ইলিশ প্রজননকে নিরাপদ করতে ২২ দিন সমুদ্রে মাছ শিকার নিষিদ্ধ
নিজস্ব প্রতিবেদক: ইলিশ প্রজননকে নিরাপদ করতে ২২ দিন সমুদ্রে মাছ শিকার নিষিদ্ধ। গতকাল চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাটে জেলেদের নৌযানে থাকা জাল ও সরঞ্জাম নামিয়ে আনতে দেখা যায় ছবি: আজীজ অনন
নিরাপদ প্রজননের জন্য আজ মধ্যরাত থেকে সাগর-নদীতে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ হচ্ছে। চলবে ৩ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত। এই ২২ দিন ইলিশ ধরা, পরিবহন, বাজারজাত, মজুদ, ক্রয়-বিক্রয়, বিপণন ও বিনিময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নিরাপদ প্রজননের জন্য আজ মধ্যরাত থেকে সাগর-নদীতে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ হচ্ছে। চলবে ৩ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত। এই ২২ দিন ইলিশ ধরা, পরিবহন, বাজারজাত, মজুদ, ক্রয়-বিক্রয়, বিপণন ও বিনিময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গতকাল এ নির্দেশনা দিয়েছে।
আশ্বিন মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমাকে ভিত্তি করে মা ইলিশ ডিম ছাড়ার লক্ষ্যে সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পদ্মা-মেঘনা নদীতে ছুটে আসে। প্রতি বছর এ সময় বিবেচনা করে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকার। নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করলে এক বছর থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানাসহ উভয় দণ্ড হতে পারে।
এ বিষয়ে বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস জানান, ইলিশ সারা বছর ডিম দেয়। তবে ৮০ ভাগ ইলিশের পেটে ডিম আসে আশ্বিন মাসে। ইলিশ শুধু মিঠাপানিতে ডিম ছাড়ে। তাই এ মাসে ডিম ছাড়ার জন্য ইলিশ সাগরের নোনা পানি ছেড়ে মিঠাপানির নদীমুখী হয়। পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইলিশের ঝাঁক নদীতে চলে আসে। তাই মা ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করার জন্য প্রতি বছর আশ্বিনে পূর্ণিমা ও অমাবস্যা মাঝে রেখে ২২ দিন ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এবার প্রথম নিষেধাজ্ঞা পালিত হবে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর উপকূলে ইলিশ ক্ষেত্রগুলোয় রাজনৈতিক হাতবদল হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপন করায় মাছঘাট ও মোকামের নিয়ন্ত্রক এখন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। যে কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা প্রশাসনের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হবে বলে স্থানীয়রা ধারণা করছেন।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইলিশ বিচরণে দক্ষিণের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর ৩২টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন মেঘনার সাতটি পয়েন্ট অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। বিগত কয়েক বছর এ পয়েন্টগুলোয় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার প্রবণতা ছিল বেশি। পয়েন্টগুলো হচ্ছে বরিশালের হিজলার হরিণাথপুর ইউনিয়নের আসলী-আবুপুর, হিজলার গৌরাব্দী ইউনিয়নের ওরাকুল মাছঘাট, খালিসপুর-জানপুর, মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া ও কালাবদর নদীর বাগরজা এলাকা, মেঘনার গোবিন্দপুর, বরিশাল সদরের শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নসংলগ্ন ঝুনাহার মোড়, মুলাদীর আড়িয়াল খাঁ নদী, চাঁদপুর সদরের রাজরাজেস্বর, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বহরিয়া, হাইমচরের সাহেবগঞ্জ, উত্তর মতলবের বোরোরচর, লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের চরবংশী ইউনিয়নের নামারঘাট, চান্দারখাল, কমলনগরের লুধুয়া মাছঘাট, শরীয়তপুরের নড়িয়ার পদ্মা নদীর লেকুবেপারীর ঘাট, সুরেশ্বর বাংলাবাজার খালের মুখ, ঈশ্বরকাঠি খালের মুখ, মোক্তারের চর, খাসবাজার, বাবুরচর, জাজিরার পাইনপাড়া, মাঝিরঘাট, পূর্বনা, ডোবা, বাবুরচর, কুণ্ডেরচর, ছিডারচর, শফিক কাজীর মোড়, গোসাইরহাটের বাংলাবাজার খাল, জৈয়ন্তি নদী, কুচাইপট্টি ইউনিয়নসংলগ্ন মেঘনা, বিষকাঁঠালিয়া-মেঘনার অববাহিকা, ঠাণ্ডারবাজার ও টেকপাড় মৎস্য আড়তসংলগ্ন খাল, গোসাইরহাট-হাইমচর-চাঁদপুর সীমানার মেঘনার ৬০০ মিটার, ভেদরগঞ্জ উপজেলার পদ্মা নদীর কাঁচিকাটা, দেওয়ানগঞ্জ ও মোল্লা বাজার।
একাধিক মৎস্যজীবী সংগঠক জানান, নিষেধাজ্ঞাকালীন স্থানীয় প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ীরা অসাধু মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বড় অংকের টাকা লেনদেন করেন। ফলে কয়েক বছর ধরে নিষেধাজ্ঞার সময় নদী প্রভাবশালী জেলেদের দখলে চলে যায়। বিশেষ করে নদী-তীরবর্তী জনপদের প্রায় সব প্রভাবশালী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইলিশের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। মেঘনায় সব অঘটনের নেপথ্যে থাকেন জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাছাড়া অভিযান পরিচালনায় স্থানীয় মৎস্য অফিসের নিযুক্ত নৌকার মাঝিরা জেলেদের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। অভিযান রওনা হওয়ার আগেই তাদের মাধ্যমে জেলেদের কাছে খবর পৌঁছে যায়।
এরইমাঝে মেঘনা পাড়ের অর্ধলক্ষাধিক জেলে জাল-নৌকা তীরে উঠিয়ে নিয়েছেন। নিষেধাজ্ঞাকালীন পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন জেলেরা। তাই সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তারও দাবি জানান তারা।
অন্যদিকে চাঁদপুরের মেঘনা নদীর মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার এলাকায় নদীতে ইলিশের প্রজননের অভয় আশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলায় প্রায় অর্ধলক্ষ নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। মা ইলিশ রক্ষায় সরকারি নিষেধাজ্ঞায় তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে সরকারি সাহায্য সহায়তা আরেকটু বাড়িয়ে এবং কিস্তি আদায় বন্ধ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা। এর পাশাপাশি বহিরাগত জেলেরা যাতে এ সীমানায় মাছ না ধরতে পারেন সেজন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।
নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবু কাউছার দিদার জানান, সংরক্ষিত নিষেধাজ্ঞার সময়ে যদি অনুকূল পরিবেশ ও অসাধু জেলেরা মা ইলিশ নিধন না করে তাহলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে।
চাঁদপুর নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমান জানান, মা ইলিশ রক্ষায় চাঁদপুর অঞ্চলের ১২টি নৌ থানা ও ফাঁড়ি ২৪ ঘণ্টা নদীতে টহল দেবে।
বিনিয়োগবার্তা/এসএএম//