈশ্বিক জায়ান্ট স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হতো ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটিকে। প্রতিষ্ঠার পর দুই দশক ধারাবাহিকভাবে মুনাফা করে আসছিল বেসিক ব্যাংক। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাও ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকের চেয়ে বেশি। সরকারি অন্য ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণে জর্জরিত হলেও এ সংকট থেকে একপ্রকার মুক্ত ছিল বেসিক ব্যাংক।
যদিও একপর্যায়ে ব্যাংকটিতে ব্যাপক লুটপাট ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০১৩ সালে এসে প্রথমবারের মতো লোকসানের দেখা পায় ব্যাংকটি। ২০১৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটিতে লোকসানের পরিমাণ শতকোটি টাকা ছাড়ায়। এর পর থেকে ব্যাংকটির লোকসানের পাল্লা কেবল ভারীই হয়েছে।
নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে বেসিক ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে ৪ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংকটিকে বাঁচানোর জন্য বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে সরকার। বিপুল অংকের এ অর্থ পেয়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেসিক ব্যাংক। উল্টো ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকায়। বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ৫৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ এখনো খেলাপি।
বেসিক ব্যাংকের ২০২২ সাল শেষে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১৩ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির খাতায় ছিল ৭ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। আদায় অযোগ্য হওয়ায় আরো ২ হাজার ৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে ব্যাংকটি। এ বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা সঞ্চিতিও সংরক্ষণ করতে পারছে না এখন বেসিক ব্যাংক। ব্যাংকটির সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণও ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার বেশি।
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//